প্রতিটি দপ্তরে একজন শাহাদত কবির প্রয়োজন

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ১০:২৬

রেজাউল করিম
আলোচিত কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন কবির (ফাইল ছবি)

দেশকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন কাজের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা। প্রয়োজন জবাবদিহিতা ও সৃজনশীলতা। এমন কর্মবীরদের পথচলা হয় সহজ ও সফল। তাই প্রতিটি দপ্তরে এমন সৃজনশীল ব্যক্তিদের বড়ই প্রয়োজন, যাদের কার্যক্রমে নিজ দপ্তর ক্রমান্বয়ে পুরো দেশ লক্ষে পৌঁছাবে। এরকম একজন মানুষ শাহাদত হোসেন কবির। যিনি তার নিজ দপ্তরকে ভিন্নভাবে পরিচিত করেছেন সারাদেশে।

২৬তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে আড়াই বছর শিক্ষকতা করেন। ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুনরায় প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরের দিকে প্রথমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসনে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১১ সালে বদলি হয়ে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসেন। চার মাস পরেই জয়পুরহাট থেকে ফের বদলি হয়ে যোগ দেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে।

২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে রাজশাহীর পবা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড হিসেবে যোগ দেন। শুরু হয় তার সৃজনশীলতা। দু-বছর পবাতে এসিল্যান্ড হিসেবে কাজ করেন শাহাদত কবির। এই দু-বছর কাজ করে তৈরি করেন ‘মাটির মায়া’। ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ও দ্রুত সেবা দিতে ‘মাটির মায়া’ নামে উদ্যোগটি নিয়েছিলেন সৃজনশীল এই কর্মকর্তা। ভূমি অফিসে একটি টিনশেট বিল্ডিং তৈরি করে নাম দেন মাটির মায়া। যেখানে ভূমি সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ বিশ্রাম করতেন। এরপর উদ্যোগটি গণমাধ্যমে উঠে আসায় দেশের প্রতিটি ভূমি অফিসে শাহাদত হোসেনের সেই সেবা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পবার সেই ‘মাটির মায়া’ এখন সারাদেশে। ভূমি কর্মকর্তাদের কেমন হতে হয় শিখিয়েছেন শাহাদত কবির।

সম্প্রতি তাকে নিয়ে প্রথম আলোর ধারণকৃত ভিডিও চিত্র ছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওই দুই বছরের পবা উপজেলার প্রতিটি মানুষ শাহাদত কবিরের কার্যক্রমে সন্তষ্ট। তিনি সাধারণ মানুষকে শিখিয়েছেন ভূমি রেজিস্ট্রার, খাজনা, খারিজ, পরচানামার জটিল বিষয়গুলো। ভূমিসংক্রান্ত নানান বিষয় জানাতেন তিনি। জমির খারিজ করতে সরকারি খরচ কত লাগে সাধারণ মানুষকে অনায়েসে বলতেন তিনি। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তারা জমি খারিজ করতে অধিক টাকা চাইলে শুধু সরকারি ফি জমা দিয়ে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে সরাসরি খারিজ করতে সমাজের সাধারণ মানুষদের পরামর্শ দিতেন। মানুষের বসার জায়গা, হেল্পডেস্ক, নাগরিক সনদ, উন্মুক্ত গণশুনানি, অফিসের ওয়েবসাইট ইত্যাদি সেবামূলক কাজে এগিয়ে গেছে উপজেলা ভূমি অফিস।

মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য ওই ভূমি অফিসে ঢুকতে গেলেই দালালদের খপ্পরে পড়তে হতো। দেশে মানুষে মাঝে একটি বড় সমস্যা ভূমি বিরোধ। ভূমি অফিসে কাজের দীর্ঘ সময় লাগার কারণেও এই বিরোধের নিষ্পত্তি সহজে হয় না। পবা ভূমি অফিস সেই জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। এক বছর ঘুরে যে কাজ হয়নি, এক দিনে বা এক সপ্তাহেই তা হয়ে যেতো। তার জন্য বাড়তি কোনো টাকা দিতে হতো না। তিনি শিখিয়েছেন ভূমি অফিস সাধারণ মাসুষের অফিস। এখানে ঢুকতে অনুমতি লাগে না। মাটির মায়া দেশের অধিকাংশ উপজেলার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে কতটা পরিশ্রম করছেন সেটা তার কর্মস্থলগুলো পরিদর্শন করলে স্পষ্ট হয়ে যায়।

প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে 'মাটির মায়া' নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা রেদওয়ান রনি। সৃজনশীল মানুষটিকে নিয়ে প্রথম আলোর ব্যতিক্রমী আয়োজনে প্রশংসার দাবিদার প্রথম আলো। শাহাদত কবিরের ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ করায় ধন্যবাদ ঢাকাটাইমসকে।

২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর দেলদুয়ার থেকে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় বদলি করা হয় তাকে। দুই মাস দায়িত্ব পালনের পর ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এখান থেকেও বিদায়। দেলদুয়ারে থাকা দুবছরে তিনি ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন। একজন গ্রাম পুলিশ থেকে শুরু করে উপজেলার বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য তার অফিস ছিল উন্মক্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষের দেয়া কোনো সমস্যার পোস্ট পেয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতেন তিনি। যারা সরাসরি সমস্যা কথা জানাতে পারতেন না তাদের জন্য তিনি সমস্যা জানতে চেয়ে উপজেলা প্রসাশন ও তার ব্যক্তিগত এফবি আইডি থেকে পোস্ট দিতেন। পুরো উপজেলার সার্বিক সমস্যা জানতে সব পেশার মানুষদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে উন্মক্ত আড্ডার আয়োজন করতেন।

অল্প সময়ে পাল্টে দিয়েছিলেন দেলদুয়ার উপজেলার সার্বিক চিত্র। বিশেষ করে দেলদুয়ার উপজেলায় সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় এক দিনে আড়াই লক্ষ গাছ লাগিয়ে তিনি আরও এক দফা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে উঠেন। সড়কের পাশের গাছগুলো এখনও শাহাদত কবিবের স্মৃতি বহন করছে। মাদক, বাল্যবিবাহ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি দূরীকরণের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ উন্নয়ন, খেলাধুলা, যুব উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। তবে তিনি চলে যাওয়ার পর তার অসমাপ্ত কাজগুলো আর বাস্তবায়ন হয়নি।

অবশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হলেন শাহাদত হোসেন। এখানেও অফিস-আর বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তিনি। সৃজনশীলতা বেরিয়ে আসছে স্বাস্থ বিভাগেও। অনেকটা কর্মদিবস তার সদিচ্ছাতে থাকতে হচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতাগুলো পরিদর্শনে। তুলে আনছে মফস্বলের হাসপাতালগুলোর বাস্তব চিত্র।

কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার নিভৃত পল্লী থেকে উঠে এসেছেন ‘মাটির মায়া’র সেই বহুল আলোচিত এসিল্যান্ড শাহাদত হোসেন কবির। ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের বড়চারা গ্রামে শাহাদত হোসেন কবিরের জন্ম। তার পিতা মো. মোজাম্মেল হক এবং মাতার নাম শামসুন্নাহার। তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। মোজাম্মেল হক তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। শাহাদত কবির নিজ গ্রামের বড়চারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর বাজিতপুরের ভাগলপুর আফতাব উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে থেকে থেকে ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) এবং পরে একই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে এমএ পাস করেন। অতপর ২৬তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডার ও ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিতে যোগদান করেন।

শাহাদত কবিরের মতো সৃজনশীল কর্মকর্তারা তার নিজ দপ্তরকে পরিচিত করতে পারে। এগিয়ে নিতে পারে নিজেকে। এগিয়ে নিতে পারে দেশকে। ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে প্রমাণ দিয়েছেন। ইউএনও হিসেবেও প্রমাণ দিয়েছেন। এদের মতো কর্মকর্তার বড়ই প্রয়োজন। প্রতিটি দপ্তরে অন্তন একজন করে শাহাদত কবির প্রয়োজন। যাদের মাধ্যমে দেশ দ্রুত লক্ষে পৌঁছাবে।

লেখক: সংবাদকর্মী