রাজধানীতে বাসে চাঁদাবাজি

একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে এনায়েত উল্লাহ!

সিরাজুম সালেকীন
| আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৪৫ | প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৫১

রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। এর নিয়ন্ত্রণ যারা করেন, তারা গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। অনুসন্ধানে নাম এসেছে বেশ কজনের। তারা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে দায় চাপান এক-অপরকে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন তো বললেন, পরিবহন খাত এখনো বিএনপির নেতাদের নিয়ন্ত্রণে।

পরিবহন খাত পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ খানের কাছে জিম্মি বলে দাবি করছেন এই চক্রেরই নেতারা। তারা একসময় এনায়েত উল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এয়ারপোর্ট মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল ওরফে টুপি বাবুল, সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগের সদস্যসচিব ইসমাইল হোসেন বাচ্চু। এ ছাড়া আরও যারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে তারা হলেন সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুব, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক তপন, তথ্য সম্পাদক চান্দালি খন্দকার, কোষাধ্যক্ষ খোকন। প্রত্যেকেই পরিবহন খাত থেকে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় বিপুল সম্পদের মালিক।

বাস মালিকদের তথ্যমতে, সকালে বাস বের হলেই ঢাকা মালিক সমিতি ও বিভিন্ন রুটের মালিক সমিতিকে (গেট পাস-জিপি) হিসেবে প্রতি গাড়ি বাবদ ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা দিতে হয়। এই চাঁদা না দিলে রাস্তায় বাস চলতে দেওয়া হয় না।

পরিবহন শ্রমিক ঐক্যলীগের পদে থাকা এক নেতা নাম প্রকাশ না শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের পরিবহন খাত এনায়েত উল্লাহর কব্জায় জিম্মি। এনায়েত উল্লাহ গত জোট সরকারের সময়েও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। বিএনপি নেতা থেকে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ভোল পাল্টে নব্য আওয়ামী লীগ সেজে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সারাদেশে চাঁদাবাজি করছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তার ধানমন্ডিতে একটি ও গুলশানে কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। পূর্বাচল সংলগ্ন ৩০০ ফিট রাস্তার পাশে প্রায় শত বিঘা জমি, সারাদেশে এনা পরিবহনের প্রায় ৮০০ গাড়ি রয়েছে। প্রতিটি গাড়ির মূল্য এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সিলেটে কয়েক বিঘা জমির ওপর এনা পরিবহনের নিজস্ব গাড়ির টার্মিনাল।

ময়মনসিংহ, ভালুকায় রয়েছে ২৩ বিঘা জমির ওপর এনা ফুডস নামের বিশাল ফ্যাক্টরি। মালয়েশিয়া ও কানাডায় রয়েছে সেকেন্ড হোম। ময়মনসিংহে প্রায় শত বিঘা জমি। মিরপুরে বহুতল ভবনের সাতটি বাড়ি। কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় আবাসিক হোটেল। হবিগঞ্জ-মাধবপুরে কয়েক বিঘা জমির ওপর হোটেল। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে খন্দকার ফুড নামে একটি বিশাল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। মহাখালীতে নিজস্ব জায়গায় এনা পরিবহনের বিশাল অফিস।

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নীচপনুয়া গ্রামের বাসিন্দা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ১৯৮৪ সালে গুলিস্তান-মিরপুর রোডে একটি মিনিবাস দুজনে পার্টনারে কিনে পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৯২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এনায়েত উল্লাহর উত্থান শুরু হয়। তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র মীর্জা আব্বাস ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি হলে এনায়েত উল্লাহ সেক্রেটারি হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আঁতাত করে স্বপদে বহাল থাকেন। মাঝে আবার বিএনপির সঙ্গে ছিলেন। সবশেষ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবার দলে ঢুকে পড়েন তিনি।

এভাবে পরিবহন খাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা ধরে রেখেছেন এনায়েত উল্লাহ খান। প্রতিদিন মালিক সমিতির নামে চাঁদা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে এনায়েত উল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এখন এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু শুদ্ধি অভিযান চলছে এই সুযোগে আমরা চাঁদা তোলা বন্ধ করেছি। কারণ আগে বন্ধ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।’ চাঁদা বন্ধে চারটি ট্রান্সফোর্স করা হয়েছে, যেখানে ৩০-৪০ জন লোক কাজ করছে, মালিকেরা কাজ করছে বলে দাবি করেন তিনি।

কিন্তু ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে চাঁদা বন্ধ না হওয়ার তথ্য মিলেছে মালিক-শ্রমিকদের কাছ থেকে। এমনকি পরিবহন খাত থেকে অবৈধ আয়ের অভিযোগ আছে এমন ব্যক্তিরাও এর সত্যতা জানান। সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগের সদস্যসচিব ইসমাইল হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি বন্ধ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন খন্দকার এনায়েত। শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে সেটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল ঠিক। কিন্তু আবার শুরু হয়েছে।’

পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ এখনো বিএনপি-জামায়াত নেতাদের হাতে বলে দাবি করে ইসমাইল হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘তারা সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী ও ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও রয়েছেন।’

কিছুদিন চাঁদা তোলা বন্ধ থাকলেও তা আবার শুরু হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, ‘এটা নামে মাত্র বন্ধ হয়নি। যারা বলছে তারা মনগড়া কথা বলছে। একটা ভালো কাজ করতে গেলে সমালোচনা হতেই পারে।’

তবে সরকার নির্ধারিত চাঁদা তারা নিচ্ছেন বলে দাবি করে এনায়েত উল্লাহ খান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাদের সমিতির টাকা তো ৪০ টাকা। এটা সরকার থেকে নির্ধারিত।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে এখন কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

বাচ্চুর যত সম্পদ

শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হওয়ার কারণে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল ইসমাইল হোসেন বাচ্চুর। চাঁদার টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে বাচ্চু তার বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। বাচ্চু বর্তমানে সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগের সদস্যসচিব। ফুলবাড়িয়া শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে শতাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে প্রচার আছে। চাঁদাবাজির কারণে ২০১৭ সালে তাকে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা ছাড়াও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধান বলছে, এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে চাঁদার টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে বাচ্চু তার অনুসারী বেশ কয়েকজন নিয়ে গঠন করেন সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগ। তাছাড়া নিজের নিয়ন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু পরিবহনের দুটি বাস রাস্তায় নামান।

শ্রমিক ইউনিয়নে থাকাকালে রাজধানীর বেইলি রোডে তিন কোটি টাকার একটি ফ্লাট ও দয়াগঞ্জে এক কোটি টাকা সমমূল্যের ফ্লাট কেনেন। মেয়ের জন্য ধানমন্ডিতে কেনেন তিন কোটি টাকার একটি ফ্লাট। ফুলবাড়িয়া গড়ে তোলেন মার্কেট। সেখানে ২০টির বেশি দোকান রয়েছে। বংশালে তার একাধিক বাড়ি রয়েছে বলে সূত্র জানায়।

এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচরে ছয়তলা একটি বাড়ি তৈরি করেছেন বাচ্চু। গ্রামের বাড়ি ফেনীতে গড়ে তুলেছেন বিশাল মার্কেট। সেখানে অর্ধশতাধিক দোকান ভাড়া দিয়েছেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে বাচ্চুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে পদ থেকে সরে এসেছি। আর শ্রমিক ইউনিয়ন তো চাঁদা ওঠায় না। চাঁদা তোলে মালিকরা।’

অঢেল সম্পত্তি ও বঙ্গবন্ধু পরিবহনে বাসের ব্যবসা বিষয়ে জানতে চাইলে বাচ্চু বলেন, ‘এটা আমার না, টুপি বাবুলের ব্যবসা। আমি নিয়ন্ত্রণ করি শ্রমিকদের।’

টুপি বাবুল ও অন্যান্য

বাচ্চুর বাসের মালিকানা না থাকার দাবি ঠিক নয় বলে জানান বঙ্গবন্ধু পরিবহনের চেয়ারম্যান টুপি বাবুল। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে বাচ্চুর দুটি বাস রয়েছে। তিনি কেন তা অস্বীকার করেছেন তিনিই জানেন।’

এদিকে এয়ারপোর্ট মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল ওরফে টুপি বাবুলের বিরুদ্ধেও রয়েছে পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ। এনায়েত উল্লাহর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত টুপি বাবুল বঙ্গবন্ধু পরিবহনের আড়ালে বিভিন্ন মালিকের বাস রাস্তায় নামিয়ে চাঁদাবাজি করছেন বলে বিভিন্নœ সূত্র জানায়।

বাবুল তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কেউ অভিযোগ দিলেই তো হয়ে না। খোঁজ-খবর নিলে সব জানতে পারবেন।’

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বেশ কয়েকজন অবৈধভাবে বহু টাকার মালিক হয়েছেন বলে জানান বাবুল। তাদের মধ্যে আছেন সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুব, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক তপন, তথ্য সম্পাদক চান্দালি খন্দকার, কোষাধ্যক্ষ খোকন।

বাবুলের ভাষ্যমতে, ‘শুভযাত্রার এমডি ফয়সাল কবির বর্তমানে ফুলবাড়িয়ার ক্যাশিয়ার পদে আছেন। তিনিও অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এনায়েত উল্লাহর গ্রুপে থাকার কারণে। প্রতিটা টার্মিনালেই রয়েছে খোন্দকার এনায়েত উল্লাহর নিজস্ব লোক। তারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে।’

ওপরে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন বাবুল, তাদের মধ্যে এনায়েত উল্লাহ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এনায়েত উল্লাহর দাবি, মালিক সমিতির নেতা হওয়ায় তার সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক। তিনি বলেন, ‘এখানে কেউ আমার আস্থাভাজন না। কেউ খারাপ কিছু করলে এই দায়িত্ব তো আমার না।’

অবৈধভাবে অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনায়েত বলেন, ‘এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এত দিন এসব কথা আসলো না, এখন কেন এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে?’

(ঢাকাটাইমস/১৯নভেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপির নিন্দা 

কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার ব্যবসায়ীদের গাবতলিতে স্থানান্তর করা হবে

বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই পরাজিত হয়েছে: মজনু

বোনের পর চলে গেল শিশু তাওহিদও, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১১

রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের লিডারসহ ২০ সদস্য আটক, অস্ত্র উদ্ধার

‘আর সহ্য করতে পারছি না’ বলেই সাত তলা থেকে লাফিয়ে তরুণের মৃত্যু

এনএসআই’র নতুন পরিচালক সালেহ মোহাম্মদ তানভীর

বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য ১৬৫০ টন পেঁয়াজ কিনবে ভারত সরকার

যারা আমার মায়ের হাতে খাবার খেত, তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে: প্রধানমন্ত্রী

ঢাকার ৫৫০ বিআরটিসির বাস ঈদে সারাদেশে চলবে

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :