অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আদিবাসীরা

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০০

বগুড়া প্রতিনিধি

আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছে ‘আদিবাসী গবেষণা পর্ষদ।’ তাদের ইতিহাস, নাগরিক সুবিধা, জীবনযাপন এবং তারা কেমন আছে জানতে সম্প্রতি ঢাকা টাইমস-এর বগুড়া প্রতিনিধি এনাম আহমেদ কথা বলেছেন আদিবাসী গবেষণা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলামের সঙ্গে।

আপনি দীর্ঘদিন ধরেই আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন। কাছ থেকে তাদের জীবনযাপনের বাস্তব চিত্র কী দেখছেন?

আদিবাসীরা মূলত কৃষিজীবী। কিন্তু ভূমি হারানোর কারণে আজকে তারা পরবাসী জীবনযাপন করছে। যে জমির তারা মালিক ছিল সেই জমিতেই আজ তারা দিনমজুরের কাজ করছে। তাদের জমি হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের মূল পেশা কৃষিতে টিকে থাকতে পারছে না। বাধ্য হয়েই রিকশা ভ্যান চালানো থেকে শুরু করে পাথর, ইট ভাঙা, মাটি কাটার মতো কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। যেহেতু তাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই, সেহেতু তারা এসব পেশায় জড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

দেশের মাটিতেই এরা বেড়ে উঠেছেন, বড় হয়েছেন। তার পরও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সামাজিক দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে কেন?

সামাজিক দূরত্ব বাড়ার অনেক কারণ আছে। অন্নদা শংকর রায়ের একটা লেখা আমার কাগজ ‘তীরন্দাজ’ এ সংকলিত করেছিলাম। যার শিরোনামটা ছিল এরকমÑ আদিবাসীরা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্বহীন অবস্থায় ছড়িয়ে পড়ছে। কারণটা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপ বলে একটা কথা আছে, যেটাকে আমরা বলতে পারি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তাদের ভাষার চর্চা নেই, ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের সংস্কৃতির চর্চা নেই, সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের যে জায়গায় থাকার কথা তারা সে জায়গাতে থাকতে পারছে না। সুতরাং তাদের উৎসবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অভাব-দারিদ্র্য তাদের জীবনকে সরিয়ে দিয়েছে। আর বাঙালিদের তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ তাদের ভূমিগুলো দখল করেছে বাঙালি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সুতরাং এমন অবস্থায় কি করে এই সামাজিক সম্পর্ক অটুট থাকে?

নাগরিক অধিকারগুলো সঠিকভাবে কেন পাচ্ছে না তারা?

নগর শব্দ বা নাগরিক শব্দটার উৎপত্তি ঘটেছে একটা মডার্ন সিভিলাইজেশন থেকে। এই যে সভ্যতা, এটা কিন্তু তাদের নয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষই তো নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং ওরা তো নগর সভ্যতা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরত্বে। এই যে শহর, এর আশপাশে কিন্তু আদিবাসীদের খুঁজে পাবেন না। আদিবাসী গ্রামগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সুতরাং তারা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।

আদিবাসীদের সম্পত্তিগুলো কবে থেকে হাতছাড়া হয়েছে? কেন হয়েছে? এর পেছনের কারণ, আসল ইতিহাসটা কী?

সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বড় একটি কারণ বলব রাজনৈতিক। তার মধ্যে যদি আমরা উল্লেখ করি ১৮৫৫-৫৬ সালে যে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৯৫-১৯০০ সালের যে মুন্ডা বিদ্রোহসহ ছোটখাটো অনেক বিদ্রোহ দিয়ে তারা চলে আসছে। এই বিদ্রোহের পর তাদের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালানো হয়। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস’ গ্রন্থটিতে বলেছেন একমাত্র সাঁওতাল বিদ্রোহে প্রায় ৩৫ হাজারের মতো সাঁওতালকে হত্যা করা হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তারা ওখান থেকে ছিটকে পড়ে। তারই খানিকটা অংশ কিন্তু বাংলাদেশের ভূখ-ে এই আদিবাসীরা। সুতরাং প্রথমত এটি রাজনৈতিক কারণ। তারপরের কারণ যে অঞ্চল থেকে আসে নাগপুর, অন্ধ্র, বিহার এই অঞ্চলগুলো ছিল চরম খরাপ্রবণ এলাকা। সেখানে কোনো ফসল ফলতো না। যে কারণে তারা জীবিকার সন্ধানে এদিকে চলে এসেছে। তখন সেখানে তাদের ভূমিগুলো পতিত হয়ে গেছে। আর একটি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ। যার ফলে এখানকার অনেক মানুষও ভূমি হারায়। দেশ ভাগের পর আদিবাসীদের সুরক্ষায় দায়িত্বশীল কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়নি। ভূমিকে কেন্দ্র করে আইনগত জটিলতাও কিন্তু আছে। একটা সময় আদিবাসীদের ভূমিগুলো বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। আদিবাসীদের জমি কেউ কেনাবেচা করতে পারবে না। কিন্তু যখন বিক্রির প্রয়োজন হলো তখন একটি আইন হলো যে, শুধুমাত্র জমিগুলো আদিবাসীদের মধ্যেই বেচাকেনা করতে পারবে। তারপর দেখা গেল এই সুযোগ নিয়ে আদিবাসীদের জমি আদিবাসীদের নাম পরিবর্তন করে বাঙালিরা কিনে নিচ্ছে। তারপর ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন তো আছেই। ভূমিদস্যুরা জোরপূর্বক দখল করেছে। বন দখল করে ইকোপার্ক করা হচ্ছে। বন দখল করে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হচ্ছে। বনের ওপর মানুষ অধিকার হারাচ্ছে। যার ফলে তারা বন থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। যদি দিনাজপুরের দিকে তাকানো হয় সেখানে শালবনের যে জমি সেখানে অধিকাংশই আদিবাসীদের জমি। কিন্তু যখন বেদখল হয়ে যায় তখন তাদের আর ওই জমিতে ফিরে যাওয়ার শক্তি থাকে না। আদিবাসীরা মামলাও করতে পারে না। কারণ তাদের সে বুদ্ধি-জ্ঞান-অর্থ-শক্তি-সাহস কোনোটাই নেই। আবার তাদের প্রাণহানির ঝুঁকিও থাকে। এ রকম প্রক্রিয়ায় অসংখ্য ভূমি আদিবাসীদের বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

আদিবাসীদের কত সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে সারা দেশে?

এর আসলে সঠিক পরিসংখ্যান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ড. আবুল বারকাতের একটি গবেষণা এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্যমতে, ইংরেজ সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সাঁওতালদের ভূমি দখলের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ একর। এছাড়া ছোট-বড় আরো কিন্তু ৪০ থেকে ৫০টির মতো সম্প্রদায় কিন্তু রয়েছে।

অনেকের ধারণা এরা খুব হিংস্র প্রকৃতির হয়? আসলে কি তারা এ রকম?

আদিবাসীদের দুইভাগে ভাগ করে নিতে হবে। পাহাড় আর সমতল। আদিবাসীরা সংগ্রামী জাতি। তারা মঙ্গোলিয়ান সম্প্রদায়ের। তাদের রক্তে এক ধরনের প্রতিশোধের জীবাণু রয়ে গেছে। কিন্তু নিষ্পেষিত হতে হতে সমতলের যেসব আদিবাসী তারা খানিকটা নিরীহ-শান্ত। তারা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। দারিদ্র্য মানুষকে নিঃস্ব করে ফেলে। পাহাড়ের আদিবাসীরা বিভিন্ন সময় কেঁপে উঠেছে তাদের স্বাধিকারের প্রশ্নে। কিন্তু এখন সেই আন্দোলনটাও হারিয়ে গেছে। তবে সেখানে খানিকটা সহিংসতা আমরা লক্ষ্য করছি। ভূমিকে কেন্দ্র করেই ঘটছে এসব সহিংসতা।

আদিবাসীরা পশু শিকারের পাশাপাশি কিছুটা কৃষিকাজ জানে। এর বাইরে অন্য কোনো পেশায় তারা যায় না কেন?

প্রাচীনকালে আদিবাসীরা পশু শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। পশুর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতো। তখন অসংখ্য বন ছিল। পশুও পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে বনজঙ্গল অরণ্য এগুলো কমে যায়। ফলে ওই জায়গাগুলোতে তারা অধিকার হারিয়ে ফেলে। শিকারের কিন্তু রাষ্ট্রীয় একটা আইন আছে যে, বনে শিকার করা যাবে না। সেখানেও তাদের বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এছাড়া সংরক্ষিত বনে অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সেখান থেকে শিকার হারিয়ে যাচ্ছে। মূলত বন হারিয়ে গেছে। বনের ওপর থেকে তাদের অধিকার হারিয়ে গেছে। তাই শিকারও হারিয়ে গেছে। কৃষির বিষয়ে বলতে গেলে আদিবাসী নারীরাই কিন্তু প্রথম বাড়ির পাশে শস্যের বীজ ফেলে কৃষি সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটায়। আমরা ইতিহাস থেকে সেটাই পাচ্ছি। তারা বাইরে আসতে চাচ্ছে, এর কারণ তাদের কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। তাদের নারীরাই কাজ করে, পুরুষরা বসে থাকে। সেক্ষেত্রে এখানে নিরাপত্তার একটি প্রশ্ন থাকে। কোনো নারী যদি দিনাজপুর শ্রম দিতে চায় সেখানে সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে। দ্বিতীয়ত পুরুষরা আসতে চায় না তাদের ভাষার সংকটে। আবার তারা কিন্তু সামাজিকভাবে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালোবাসে। তারা কিন্তু একসঙ্গে কাজ করতে যায়। দেখবেন সাঁওতাল নারীরা যখন জমিতে কাজ করছে তখন দল বেঁধে কাজ করছে। তারা একসঙ্গে খায়। এখান থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে চায় না।

তারা এ দেশে কখন আসে এবং কেন আসে?

ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখল করে তখন ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে তাদের ক্ষমতাকে পরিপক্ব করার জন্যই কিন্তু প্রথম এই উপমহাদেশে আসে তারা। এরপর তারা কিন্তু ধর্ম প্রচার করে। অর্থাৎ আদিবাসীদের কল্যাণে তাদের যা কিছু সেটা কিন্তু তাদেরকে ধর্মীয় শোষণ। এরপর কি হচ্ছেÑ তারা কিন্তু তাদের সংস্কৃতি থেকে উপড়ে পড়ছে। একটা জাতির যখন শেকড় উপড়ে যায় তখন সে জাতি কিন্তু অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।

আদিবাসীদের নিয়ে সরকার কি ভাবছে? তাদের জীবন মানের উন্নয়নের জন্য আপনার গবেষণা পর্ষদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

রাষ্ট্র ভাবছে বলতে জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দশক পালন হচ্ছে। জাতিসংঘ যেমন করছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও তেমন করছে। শুধুমাত্র দিবস পালন আর উৎসব এবং কয়েকটা টাকার বৃত্তির চেক প্রদানের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার সে রকম দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা আমরা দেখি না। রাষ্ট্রের পরিকল্পনা আসলে রিলিফ, সাহায্য আর বৃত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আদিবাসী গবেষণা পর্ষদ মনে করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের পরিকল্পনার প্রথম দাবি হলো তাদের জমিগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মালিকদের ফেরত দিতে হবে। এটি করতে পারলে তারা টিকে থাকতে পারবে। তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। তাদের জমি ফেরত দেওয়া নিয়ে আমরা দাবি করছি, পত্রিকায় লেখালেখি করছি, আন্দোলন করছি।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ঢাকা টাইমস এবং আপনাকে ধন্যবাদ।

(ঢাকাটাইমস/১৩নভেম্বর/এজেড)