‘জনশক্তি রপ্তানিতে সিন্ডিকেট করা আইন বিরোধী’

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৪৮ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৫৯

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও সৈয়দ ঋয়াদ

সিন্ডিকেট করে বিদেশে কর্মী পাঠানো আইন বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন অভিবাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি মো. ইসরাফিল আলম। বলেছেন, ‘আইনের কাছে সবাই সমান। কোন রকমের লিঙ্গ ভেদাভেদ, আঞ্চলিক ভেদাভেদ এসব করার কোন সুযোগ নেই। সিন্ডিকেট হচ্ছে সম্পূর্ণ আইন বিরোধী।’ সম্প্রতি ঢাকা টাইমসের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি এ মত ব্যক্ত করেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিষয়ে সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ সৈয়দ ঋয়াদ

মালয়েশিয়ার বাজারটি খোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিন্তু আলোচনা আছে, বিগত সময়ের মতো এবারও নির্ধারিত এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে চেষ্টা হচ্ছে ব্যাপারে আপনি কী বলবেন

বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটা তৈরি হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। সরকারের কোনো কন্ট্রিবিউশন এখানে ছিল না। সরকার শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে। ২০০৮ সালের আগে এই আইনগুলোও ছিল বিচ্ছিন্ন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহেব যখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তখন প্রথম আমরা আইন করি। আমাদের এখনকার আইনটা কিন্তু বেশ যুগোপযোগী এবং অত্যন্ত সুন্দর। আইনে এবং নীতিকাঠামোর মধ্যে যে সমস্যা ছিল ২০১৬ সালে তা সংশোধন করা হয়েছে। সংযোজন, বিয়োজন হয়েছে। 

এখন কথা হচ্ছে, অভিবাসন আইনে বা নীতিতে কোথায়ও সিন্ডিকেটের কথা বলা নেই। ‘ইকুয়েলিটি বিফর ল’ অর্থাৎ আইনের কাছে সবাই সমান। কোন রকমের লিঙ্গ ভেদাভেদ, আঞ্চলিক ভেদাভেদ এসব করার কোন সুযোগ নেই। সিন্ডিকেট হচ্ছে সম্পূর্ণ আইন বিরোধী। দ্বিতীয়ত, লেবার সেন্ডিং কান্ট্রির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সারা বিশ্বে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। সে কারণে সুকৌশলে জাতিসংঘ যখন গ্লোবাল কমপেক্ট মাইগ্রেশন (জিসিএম) তৈরি করতে গেল তখন তারা আমাদের থেকে প্রস্তাব আশা করেছিল। ‘সেভ অর্ডারলি অ্যান্ড রেগুলার মাইগ্রেশন’ এই টাইটেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব করেছিলেন। এর মধ্যে যে প্রস্তাবনাটা আছে এটা যদি আমরা কার্যকর করতে পারি তাহলে সারা ওয়ার্ল্ডে একটা মাইগ্রেশন অর্ডার তৈরি হবে, যা দিয়ে বিশ্বের সকল অভিবাসীরা সুরক্ষিত হবে। সেই বক্তৃতার মধ্যেও কোথাও বৈষম্যের বিষয় নাই।

তাহলে আমাদের এখানে ধরনের ‘সিন্ডিকেট’ কী করে হলো?

আপনার মতো এটা আমারও প্রশ্ন। সারা বিশ্বের ১৭৩টি দেশে আমরা মানুষ পাঠাচ্ছি। কোন দেশে সিন্ডিকেট নেই। মালয়েশিয়া ১৪টি দেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করে। কোনো দেশের সাথে তাদের সিন্ডিকেশন নেই। শুধু বাংলাদেশই মালয়শিয়ার সঙ্গে সিন্ডিকেট করেছিল। মালয়েশিয়াও বাধ্য হয়েছিল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিতে। কারণ তাদের লোক দরকার। আমি বলব, আমাদের অবস্থান বিরোধী যে সিন্ডিকেটের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে তা ব্যক্তিস্বার্থে। এটা দেশের ও জনগণের স্বার্থে নয় এবং অভিবাসীদের স্বার্থেও নয়। কিছু মানুষ এক চেটিয়া ব্যবসা করার জন্য এই সিন্ডকেট তৈরি করছে।

বিগত সময়েরসিন্ডিকেটে’র বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় বাজারই বন্ধ হয়ে গেল সেইসিন্ডিকেট’ কী করে ফের চাঙা হচ্ছে?

প্রথমে বলা হলো কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না। যেসব এজেন্সির রিপোর্ট ভাল তারা সবাই কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবেন। যাদের বিরুদ্ধে আদম পাচারের অভিযোগ আছে তারা পারবে না। অতীতে সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হলো একজন কর্মীর মালয়েশিয়া যেতে খরচ হবে ৩৭ হাজার ৫শ টাকা। কিন্তু যখন ‘সিন্ডিকেট’ হয়ে গেল তখন তারা বলল, আমরা এই অল্প টাকায় বিদেশে লোক পাঠাতে পারব না। খরচ আরও বাড়াতে হবে। তাই বাড়িয়ে এখ লাখ সাত হাজার টাকা করা হল। পরে দেখা গেল, ঘুরে ফিরে ওই দশটা এজেন্সিতে আটকে গেছে। আর এই সিন্ডিকেটের সর্বশেষ কনসিকোয়েন্স যেটা দাঁড়াল সেটা হলো, একজন লোকের মালয়েশিয়া যেতে খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

এখন মালয়েশিয়াতে থাকা অভিবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ অবৈধ হয়ে পড়েছে এত টাকা দিয়ে যাওয়ার পর সেখানে তারা অবৈধ হলো কীভাবে?

চার পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে  গিয়ে তারা দেখে যে কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে কাজ তারা পায়নি। আবার যে বেতন পাবার কথা ছিল তাও পায়নি। অনেকে তিন চার মাস বেতন না পেয়ে ধার কর্জ করে যখন আর চলতে পারছে না, তখন ওই কর্মী কারখানা পরিবর্তন করেছে। যখনই কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে তখনই সে অবৈধ হয়ে গেছে। কারণ তাদের পাসপোর্ট তো মূল মালিকের কাছে জমা ছিল। পরে পুলিশ অনেককে ধরে জেল জরিমানা করেছে। অনেককে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। গত বছরের আগস্টে মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসার পর বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে আর কোন লোক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নিবো না।’ তারপর সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। 

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন সময় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন এখন সিন্ডিকেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কেন?

মাননীয় মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বর্তমান সরকারের শুরুতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বলেছিলেন, সিন্ডিকেট হবে না। তখন মালয়েশিয়াও বলছে সিন্ডিকেট হবে না। বায়রাও বলছে সিন্ডিকেট হবে না। তারপর তিনি  কিন্তু এবার মালয়েশিয়া যাওয়ার পর তার সুর পরিবর্তন হয়ে গেল। সিন্ডিকেটের পক্ষে তিনি ওকালতি শুরু করলেন।  তিনি সেখানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আমি সেখানে ছিলাম না। কিন্তু পরে শুনেছি, ৩৫টি কোম্পানির একটি তালিকা তিনি মাহাথির মোহাম্মদের হাতে দিয়েছিলেন।

ওই তালিকা কি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন?

না। মাহাথির মোহাম্মদ তালিকাটি ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, আমরা আর কোন সিন্ডিকেট করব না। আমরা চাই কম অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশি কর্মীরা আসুক। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলছেন, যদি আপনারা সিন্ডিকেট কনসেপ্ট থেকে না সরে আসেন তাহলে আমরা লোকই নিব না। তাদের শ্রমমন্ত্রী রাজি হয়েছেন এই শর্তে যে, অভিবাসন ব্যয় কমাতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি আনতে হবে।

তাহলে শেষ পর্যন্ত কী ঠিক হয়েছে? মালয়েশিয়ার বাজার কি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে?

আমাদের মাননীয় মন্ত্রী স্পষ্ট করছেন না যে সিন্ডিকেট হবে, নাকি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এটা নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বায়রার দ্বন্দ্ব, আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। নাচতে নেমে যদি ঘোমটা দেন তাহলে তো হবে না। তিনি যদি সিন্ডিকেট চান, তাহলে সরাসরি সবার সামনে বলুক কেন সিন্ডিকেট চান? আর যদি না চান, তাহলে সেটিও বলুক যে, গতবার সিন্ডিকেটে কী কী ক্ষতি হয়েছে। মালয়েশিয়াতে এখনো এক লাখ লোক বেকার। তারা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার রিঙ্গিত করে জমা দিয়েছে বৈধ হওয়ার জন্য। তারা টাকাও ফেরত পায়নি, পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয়নি। তাদের নিয়মিতও করা হচ্ছে না।  এক লাখ মানুষ যদি ১০ থেকে ১২ হাজার রিঙ্গিত করে দেয় তাহলে কত হয়? এই জিনিসগুলো মন্ত্রী মহোদয় পরিষ্কার করছেন না। তিনি কি চান আমি জানি না। আমি শুধু জানি সিন্ডিকেট হলে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যাবে। চার থেকে পাঁচটা ধাপ তৈরি হবে। প্রত্যেক ধাপেই টাকা দিতে হবে।

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নতুন নিয়মে কর্মীদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি কতটা নিশ্চিত হচ্ছে?

মন্ত্রী মহোদয় যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেডিকেল চেকআপ করাতে চাচ্ছেন, আমরা সেটা চাচ্ছি না। কারণ যে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। এখান থেকে মেডিকেল করে গেলে আবারো মালয়েশিয়া গিয়ে মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। কারণ সে দেশের সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে মানবে না। আমরা চাই কর্মীর একবার মেডিকেল চেকআপ হবে। এটা বাংলাদেশে। মালয়েশিয়া গিয়ে আর প্রয়োজন নেই। তাই বিতর্ক নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করতে হবে। আমরা চাচ্ছি ইন্সুরেন্স থাকবে। কেউ যদি মারা যাক বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হোক, সে যেন বীমার সুবিধাটা পায়। অভিবাসন ব্যয় যেন কোনোভাবেই এক লাখ ৪০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি না হয়। সব মিলে সর্বোচ্চ খরচ হবে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। মন্ত্রী মহোদয় নাকি বলেছেন, তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হবে। এত কেন লাগবে আমি বুঝি না। এসব বিষয় উল্লেখ করে আমি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বরাবর লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। সেখানে কর্মীদের অভিবাসন ব্যয়, তাদের সুরক্ষাসহ নানা বিষয়ে ২৪টি বিষয় উল্লেখ করেছি।

এই প্রস্তাবনায় কী উল্লেখ ছিল?

আমাদের কর্মীদের স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ দিতে হবে। সেখানে মেডিকেল খরচ দিতে হবে। অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে। তাদের থাকার জন্য ভালো জায়গা দিতে হবে। এগুলো সবই আমাদের চাওয়া। আমরা তো পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, বা গরু, ছাগল, হাস, মুরগি, পাঠাচ্ছি না। আমরা মানুষ পাঠাচ্ছি।  হিউম্যান রাইটস বলে যে বিষয়টি আছে সেটি সুরক্ষিত হতে হবে। শ্রমিক হিসেবে তাদের নিরাপত্তা এবং অধিকারসহ সব বিষয় নিশ্চিত না করে বাংলাদেশ থেকে একটি মানুষকেও যেন পাঠানো না হয়, এটাই আমাদের দাবি। 

ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো জিরো মাইগ্রেশন কস্টে কর্মী পাঠাচ্ছে আমরা কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতে পারছি না কেন?

ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া জিরো মাইগ্রেশন কস্টে কর্মী পাঠাচ্ছে। আমাদের এত টাকা খরচ করে কেন শ্রমিক পাঠাতো হবে? যে কোম্পানির শ্রমিক দরকার, যার ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক দরকার সে টাকা দিয়ে শ্রমিক নিয়ে যাবে। মেডিকেল খরচসহ শ্রমিকের সব খরচ মালিক বহন করবে। কারণ শ্রমিক তার দরকার। আর আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে, একজন শ্রমিকের অভিবাসন ব্যয় এমন হওয়া উচিত যেন তিনি তিন মাসের বেতন দিয়ে তা তুলতে পারেন। এর বেশি নয়। অথচ আমাদের এখানে কর্মীরা যে টাকা খরচ করে যান, তিন  মাস কেন, তিন বছরেও তা তুলতে পারেন না। অনেকের পাঁচ বছর লেগে যায়।

(ঢাকাটাইমস/১৭নভেম্বর/এইচএফ/জেবি)