গলিত পেঁয়াজের লাশ

প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২৩:১৭

অরুণ কুমার বিশ্বাস

জিনিসের দাম বাড়ে কেন! অর্থনীতির নিয়মানুসারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে স্বভাবতই পণ্যের দর বাড়ে। চাহিদা কী! আমজনতা যাই বলুক, অর্থশাস্ত্র বলে যে, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সুষম মিলন ঘটলেই তখন তাকে চাহিদা বা ডিমান্ড বলা যাবে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে অর্থ বা নীতিশাস্ত্র কিছুই ঠিকঠাক কাজ করে না। আমরা এক উন্মার্গগামী জাতিতে পরিণত হয়েছি। যখন যা নয়, তাই নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসি। 

অর্থনীতিতে আরো একটি পপুলার টার্ম রয়েছে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। আমি শুধু দুষ্টচক্র শব্দটি বেছে নিতে চাই। যদি বলি, আমাদের অতিরিক্ত খাই খাই স্বভাবের কারণেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, তাতে কি খুব মিছে বলা হবে! আমি বেশ অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করে দেখেছি যে, কোনোকিছুর দাম বাড়লেই আমজনতা তার কনজামশন বা ভোগের পরিমাণ দুই-তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। এটা একরকম অসুস্থ মানসিকতা। দাম বাড়ে বলে খাই বাড়ে, আবার খাই বাড়ে বলে দামও বাড়ে। এটাই দুষ্টচক্র। এমন নয় যে, আমাদের পেঁয়াজ ছাড়া একেবারে চলে না। বস্তুত এটা আমাদের পেটের খিদে নয়, চোখের খিদে। ভাবখানা এমন যেন পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, বাড়তেই থাকবে। জীবনে আর পেঁয়াজ খাওয়া যাবে না। তাই এবেলা যে যত পারো কিনে নাও। পেঁয়াজ কিনে খাটের তলা ভরিয়ে ফেলো। অন্যে পারছে না, অথচ তুমি দেদার খাচ্ছো, এরচে ‘দেমগীয়’ বিষয় আর কি হতে পারে!

অর্থাৎ আমি সবার আগে আমজনতাকে ধরতে চাই। এদের বুদ্ধি-বিবেচনা কম, এরা স্বার্থপর ও ভোগে বিশ্বাসী। আমার এক উচ্চশিক্ষিত (সো কলড) বন্ধুকে বলতে শুনেছি, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে দেখে সে একবারে দশ কেজি পেঁয়াজ কিনে রেখেছে। যাতে নেক্সট দুমাস আর কিনতে না হয়। অথচ এক হপ্তা পরে দাম আরো বেড়েছে দেখে সে আবারো দশ কেজি পেঁয়াজ কিনলো। এদেরকে আপনি কী বলবেন! পাগল, না এদের পেট খারাপ! এরাই মূলত পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। এসব পেঁয়াজখোরদের এখনই দেশছাড়া করা উচিৎ, নইলে পেঁয়াজের দাম আর কমবে না।

এবার আসুন, আমাদের মহানুভব ব্যবসায়ীদের কথা একটু বলি। কিছু ব্যতিক্রম সাপেক্ষে একথা বলাই যায়, আমরা ব্যবসা করি না, বস্তুত লোক ঠকাই। আমরা মুনাফালাভ করি না, মওকা বুঝে দাঁও মারি। কথায় কথায় বলি, আমরা আছি বলে দেশ চলছে। মোটা টাকা আয়কর দেই ইত্যাদি। আদতে এসব ভুয়া কথা। ট্যাক্স কী দেন, সে আমি ভাল করেই জানি। সবাই শুধু নিজেরটুকু বুঝি। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দেদার টাকা কামাই। এত কামাই করি যে, শেষে মতিচ্ছন্ন হয়ে ক্যাসিনোতে ঢুকে পড়ি, ক্লাবে গিয়ে ভরপেট মদ গিলি।

পয়েন্ট ইজ দ্যাট, দেশের মধ্যেই অন্তত দুডজন অতিকায় বিশাল আমদানিকারক আছেন যারা কিনা পেঁয়াজ জমিয়ে গোডাউন ভরে ফেলেছেন। পাবলিক সুলভে পেঁয়াজ না পেয়ে ত্রাহি ত্রাহি চেঁচায়, আর ওই সকল মহীয়ান বিজনেসম্যান মুচকি হেসে বলে, বাড়ছে বাড়ুক, পেঁয়াজের দর আরো বাড়তে দাও। যত বাড়বে, ততই মুনাফা। মার দিয়া কেল্লা। আপনি এদের কী বলবেন! স্যাডিস্ট নয়। অন্যের কষ্ট দেখে যে হাসে আর আঙুল ফুলে কলাগাছের বদলে দক্ষিণ আফ্রিকার পেটমোটা ‘নিল ডি’গাম’ ট্রি হবার স্বপ্নে বিভোর হয়! 

আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, মানুষ চেষ্টা করলে কী না পারে! পেঁয়াজ ছাড়া কি রান্না হয় না! বিনা তেলে যদি রান্না হতে পারে, তাহলে পেঁয়াজ বাদে নয় কেন! বেশি নয়, মাত্র এক হপ্তা পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ করুন, দেখবেন ওইসকল মজুতদারের মাথা আর পাছা-দুই জায়গাতেই হাত পড়বে। পেঁয়াজ চলছে না দেখে তাদের বড় টয়লেট বন্ধ হয়ে যাবে। ওরা তখন পাইকারির বদলে নিজেরাই দাঁড়িপাল্লা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে। ‘রাওয়া মোরগে’র মতোন গলা ফুলিয়ে বলবে, নিন ভাইলোগ, অল্প দামে নধর দেখতে কিছু পেঁয়াজ খরিদ করুন। আমাদের প্রাণ বাঁচান। এই আমি নাক-কান মুলছি, জীবনে আর কখনও বেশি মুনাফার লোভে এত এত পণ্য গুদামজাত করবো না।

এবার নিজের কথা বলি। স্রেফ অভিজ্ঞতা। ভাববেন না, জ্ঞান জাহির করছি। বস্তুত, অত বড় মাপের জ্ঞানীব্যক্তি আমি নই। আগে আমার প্রতিমাসে পেঁয়াজ লাগতো দেড় থেকে দুই কেজি। ব্যক্তিগতভাবে আমি পেঁয়াজের পক্ষপাতি নই। এতে মাথামুণ্ডু গরম হয়, লোকের সাথে অকারণ ঝগড়া বাঁধে। আমি বরং রসুনে বিশ্বাসী। রসুনের অনেক গুণ।  চিত্ত নরম হয়, হার্ট ভালো থাকে। পেঁয়াজের বদলে আমি রসুনের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়েছে। চা না পেলে যেমন কফি। অলটারনেটিভ ব্যবহার। চলতি মাসে আমি হাফ কিলো পেঁয়াজ কিনলাম। গিন্নি আমার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়ে পেঁয়াজের পদ বাদ দিলেন, আমি তাতে যারপরনাই খুশি। একেই বলে বাপকা বেটা, স্বামী কা গিন্নি! দেড়শ টাকা কিলো দরে পেঁয়াজ কিনবো, পাগল নাকি! অতটা মদন আমি নই।

ব্যস, দুদিনেই আমরা বলতে গেলে পেঁয়াজের নাম অব্দি ভুলে যাই। দিব্যি এখন রসুন আর জিরার ফোঁড়ন দিয়ে রান্না হচ্ছে। খেতে চমৎকার। আহ কী স্বাদ! জীবনে কী আহ্লাদ। কথায় বলে ঠেলার নাম বাবাজি। পেঁয়াজের দর আরো বাড়লে পাবলিক তখন কী করবে! চালের টাকা দিয়ে তো আর পেঁয়াজ কিনতে পারবে না। খাসলত তখন পাল্টাতেই হবে। আমিও মূলত সেই সময়ের অপেক্ষা করছি। জীবনে শান্তি পেতে চাইলে অবস্থার সঙ্গে বিদ্রোহ নয়, বরং সময় বুঝে নিজেকে সামলাতে শিখুন। তাতেই মঙ্গল হবে।

অবশেষে একটা দুঃস্বপ্ন দিয়ে লেখা শেষ করি। গেল রাতে বিদঘুটে এক স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলো। আমার এক বন্ধু আছে পেঁয়াজের কারবারি। শুধু পেঁয়াজ নয়, সে মূলত মওসুম বুঝে ব্যবসা করে, ঝড় বুঝে ছাতি ধরে। ‘ভেরি চালাক’ আর কি। তো দেখি কি, আমার সেই বন্ধু রাস্তায় নেমে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কেসটা কি দোস্ত, খুলি ক’। আমি আন্তরিকতার সুরে বলি।

তাতে সে রেগে কাঁই। বলে কিনা আমার জন্য তার সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে। কারেন্ট ছিল না তাই তার পেঁয়াজের গুদামে পচন শুরু হয়েছে। পেঁয়াজ পেরিশেবল গুডস। বেশিদিন রাখা যায় না গুদামে। আলু পচলে তাও সহ্য হয়, কিন্তু পেঁয়াজের গন্ধে ঘরে টেকা দায়। আশপাশ থেকে প্রচুর কমপ্লেন আসছে। পেঁয়াজের গুদাম সরাও, নইলে থানায় মামলা করবো। তার কারণে নাকি জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন।

বেচারা সমানে কাঁদছে, কেঁদেই চলেছে। তার টনকে টন পেঁয়াজের এখন কী হবে। পচা পেঁয়াজ তো শেয়ালেও খায় না। এর গন্ধে টেকা দায়।  শুনি, আমার কী দোষ! আমি কী করলাম! বন্ধু সখেদে বলে, তোর পেঁয়াজবিষয়ক লেখা পড়ে আমজতার চোখ ফুটেছ। তারা এখন চড়া দামের পেঁয়াজের বদলে রসুন আর জিরা খাচ্ছে। 

তাই নাকি! আরে দোস্ত, কস কি! আমার লেখার এত দাম। আয় আয় দোস্ত, তুই আমার বুকে আয়। শোন, বেশি মুনাফা খাস না। তাতে এমনই হবে। বন্দুকের নলের মতো পাবলিককে জিম্মি করে টাকা বানাতে নেই। ওই টাকা হজম হয় না দোস্ত, ক্যাসিনোকাণ্ডে বেরিয়ে যায়।

বন্ধু কী বুঝলো কে জানে! সে আবারও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো। মানে হয়!