দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাবি

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১১ | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১৬

ডক্টর ফরিদ আহমেদ

সাম্প্রতিক সময়ে খবরের কাগজে দুর্নীতির নানান চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী অঙ্গীকার ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ’ এজেন্ডাটি সবার সামনে নিয়ে আসেন এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন। দেশের মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় দারুণ খুশি ও আশান্বিত হয়। তারই সূত্রধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁদের লক্ষ্য জাহাঙ্গীরনগরকে দুর্নীতি মুক্ত করা। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম প্রতিদিন সংবাদ দিয়ে নানান সহযোগিতা করে আসছে। আমরা এ সময়ে দেখলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষনেতা শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন চাঁদাবাজির। মাননীয় প্ৰধানমন্ত্ৰী কাল বিলম্ব না করে শোভন-রব্বানীকে বিদায় করে দিলেন ছাত্রলীগ থেকে। এরপর শুরু হলো যুবলীগে শুদ্ধি অভিযান।  বাংলাদেশের মানুষ খুব খুশি হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযান দেখে।

এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা আরও অনুপ্রাণিত হলো। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা নিয়ে দুর্নীতির সম্পর্ক জাতির সামনে নিয়ে এলো। এর মাঝে অভিযোগ এলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দুর্নীতি নিয়ে।  সবাই আশা করছিলো শুদ্ধি অভিযান বিশ্ববিদ্যালয়েও হবে। জনগণ দেখলো সরকার বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দ্রুত অব্যহতি দিতে। জনগণ আরো আশান্বিত হলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ভাবখানা এমন যে ওনাকে দুর্নীতির দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। কারণ, তিনি একজন প্রথম নারী উপাচার্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শোভন-রব্বানীকে ধরিয়ে দিয়ে। শোভন-রাব্বানীর দোষ সবাই দেখলো, কিন্তু উপাচার্য কোনো কিছু গোপন করে নিজের দোষ ঢেকেছেন কিনা সেটা কেউ ভেবে দেখলো না। কিন্তু নাছোড় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলনকারীদের দাবি তাকেও সরে দাঁড়াতে হবে।

আন্দোলনকারীরা এখন উপাচার্যেরও বিচার চায়। আর এখানেই বিপত্তি। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো অনেক। সেগুলোর সমাধান জাহাঙ্গীরনগর চিন্তা করেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে দিতে। কিন্তু সে সুযোগ জাহাঙ্গীরনগর হারায় যখন সরকার তাঁকে দ্বিতীয়বার বিনা নির্বাচনে নিয়োগ দেয়। আর তখনি তাঁরা আন্দোলনে নামে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করতে। কিন্তু নানা কারণে সেটা সফল হয়নি। নানা কূট কৌশল অবলম্বন করে উপাচার্যকে একটি মহল ক্ষমতায় রেখে অনেক কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেসব কৌশল ব্যর্থ হয়ে যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” যদি নীতি হয়, তাহলে যে উপাচার্যকেও সরে যেতে হয়। কারণ, যে আলোচনাকে কেন্দ্র করে শোভন-রাব্বানীর বিদায়, সে আলোচনায় উপাচার্য একটি পক্ষ।  ছাত্রলীগ নেতার দাবি উপাচার্য তাঁদের টাকা দিয়েছেন পরিবারের মাধ্যমে। আর উপাচার্য নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছেন বিষয়টিকে লুকাতে গিয়ে। তিনি একবার বলেছেন শোভন-রাব্বানীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়ে। এর পরে বলেছেন টাকা ভাগের আলোচনা করতে এসেছিলো তারা।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ ছিল সেগুলো এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেছে।  উপাচার্য সব কিছু সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জেগেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। সুতরাং, এটাকে কোনো প্রকার রং না দিয়ে বরং সোজা পথে চলা আমার মতে ভালো। নতুন অভিযোগ যোগ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে। নিজের ব্যর্থতা, অয্যোগতা, ও দুর্নীতির অভিযোগ ঢাকতে তিনি ছাত্র-কর্মচারী ব্যবহার করেছেন এবং ছাত্রলীগের নামে স্লোগান দিয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো সনদ দেয়া নেতাকে দিয়ে, এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে। ছাত্র-শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে সেই সব ছাত্র-কর্মচারী যাঁরা বিভিন্ন সময়ে সুবিধাভোগ করেছে। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুলিশের সামনে ঘটেছে।  উপরন্ত, উপাচার্য এটিকে গণঅভ্যুত্থান অভিহিত করেছেন। রাঙা যেমন আমাদের অনুভূতিকে আঘাত করেছেন, তেমনি তিনি সকলকে অপমাণিত করেছেন। রাঙ্গাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে কিন্তু বহাল আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। রাঙ্গার এখন এরশাদ নেই তবে উপাচার্যের আছে শক্তিধর অনেক ব্যক্তি। আমার মনে হয়েছে মাননীয় প্ৰধানমন্ত্রী যদি উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীদেরকে কাছে টেনে নেন, তাহলে তিনি যে মহান অভিযাত্রা শুরু করেছেন দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, তা সফল হবে। আন্দোলনকারীদের মাঝে যাঁরা আছেন তাঁদের কারো কোনো অভিসন্ধি নেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

আজ আপনি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছেন, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ, বই দিয়েছেন।  বৃত্তি দিচ্ছেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সফল হয়েছেন, শিশুদের স্কুলে খাবার দেবেন, পদ্মা সেতু এখন নিজের টাকায় বাংলাদেশ করছে সেই মহান গৌরব আপনাকে যেমন মহিমান্বিত করে। তেমন আমাদেরকে দেশপ্রেমে অনুপ্রেরণা যোগায়।  আমরা আন্দোলন করি আপনাকে সহযোগিতা করতে।

আন্দোলনকারীরা একটি ঢিল মারেনি বা কাচ ভাঙেনি।  আমাদের আন্দোলন আপনার অনুপ্রেরণায়। আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক মার খেয়েছে, কিন্তু তারা প্রতিশোধ নেয়নি। গান্ধীর “অহিংস পরম ধর্ম” তাদের আদর্শ ছিল এ আন্দোলনে। আমরা আপনার এজেন্ডা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে কর্মী। বাংলদেশ আজ যে উন্নয়নের মহাসড়কে তার গৌরবময় অংশীদার হতে চাই আমরা। বঙ্গবন্ধুই আমাদের আদর্শ পুরুষ। জয় বাংলাই আমাদের শ্লোগান।আমরা আপনার স্বপ্ন ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়ার অভিযাত্রায় সহযাত্রী হতে চাই ।আমাদেরকে আপনার সঙ্গে নিবেন কি?

পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে বলে যারা সমালোচনা করেছিল তারা আমাদের দুটি উপকার করেছে। প্রথমতঃ বিশ্বব্যাংকের গোলামী থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি।  আর দ্বিতীয়টি হলো বাঙালি যে সাহসী জাতি সেটা আপনি প্রমাণ করেছেন। আজ আপনার নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। তেমনিভাবে জাহাঙ্গীরনগর আপনাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো শক্তভাবে দাঁড়াতে শক্তি যোগাচ্ছে। যাতে করে উন্নয়ন ঘুন বা উই পোকায় না খেতে পারে সেজন্য আমরা লড়ছি। আমরা কোনো ভাগের জন্য আন্দোলন করছি না। আমাদের জীবন বৃত্তান্ত আপনি যেকোনো এজেন্সির মাধ্যমে পরীক্ষা করতে পারেন কিন্তু !

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র করে সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।  আল্লাহর কাছে সেই শ্রেষ্ঠ যে পরহেজগার। আর এই যে নাস্তিক-আস্তিক, শিবির-বাম এগুলো মানবসৃষ্ট। মানব সৃষ্ট হলেও আমরা কি পারি কারো নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে? বঙ্গবন্ধু “রাসেল” নামটি নির্বাচন করেছিলেন তাঁর নাস্তিক দর্শনের জন্য নয়, তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। আমরা আন্দোলনকারীরা অধিকাংশ বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বিশিষ্ট দার্শনিক গোবিন্দ দেব এর ছাত্র। আমরা বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক রাসেলের অনুসারী। আমাদের গায়ে শিবির তকমা দিয়ে যারা আপনাকে বিভ্রান্ত করছে তাঁরা কিভাবে শিবির নিয়ন্ত্রিত সেটা শুনবেন কি?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাদের মাঝে আসুন, সত্য কি জেনে যাবেন। আপনি ১১ বছরেও জাহাঙ্গীরনগর আসলেন না? অথচ পাস দিয়ে কতবার গেছেন! যখন বিরোধীদলে ছিলেন সেই জাহাঙ্গীরনগরকে আপনি সুযোগ পেলে দেখতেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে স্বাগতম!

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।