মেক্সিম গোর্কির বুর্জুয়া পকেট

জাকির হোসেন সেলিম
| আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১১:১৬ | প্রকাশিত : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০৩

কবিরকে এখন অপ্রিয় একটা কাজ করতে হবে। নেমন্তন্ন করা মেহমানকে ঘরের দ্বার হতে ফিরে যেতে বলতে হবে।

তার অস্হির লাগছে। উপায় নাই। মিরা আসে সাড়ে দশটায়, রিক্সা থেকে নেমেই চারপাশ দেখে। কবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসে।

আজ মিরা শাড়ী পড়েছে। তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।

মিরাকে দেখে কবিরও হাসতে চেষ্টা করে, তবে সে নিশ্চিত তার হাসি কান্নার মতো দেখাচ্ছে।

মিরাকে দেখে মনে হচ্ছে সারা দিন কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। কবির পরিস্হিতি স্বাভাবিক করার জন্য কথা শুরু করে, প্রসঙ্গ মিরার দাদু। শুনেছিল দাদুর দাঁতে ব্যাথা। বর্তমান অবস্হা কেমন জানতে জিজ্ঞেস করে, দাদুর কি অবস্হা, দাঁতের ব্যাথা কমেছে?

মিরা মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। কোন উত্তর দেয় না।

কবিরের অস্হিরতা আরেকটু বাড়ে, নিজেই নিজেকে একটা গালি দেয়। কথা বলার এটা কোন প্রসঙ্গ হলো? সে যে কত বড় গাধা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়। কবিরের অপ্রস্তুত পরিস্হিতি দেখে মিরা খুব মজা পায়। সে প্রথম বারের মতো নিরদ্বিধায় কবিরের হাত ধরে, চলুন সোহরাওয়ার্দীর ভেতরে যাই।

মিরাকে স্কুল পালানো বালিকাদের মতো লাগছে। শরীর জুড়ে নিয়ম ভাঙার আনন্দ। রাজ্যের সরলতা দুই চোখে। শেষ সকালের বাতাসে আঁচল উড়িয়ে কবিরকে এক প্রকার টেনে নিয়ে চলেছে। টিএসসির সামনের রাস্তা পর হতে হতে দুই বার কবিরের মুখের দিকে তাকায়। প্রতিবার কবিরের হাতটা আগের বারের চাইতে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেছে। কবিরের পা তো সত্যি অসার অসার লাগছে, তার তো মিরার সাথে সমান তালে পা ফেলার কথা না। এমন উচ্ছল একটা মেয়েকে কি করে বলবে,

তুমি চলে যাওয়া। আজ আমরা ঘুরতে যাব না। কারন কি ? কারনটা অতি তুচ্ছ। তুচ্ছই বা বলে কি করে?

মিরা সোহরাওয়ার্দীর গেটে ডাব দেখে খেতে চাইল। কবিরের পকেটে একটা ডাব কেনার পয়সা আছে। সামান্য বেশীই আছে, এখন ঢাকা শহরে একটা ডাবের দাম পঞ্চাশ টাকা। কোন দরদাম চলে না, কবিরের পকেটে আছে পঁচাত্তর টাকা, দেড়টা ডাবের দাম। সমস্যা হলো ডাব অর্ধেক হিসাবে বিক্রী হয় না, পুরোটাই কিনতে হয়। কবির ঠিক করে, সে ডাব খাবে না, কিন্তু দুইজনের জন্য একটা ডাব কোন যুক্তিতে কিনবে?

কবির আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, এক টুকরো মেঘও নাই। সকাল এগারটাতেই আকাশটা কটকটে নীল, সূর্য্যটা ভাটার আগুনের মতো জ্বলছে।

কবিরের সারা শরীরে ঘাম, ডাব দেখে তার মুখের ভেতরটাও লোভীর মতো শুকাতে শুরু করেছে।

মিরার দিকে তাকিয়ে দেখে, কবিরের ভাবনা মনে হয় না তাকে ছুঁতে পেরেছে; মেয়েটা ফুলের মতো ফুটে আছে। রোদের তাপ তারে ফর্সা ত্বকে একটা লালচে আভা এনে দিয়েছে, অন্য রকম একটা সুন্দর্য্য। কবির মুগ্ধ হয়ে মিরাকে দেখছে।

মিরা সরাসরি করিরের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। কবিরের চোখে এমন মুগ্ধতা দেখে সামান্য লজ্জাও পায়। বলে, ডাব কেটে দিতে বলুন?

মিরা কবিরের সাথে তিনবার দেখা করেছে, ভিন্ন ভিন্ন রেষ্টুরেন্টে; তিনবারই মিরা খাবারের বিল দিয়েছে। কবিরই আজকে সারা দিন এক সাথে কাটানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। পত্রিকা অফিসের বেতন পাওয়ার কথা ছিল দুই দিন আগে। হাতে দু’টো দিন রেখেই সময়টা দিয়েছিল। পত্রিকা অফিসের বিলটা হয় নাই। বাসায় এসে দেখে রুমমেট জাহিদ গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। সকালে মানি ব্যাগের শেষ সম্বল ১০০ টাকা নিয়েই বের হয়েছে। করিম মিয়ার দোকানের বন-কলা পনের টাকা, সকালের নাস্তা। দশ চাকা মোবাইল রিচার্জ। এখন পকেটে পঁচাত্তর টাকা। কবিরকে খুব হিসাব করে কল করতে হবে কথাটা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়। সকাল থেকে একটা কলই করেছে। মিরা কখন বের হবে জানতে ফোন করেছিল। সামান্য একটু আশা, হয়তো মিরা বলবে, কবির ভাই, আজ তো বের হতে পারবো না। বাসা ভর্তি মেহমান, সবাইকে রেখে তো বের হওয়া যাবে না।

অতি সামান্য আশা, তবু হতেও তো পারে! হয় নাই, মিরা দশটায় টিএসসির সামনে থাকবে জানায়। কবির ফোন রেখে দিতে চাইতে, মিরা কথার পিঠে কথা বলে, রাখি রাখি করছেন কেন?

মিরা শুন, তুমি তো আসছই, সামনা সামনি কথা হবে।

এতো সুন্দর একটা মেয়ে তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল, সে বলতে পারে নাই; মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাবে। কোন মানে আছে?

মিরা যদি ডাবের দাম দিতে চায় কবিরের কি নেয়া ঠিক হবে? মনে হয় না, প্রশ্নের উত্তর কবিরের ঠিক করাই আছে।

ডাব বিক্রেতার কাছে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলো,

বিক্রেতা ভ্যান গাড়ীর ডান দিকে দেখিয়ে বলল, ষাট টাকা, আর বা’দিকের কোনায় রাখা কয়েকটা দেখিয়ে বলল পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ টাকার ডাব গুলো মনে হচ্ছে বাসি। এই ভ্যানের মধ্যেও সাম্য অবস্থা নাই। শ্রেনী বিভাগ আছে, মূল্যের তারতম্য আছে। কবির আঙুল দিয়ে ষাট টাকার ডাবের দিকে ইশারা করে।

কেটে দিন। সংখাটা উল্লেখ করে না।

প্রিয়তমার জন্য সব কিছু প্রথম শ্রেনীর হতে হয়। তাদের প্রেম এখনও হয় নাই। তবে কবির আশা করছে, প্রেম হবে। অর্থ সংকট একটা বড় সমস্যা। পকেটে পঁচাত্তর টাকা নিয়া রাজকন্যা মতো একটা মেয়ের সাথে প্রেম করার চেষ্টা কি মানায়?

মিরার হাতে ডাবটা তুলে দিতেই সে খাওয়া শুরু করে না, কবিরের জন্য অপেক্ষা করে। কবির তার ডাবটাও হাতে নিক।

মিরা মাথায় একটা পরিকল্পনা নিয়ে ডাব খেতে চেয়েছে। কবিরের সাথে তার দিন শুরুর পরিকল্পনা।

একটা গাছের ছায়ায় বসে এক চুমুক পানি খাবে আর কবিরের সাথে গল্প করবে।

তার কত গল্প যে জমে আছে!

কবির ডাব বিক্রেতার হাতে ষাট টাকা দিয়ে অতিরিক্ত একটা স্ট্র চেয়ে নিয়ে পার্কের ভেতরের দিকে হাঁটতে থাকে। মিরা কবিরকে কিছু বলতে গিয়েও শেষ মূহুর্তে পিছিয়ে যায়, নি:শব্দে কবিরকে অনুসরন করে। কবির একটা দেবদারু গাছের পাশে বসে। কবিরের চারপাশে পাশের বড় একটা গাছের গাঢ় ছায়া, ঝিরি ঝিরি বাতাসে দেবদারু গাছের পাতাগুলো নড়ছে, এক ধরনের খচ খচ শব্দ হচ্ছে, মিরা কবিরের খুব কাছাকাছি বসে।

মিরা কবিরের দিকে তাকিয়ে দেখে। প্রায় এক বৎসর কবিরকে চেনে। সে এই যুবককে কতটা ভালবাসে বলে বুঝাতে পারবে না। আজ মনে হচ্ছে সে এমন কিছু শুনবে যা গেল কয়টা মাস প্রতি মূহুর্তে শুনবে বলে প্রতিক্ষা করে আছে।

মিরা নিজের চোখের দৃষ্টিতে আরেকটু মায়া লাগায়। সে খুব করে চায় কবির এই মূহুর্তে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুক। তার চোখের ভাষা পড়ুক। কবির মিরার চোখের দিকে তাকায় না, সে মিরার হাত থেকে ডাব নিয়ে নিজের হাতের স্ট্রটাও ঢুকিয়ে দেয়। মিরা আগেই অনুমান করতে পারছিল, কবির মিরাকে ইশারা করে নিজে স্ট্রতে ঠোঁট লাগায়।

এই মূহুর্তে মিরা আর কবির স্ট্র লাগিয়ে একই ডাবের পানি খাচ্ছে। মিরা একটু পর পর কবিরকে দেখছে। কিন্তু তার পরিকল্পনা মতো গল্প শুরু করতে পারছে না।

কবিরের দুইটি চোখ কত কাছে, মনে হচ্ছে প্রতিবার তার চোখের পাঁপড়িকে ছুঁয়ে দেবে। বার বার তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মিরার মনে হয়, দিনটা এতো ভাল কেন ?

কবির মিরার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে। মিরা এই ভালবাসার অসারতা ধরতে পারে নাই। সে মুগ্ধ কবিরের অভিনয়ের কাছে।কবির বিষয়টাকে অভিনয়ই বা বলে কেন ? পরিস্হিতি, শুধু মেনে নেয়া। তবে ষাট টাকা মিরাকে তার অনেক কাছে এনে দিয়েছে।

মিরাকে একা রেখেই কবির চলে আসে।

মিথ্যা কথাটা কবিরকে বলতেই হয়। সে মিথ্যা এমনিতে বলে না, প্রয়োজন পড়ে না, আজ প্রয়োজনে বলতেই হয়েছে। কবির কাল্পনিক একজনকে ফোন করে কাজের অজুহাত তৈরী করে। মিরাকে যখন বলল আজকের ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা বাদ, মিরা অবাক হয়েছে। তার মুখের হাসিও ম্লান হয়েছে তবে মুছে যায় নাই। কবিরের মুখে অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিল, তবে তার তাড়া নাই। মিরা অপেক্ষা করবে।

কবিরের মাঝে আজ যা দেখেছে, তার মনে হয়েছে এক দিনের জন্য তাই যথেষ্ট। কবিরের ব্যস্ততা মেনে নেয়া যেতে পারে, কবির যাক না নিজের কাজে।

মিরা একটু পর বাসায় ফিরবে। তার দুই বান্ধবীর সাথে আড্ডা দেবে, ফোনে কথা হয়েছে; ওরা আসছে। কবির যেহেতু খুব ব্যাস্ত সে চলে গেছে। মিরা রিক্সা ডেকে দেয়ার কথা বলেছিল,

কবির রাজি হয় না, বলে,

এই তো শাহবাগ থেকে বাসে উঠবো। চারুকলায় একজনের সাথে দেখাও করতে হবে। কি দরকার রিক্সা নিয়ে?

কবিরের পকেটে এখন আছে পনের টাকা। কবিরের ইচ্ছে করছে পকেট খালি করে ফেলতে। মেক্সিম গোর্কীর নায়ক নিল এর মতো। হালকা হালকা পকেট, হালকা হালকা মন। পকেট হালকা হলে মন হালকা হবে এমন কথা লেখক কিভাবে আবিস্কার করলেন ? আবিস্কার যেহেতু মেক্সিম গোর্কীর, অবশ্যই সঠিক হবার কথা।

কবির পকেট থেকে পনের টাকা বের করে হাতে নেয়।

আশেপাশে অনেক লোক, কবিরের মনে হয় কারও পকেটের অবস্হা তার মতো না। সবার পকেটে অবশ্যই পনের টাকার বেশী আছে। তার পকেটেই কেবল পনের টাকা। এই যুগে স্কুলের ছেলেদের টিফিনের খবচ এক শত টাকা। সে এক শত টাকা নিয়ে মিরার সাথে প্রেম করতে এসেছে? কবির হতাশ। সারা দিন কত কিছুই না হতে পারতো! সে কিনা অর্থের জন্য মিথ্যা বলে পালিয়ে এসেছে?

তার উচিত নিল হয়ে যাওয়া। পনের টাকা কাউকে দিয়ে পুরো শূন্য অবস্হায় চলে যাওয়া। কিন্তু আশপাশে কোন ভিক্ষুক শ্রেণীর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

কবির, কেউ যেন না দেখে এমনি করে মুঠো থেকে টাকাটা ফেলে দেয়।

সে হাফ ছাড়ে, যাক এবার সে সত্যিকার নিল হয়ে গেল, মেক্সিম গোর্কীর নায়ক। হালকা হালকা পকেট, হালকা হালকা মন। সবার মাঝেও স্বতন্ত্র। কারন তার পকেটে এক পয়সাও নাই।

শেষ কবে এমন “পকেট কপর্দকহীন” হয়েছে, কবির মনে করতে চেষ্টা করতে চেষ্টা করে। সে মনে করতে পারে না।

পেছন থেকে একটা হাত কবিরের কাঁধে রেখে তাকে থামায়।

কবির দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে এক মুখ দাঁড়ির ফাঁকে দু’টো ঠোঁট হাসছে।

কবিরের দিকে লোকটি ডান হাত বাড়িয়ে দেয়, মুঠি খোলে, বলে, আপনার টাকা। পনের টাকা।

কবির সন্দেহের চোখে তাকায়, চোখে জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞেস করে,

আমার টাকা?

লোকটা উপর নীচ মাথা নাড়ায়, জি আপনার টাকা, ডান হাত থেকে পড়েছে, আমি নিজ চোখে দেখেছি।

আই উইটনেস। অস্বীকার করে লাভ নাই।

কবির অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিজের ডান হাতের তালু দেখে। ভাব খানা এমন ডান হাত বিশাল একটা অপরাধ করেছে, আরো বিশ্ময়ের ব্যাপার হাতের তালু এমন অপরাধ করলো কি করে?

পনের টাকা নিয়ে লোকটাকে কোন ধন্যবাদ না দিয়েই কবির শাহবাগের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

লোকটা সামান্য অবাক হয়েছে। সে অন্তত একটা ধন্যবাদ আশা করেছিল।

পাবলিক লাইব্রেরি অতিক্রম করার সময় ফুটপাতে এক ভিক্ষুককে দেখে।

কবির মনে মনে বলে, পাইলাম অবশেষে পাইলাম। ভিক্ষুকের সামনে একটা মাটির পাত্র কিন্তু কোন টাকা পয়সা নাই। ভিক্ষুকরা কখনও সামনে খালি পাত্র রাখে না, শোভনীয় না। ভিক্ষা করার শুরুতে নিজেই নিজেকে ভিক্ষা দিয়ে শুরু করে, ইনভেষ্ট। শূন্য পাত্রে কেউ কিছু দিতে চায় না। লজিক তো অবশ্যই আছে। কবির সামান্য এগিয়ে হাতের টাকাটা ভিক্ষুকের সামনে রাখা মাটির পাত্রে রেখে ঘুরতেই পেছন থেকে ডাকে,

এই যে ভদ্রলোক !

টাকা ফেরত নিয়ে যান। দোয়ার অফিস বন্ধ। এই বেলায় কোন দোয়া হবে না।

কবিরের ভিমরি খাবার দশা। লোকটা বলে কি?

তার মনে হয় জীবনের এক বিরাট ঘটনার ক্ষণ উপস্হিত হয়েছে। ভিক্ষুক ভিক্ষার টাকা ফেরত নিতে বলে! কবির আজকের তারিখটা মনে করতে চেষ্টা করে। কোনভাবেই মনে আসে না। কবিরের হাতে ঘড়ি নাই, অনুমান করেই বলে, মাত্র তো বারটা বাজে, ভিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ কেন ?

লোকটা কঠোর দৃষ্টিতে আপাদমস্তক কবিরকে দেখে, তারপর দৃষ্টিটা কোমল করে বলে,

জনাব বোধ হয় বিশেষ কোন পেশার সাথে জড়িত না, সংক্ষেপে বেকার; পেশা এবং বানিজ্য সম্পর্কে কোন ধারনাই নাই। আমি এখানে ভিক্ষা করছি না।

আপনি এখানে কি করছেন? কবিরের ঘোর পুরোপুরি কাটে নাই।

আমি এখানে মিডিয়া ম্যানের কাজ করি। সামনের রাখা মাটির পাত্র দেখিয়ে বলে, এখন এই অফিস থেকে কিছু চাওয়া যাবে না। টাকা নিয়ে বিদায় হোন। অন্য জায়গায় দেখেন। এই লাইনের ব্যবসায়ী আমি একা না।

কবির কি সত্যি এই সব শুনছে ? একবার সন্দেহ হয়। মিরাকে রেখে চলে এসেছে বলে মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উল্টা পাল্টা সব বিষয় দেখছে। কবির চারপাশে দেখে। দৃষ্টি ভ্রম না, সে দিনের ফক ফকা আলোতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে মিরাকে টিএসসিতে একা রেখে চলে এসেছে, কেবল মাত্র পকেট খালি বলে। এখন দেখা যাচ্ছে অর্থ কোন বিষয়েই না, ভিক্ষুকও ভিক্ষা ফেরত দিচ্ছে। সে ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করে,

এই যে মিডিয়া ম্যানের বিষয়ে কি যেন বললেন, বুঝিয়ে বলেন তো !

আমার কাজ আপনার হয়ে স্রষ্ঠার কাছে দোয়া চাওয়া, লাভের পরিমান বাড়ানো। ভূমিকাটা তো মিডিয়াম্যানের, একটু অন্য রকম করে দালালও বলতে পারেন। আপনার হয়ে কাজটা করে দেয়া। মানুষ আবার নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে পছন্দ করে। আমাদের ব্যবসাও মাসাল্লাহ ! আপনি আমাকে কিছু পয়সা দিলেন আমি আপনার হয়ে দোয়া করে দিলাম। শেষ বিচারের দিনে আপনার দেয়া টাকা সত্তর গুন ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিতে আপনি বিনিয়োগও করতে পারেন। অনেকেই বিনিয়োগ করে, লাভের কথা শুনেই করে। আপনাকে যদি বলতাম, ভাই সাহেব এক শত টাকা দিন কেয়ামতের দিন পন্চাশ টাকা ফেরত পাবেন, আপনি দিতেন না। সবাই লাভ চায়। লাভ বেশী বিনিয়োগ বেশী।

কবিরের কাছে যদিও বিষয়টা পুরোপুরি পরিস্কার না, তারপরও সে জিজ্ঞেস করে,

শেষ বিচারের দিনে সবার মনোবান্চনা যে পূরন হবে কিংবা লাভের অংশ সহ বিনিয়োগ ফেরত পাবে তার গ্যারান্টি কি ?

লোকটা উদাস কন্ঠে বলে, কোন গ্যারান্টি নাই। তারপর টাকা কয়টা কবিরের হাতে দিয়ে বলে, প্যাঁচাল বাদ দেন, চলে যান, আজ ওভারটাইমও খাটুম না, সাফ কথা।

কবির আবার পনের টাকা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে। বেশ বুঝা যাচ্ছে পনের টাকা কবিরের মায়া ত্যাগ করতে চাচ্ছে না। করিম মিয়ার দোকানের কলা রুটি এখন আর পারস্হলীতে নাই, খালী পাকস্হলী থেকে থেকে নিজের অবস্হা জানান দিচ্ছে। কবির শাহবাগ মোড়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ঝুলানো কাঁধি থেকে একটা কলা হাতে নিয়ে চায়ের অর্ডার দেয়। নিজের টাকা নিজের কাজে লাগুক। দেখা যাক এবার কিভাবে কবিরে পকেটে সেঁটে থাকে।

কবির চা এ ভিজিয়ে একটা বিস্কিটও খায়। পুরো পনের টাকা খরচ। চায়ে গ্লাসে শেষ চুমুক দেয়ার আগে আবারও কাঁধে হাত। পেছনে ফিরে দেখে বন্ধু ফরিদ। কবিরকে জিজ্ঞেস করে,

কি রে চা খাচ্ছিস নাকি ?

কবির হাসে। সে চায়ের কাপে নিশ্চয় শরবত খাচ্ছে না। উত্তর শুনতে না, ফরিদ এমনি এমনিই প্রশ্নটা করেছে। সে

দোকানদারকে একটা সিগারেট দিতে বলে। তারপর চায়ের অর্ডার দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধূয়া ছাড়তে ছাড়তে কবিরকে জিজ্ঞেস করে,

তুই কি আজ খুব ব্যাস্ত ?

না, তেমন না। সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসে যাব। কেন বলতো ?

তা হলে মতিঝিল চল, যেতে যেতে বলছি।

ফরিদ দোকানদারকে কত হয়েছে জিজ্ঞেস করে।

একটা সিগারেট আর এক কাপ চা, পনের টাকা। দোকানদারের তড়িৎ উত্তর।

তুই বিল দিয়ে দিয়েছিস, ফরিদ, কবিরকে জিজ্ঞেস করে।

মামায় বিল দেয় নাই। উত্তর দেয় দোকানদার, কবির না।

ফরিদ দোকানদারকে এক শত টাকার একটা নোট দিয়ে দুই জনের বিলই রাখতে বলে।

কবির প্রতিবাদ করে,

আমি আমার বিল দিচ্ছি, তুই তোর বিল দিয়ে যা।

তা হলে তুই আমারটাও দিয়ে দে, ফরিদ নিজের দেয়া টাকাটা ফেরত নিতে দোকানদারের দিকে হাত বাড়ায়। কবিরের ভেতর আবার সেই অস্হিরতা, সে চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। তার পকেটে ত্রিশ টাকা নাই। তবে সে মনে মনে ঠিক করে পত্রিকার চাকুরীটা ছেড়ে দেবে।

ফরিদ মটর সাইকেল চালায়। কবির ফরিদের পেছনে বসে। হ্যালমেট একটাই। এই মূহুর্তে ফরিদের মাথায়। ফরিদ শাহবাগ থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরলে কবির মৃদু প্রতিবাদ করে। মিরার কথা মনে পড়ে। মিরা কি এখনও টিএসসির সামনে আছে ? ফরিদকে বলে,

সোজা চল।

আরে না, এই দিক দিয়ে গেলে প্রেস ক্লাব আর পল্টনের জ্যামে পড়বো। সচিবালয়ের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাব। শক্ত হয়ে বসে থাক, ফরিদ মটর সাইকেলের গতি বাড়ায়।

পনের টাকা কবিরে পকেটেই থাকে। তার মনে হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা গুলো বিশেষ কোন ঘটনার ইংগিত। কবির ভাবতে চেষ্টা করে সে ঘুম থেকে উঠে কার মুখ দেখেছে ?

করিম মিয়ার ? না, বন- কলা খাবার সময় একবারও করিমের মুখের দিকে তাকায় নাই। করিমকে সে চেনে, তার চেহারা আগেই দেখা। আজ পয়সা দেবার সময়ও করিমের মুখের দিকে তাকায় নাই। মোবাইল রিচার্জের সময় ? না, সেই লোকটাকেও কবির দেখে নাই। সামনে রাখা খাতায় নিজের নম্বরটা লিখে দশ টাকা এগিয়ে দিয়েই চলে এসেছে। তিন মিনিটের ঘটনা, তার চেহারাও দেখার সময় কোথায় ? গ্রীন রোড হতে টিএসসি, এই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কবির আশপাশের মানুষ আর যানবাহনের উপর চোখ বুলিয়ে গেছে, কিছুই দেখে নাই ! তার ভাবনা জগত জুড়ে ছিল মিরা।

ভয়াবহ ঘটনা !

ফরিদ হলো শেয়ার ব্যাবসারীদের উপদেষ্টা। এই পেশায় নতুন, তবে খুব দ্রুত উন্নতি করছে। দুই টেবিল আর চার চেয়ারের অফিসে ঢুকেই নিজের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা খুলে তিনটা মোবাইল ফোন বের করে। বলে, আমার অফিস।

প্রতিটা ফোনই বেজে চলেছে। মিউট করা, রং হচ্ছে না, ঝি ঝি পোকার মতো ডাকছে। ফরিদ একটার পর একটা ফোন ধরছে, চুপচাপ শুনছে, নিজের মতামত দিচ্ছে। আধা ঘন্টা পর্যন্ত এমনি চলে।

একটু দম নিয়ে পকেট থেকে অন্য আর একটা ফোন বের করে কাকে যেন দুই প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ে যেতে বলে।

কবির উঠে দাঁড়ায়, তার যেতে হবে। বসে থাকতে ভাল লাগছে না।

ফরিদ হায় হায় করে উঠে,

কোথায় যাচ্ছিস ? কাচ্চি বিরিয়ানী আসছে। দোস্ত তোকে একটু দরকারও। আজ দুই পার্টির পেমেন্ট পাব, সব তো সাদা টাকা না, চেক দেয় না; পুরোটাই ক্যাশ। তুই সাথে থাকলি, একটু নিরাপত্তা; বুঝলি না ! আমি তোকে বাসায় নামিয়ে দেব।

বেশী দেরী করতে পারবো না, সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসে যেতে হবে। পর পর কয়েকটা ফোন রিসিভ করে ফরিদ উঠে দাঁড়ায়। ফরিদকে খুব অস্হির দেখাচ্ছে। কবিরের ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করে।

তোর কাছে আমার নম্বর নাই ?

আছে,আমার এই নম্বরটা তোর কাছে নাই। এইটা নতুন সিম, নাম্বার বল তোকে একটা কল দিচ্ছি। সেভ করে রাখ।

কবির নিজের নম্বর বলে। ইতিমধ্যে একটা ছেলে দুই প্যাকেট বিরিয়ানী রেখে গেছে। কবিরের আবার মিরার কথা মনে পড়ে। এক প্যাকেট বিরিয়ানী অন্তত খাওয়ানোর মতো টাকা তার পকেটে থাকা উচিত ছিল। মিরা হয়তো এখনও খায় নাই, কবিরের মনে হয় তার বিরিয়ানী খাওয়া ঠিক হবে না। মিরাকে একটা কল করবে কিনা ভাবে। ব্যালেন্সের কথা মনে হয়, পত্রিকা অফিসে খবরের সন্ধানে অনেক গুলো কল করতে হতে পারে। তার দিনের দ্বিতীয় মিথ্যা বলার প্রয়োজন দেখা দেয়। সে ফরিদকে মিথ্যা বলে,

পেটে সামান্য সমস্যা। বাইরের তৈলাক্ত জিনিস খেতে চাচ্ছি না।

ফরিদ কবিরকে দ্বিতীয় বার সাধে না। নিজের প্যাকেট শেষ করে, কবিরের প্যাকেটটা টেনে নেয়। বড় একটা মাংসের চপ চিবাতে চিবাতে বলে,

কাচ্চি বিরিয়ানী মানেই বেহেস্তী মাল।

কবিরের কাচ্চি বিরিয়ানীর আগ্রহ নাই। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, তার সিরিয়াসলি কিছু করতে হবে। একটা পরিচয় দেবার মতো চাকুরী দরকার। তার মিরার কথা মনে পড়ে, পকেটে রাখা পনের টাকার কথা মনে পড়ে।

বিকাল প্রায় শেষ হয়ে এল। ফরিদ সেই যে গেছে আসার খবর নাই। এই অফিসে দুই বোতল পানি ছিল, কবির শেষ করে ফেলেছে। অফিসের সামনে এতোক্ষণ মানুষের ভিড় ছিল, এখন কমে গেছে। কবির উঠে দাঁড়ায়, তার একবার ওয়াস রুমে যাওয়া দরকার। চাপ ক্রমশ বাড়ছে, অতিরিক্ত পানি খাবার ফল। এই অফিসের দরজায় তালা আছে কিনা সন্দেহ। কবির ফরিদকে খুলতে দেখে নাই। আরো একটা সমস্যা আছে। ফরিদ বের হয়ে যাবার আগে এক লোক একটা ট্রাভেল ব্যাগ দিয়ে গেছে। এই মূহুর্তে ব্যাগটা কবিরের পায়ের কাছে, টেবিলের নীচে। ব্যাগে কি আছে কবির জানে না। বেশ ওজন, পনের কেজির মতো। কবিরের নিম্নচাপ এবং অস্হিরতা দুই বাড়ছে। সে ব্যালেন্স হারানোর ঝুঁকি নিল। ফরিদকে ফোন করলো, ফরিদের ফোন বন্ধ। কবির ফরিদের দেয়া নতুন নম্বরে ফোন করলো, সেই ফোনও বন্ধ। কবিরের ভেতর একটা আনইজি ফিলিংস কাজ করতে শুরু করেছে। বিষয়টা ঠিক ভয়ও না, কেন যেন মনে হচ্ছে তার কিছুই হবে না। পনের টাকা তার পকেটে আছে। কোন যুক্তি নাই। মাগরিবের আজান শুরু হতেই কবির উঠে দাঁড়ায়। আর না, দরকার মনে করলে ফরিদই তাকে খুঁজে নেবে।

কবির পায়ের কাছে পড়ে থাকা ট্রাভেল ব্যাগটা নিতে গিয়ে সামান্য ভাবে, এতোটুকুই। তারপর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তার সব কয়টা লাইট জ্বলছে। রাস্তার উল্টা পাশেই গন শৌচাগার। কবির সেই দিকে পা বাড়ায়। মিনিট দশেক পর বের হয়ে আসে। ফ্রি সার্ভিস, শেয়ার পাড়া, ব্যবস্হা ভাল। কবির মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় তাকে একটু অন্য রকম লাগছে। মুখ হতে গড়িয়ে পড়া পানি ফোঁটা গুলি গায়ের জামা পর্যন্ত যেতে দেয়। জামা ভিজুক, আয়নার ভেতর হতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা দেখে।

কবির রাস্তায় নেমে আবার ফরিদের অফিসের দিকে তাকায়। কয়েকজন মানুষের জটলা। দুই জন পুলিশও দেখা যাচ্ছে। কবির নিজের ভেতর থেকে তাড়া অনুভব করে। সে রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে হাঁটা ধরে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলাকা ছাড়তে হবে। আপাতত পত্রিকা অফিস।

পত্রিকা অফিসে ঢুকতেই প্রথম প্রশ্ন।

কবির ভাই কি বাড়ি যাচ্ছেন?

কেন মনে হলো বাড়ি যাচ্ছি? শায়লার প্রশ্নে উল্টো প্রশ্ন করে কবির। শায়লা অফিসের রিসিপশনে বসে। সে কবিরের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা দেখায়।

ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছেন।

কবির ব্যাগটা দেখে। সে বুঝতে পারছে না কি বলবে, প্রয়োজন কিনা জানে না, তবে শায়লার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়। শায়লা যা বুঝার বুঝে নিক। কবির জিজ্ঞেস করে,

সেলারির খবর কি?

জানিনা কবির ভাই। শুনেছি কারো কারো সেলারি গতকালই হয়েছে। আমি ছোট কর্মচারী, আমার সেলারি কবে হবে জানিনা। শায়লার হতাশা কবিরকে ছুঁয়ে যায়। তার মিরার কথা মনে পড়ে। মিরা কি বাসায় ফিরেছে? ফোন করে খবর নিতে হবে।

কবির নিজের ডেক্সের দিকে পা বাড়ায়। পত্রিকা অফিস গুলোর আয়তন এবং গুরুত্ব সবই কমছে। সবার হাতে মোবাইল ফোন, উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহ। কষ্ট করে কাগজের পত্রিকা সংগ্রহের সময় কোথায়? একই জিনিস যখন নেটে পাওয়া যাচ্ছে।

কবির ক্ষিধেটা ভালই টের পাচ্ছে। সে রঞ্জু মিয়াকে ডাকে,

পনের টাকা বের করে দেয়। চা আর যা পারিস নিয়ে আয়। রঞ্জু মিয়া কবিরের তাড়া বুঝতে পারে, দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়ায়।

কবির ফরিদের কথা ভাবে। তার কি কোন বিপদ হয়েছে? অফিসে পুলিশ কেন? ফরিদের ফোন বন্ধ কেন? ব্যাগের মধ্যে কি আছে? বিষয়টা নিয়ে নিউজ এডিটর রোকন ভাই এর সাথে কথা বলবে কিনা ভাবে। ফরিদ, কবিরের গ্রামের ছেলে। এক সাথেই পড়াশুনা শুরু করেছিল। কবির শহরে পড়তে আসে, ফরিদ উপজেলা শহরে কলেজে ভর্তি হয়। বরাবর যোগাযোগ আছে, ঢাকায় এসে প্রথমে কিছু দিন কবিরের সাথে বেডও শেয়ার করেছে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, হঠাৎ করে কখনও কখনও দেখাও হয়ে যায়। যেমন আজ হলো।

রঞ্জু মিয়া ফিরে আসে। কবিরের সামনে পনের টাকা রাখে। বলে,

রোকন স্যার আপনাকে ডাকে। উনি আজ অফিসের সবাইকে খাওয়াচ্ছেন।

কবির পনের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবারও ফিরে এসেছে। কবির ঠিক করে এই টাকাটা নিজের কাছেই রাখবে। সে উঠে নিউজ এডিটরের কামরার দিকে হাঁটতে থাকে।

রোকন ভাই কবিরকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। আসুন আসুন।

রোকন ভাইকে খুব খুশী খুশী লাগছে। বাহ্যিক খুশী না, কবিরের মনে হয় খুশীর উৎসটা অত্যন্ত গভীর, আনন্দটা ভেতর থেকে আসছে। কামরার এক পাশে অনেক গুলো খাবারের প্যাকেট।

কবির বলেন তো আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

ভাই আপনি তো খুশীতে টগবগ করে ফুটছেন? বিষয়টা কি?

কারেক্ট! এই জন্য আপনাকে আমি এতো পছন্দ করি। শব্দের সঠিক ব্যবহার, আমি খুশিতে টগবগ করে ফুটছি। সত্যি কবির, আমি খুশীতে টগবগ করে ফুটছি। কারনটা আপনাকে বলা যায়। সাতচল্লিশ বৎসর বয়সে আমি পিতা হয়েছি, আমি এখন এক কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা। বলেন, আমার খুশী হবার কথা না? আপনার ভাবী তো শুধুই কাঁদছে। বেশী বয়সে মা হতে গিয়ে কত জনের কত কথা শুনেছে, কত জন ভয় দেখিয়েছে!

আলহামদুল্লিলাহ কোন সমস্যাই হয় নাই। সব কিছুই স্বাভাবিক। আমি কন্যা সন্তানের কান্না শুনেছি গত রাত দুইটা ষোল মিনিটে। আমি গতকাল সন্ধ্যার পর পরই অফিস থেকে চলে গিয়েছিল। আজ আমার খুশী সবার সাথে ভাগ করবো, সবাইকে ডাকুন। আর একটা কথা, আপনার শেলারীটা আমার কাছে ছিল, টেনশনে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

শেষ কথাটা শুনে কবির দাঁড়িয়ে যায়। মিরার কথা মনে পড়ে। অন্য দিন হলে কি বলত বলা যায় না, আজ সাতচল্লিশ বৎসর বয়সের কন্যা সন্তানের পিতাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কবির রোকন ভাইকে আনন্দের ঘোরে রেখেই সবাইকে ডাকতে যায়। তার পকেটে পনের টাকা।

রোকন ভাই এর আনন্দ পর্ব শেষ হয় এক ঘন্টা পর। ট্রাভেল ব্যাগটা কবিরের ডেক্সের কাছেই পড়ে থাকে। কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে বলে মনে হয় না। কবিরের গুরুত্বপূর্ন কেউ না, তার কাছে কিই বা থাকতে পারে! কবিরের হঠাৎ করেই মনে হয়,

ব্যাগে টাকা নয় তো! ফরিদ কিসের পেমেন্টের কথা যেন বলেছিল। কবির ব্যাগ হাত দিয়ে দেখে, মনে হচ্ছে লম্বা লম্বা কাগজ।

কবির আবার ব্যাগের ব্যাপারে মনোযোগ হারায়। সে মিরাকে ফোন করে। অনেক ক্ষণ রিং হয়, মিরা ফোন ধরে না। এগারটায় কবির পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়। পকেটে সেলারী, আজ যদি মিরা ফোন ধরে অনেকক্ষণ গল্প করবে। ব্যালেন্সের চিন্তা করবে না। মিরাকে বলবে কতবার তার কথা মনে হয়েছে। তার ভালবাসার কথাও বলবে। রিক্সায় উঠে কবির আবার ফোন করে। এবারও মিরা ফোন ধরে না। চিন্তার কথা।

মধ্য রাতের পর ফকিদের ফোন আসে। কবির মিরার কথা ভাবছিল। মিরা কেন ফোন ধরছে না? সে কি রাগ করেছে?

নাকি ঘুমিয়ে গেছে। ফরিদের ফোন কবিরকে ভাবনা জগত থেকে ফিরিয়ে আনে।

তুই কি বাসায় ফিরেছিস?

আমি কোথায় যাব? তারপর বল, তুই কোথায় গেলি? তোর অফিসে পুলিশ কেন? তুই আসলে কি করছিস?

সরি দোস্ত ! এতো প্রশ্নের উত্তর তো এক সাথে দেয়া যাবে না। আগে বল, ব্যাগটা কোথায় ?

আমার বাসায়।

ফরিদ যেন হাঁফ ছাড়ে। যাক। বলে,

তুই ব্যাগ খুলে দেখেছিস?

তোর ব্যাগ আমি খুলবো কেন?

ব্যাগে তো তালা নাই, খুলতেও তো পারিস, কৌতুহল!

না, খুলি নাই। তুই জানিস আমার কৌতুহল এমনিতেই একটু কম।

আমি জানি, তোর কৌতুহল বাড়ানোর জন্য বলছি, ঐ সব পুলিশ কোন ব্যাপার না, কর্পোরেট জগতের খেলা। কোন সমস্যাই পারমানেন্ট না। ঐ ট্রাভেল ব্যাগে ষাট লাখ টাকার শেয়ার আর নগদ বার লাখ টাকা আছে। তুই যদি বুদ্ধি করে ব্যাগ নিয়ে না বের হতি কিংবা অফিসে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করতি, সব কিছু হারাতে হতো। তুই সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করেছিস। যদিও সব কিছুই তুই দাবী করতে পারিস। তবে আমার পক্ষ থেকে রিজেনবল অফার, ফিফটি ফিফটি। ছয় লাখ টাকা তোর। কবির কুট করে ফোনের লাইনটা কেটে দেয়। তার ফরিদের কথা শুনতে ভাল লাগছে না। ফরিদ তাকে লোভ দেখাচ্ছে, এক ধরনের লটারী। ভয়াবহ লোভ, মানুষের আত্ব-সম্মান কেড়ে নেয়ার লোভ। আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেয়ার লোভ।

ফরিদের ফোন কল কবিরের ভেতর কোন কৌতুহলই জাগাতে পারে নাই। সেলারীর খামটা টেবিলে, একশত টাকার একটা নোট শুধু বের করে নেয়া হয়েছে। কবির পকেট থেকে সেই পনের টাকা বের করে, একটা দশ আর একটা পাঁচ টাকার নোট, কবির বালিশের পাশে রাখে। তার ঠোঁটে হাসি, এই পনের টাকা তার জন্য বিশেষ কিছু। তার পকেটে এখন কোন টাকা নাই। সে এখন মেক্সিম গোর্কীর নায়ক, নিল। হালকা হালকা পকেট, হালকা হালকা মন। কবির বিছানায় উঠে বালিশে মাথা রাখতেই চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। সামনে তার রাজকন্যা মিরা, কবিরের আর এক জার্নি শুরু হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :