আমদানি মূল্যের ৬ গুণ বেশি ‘লুট’ পেঁয়াজে

রহমান আজিজ ও জহির রায়হান
| আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০১৯, ২২:০১ | প্রকাশিত : ২০ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৫১

দেশে প্রতি মাসে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে পেঁয়াজের চাহিদা দুই লাখ টনের মতো। গত আড়াই মাসে বিভিন্ন দেশ শুধু আমদানিই হয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার টন। সেই হিসাবে দেশে পেঁয়াজের ঘাটিত থাকার কথা নয়। তা ছাড়া নভেম্বররের মাঝামাঝি থেকে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসার সময়। কিন্তু ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের হুজুগে মজুত পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছে আমদানি মূল্যের চেয়ে অন্তত সাত গুণ বেশি দামে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট একটি বিভাগের গত আড়াই মাসের আমদানি পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ওই আমদানি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই সময়ে ভারত, মিয়ানমার, মিসরসহ ১১টি দেশ থেকে মোট ৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৮ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। এর আমদানি মূল্য ১ হাজার ৬৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ৪২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের গড় আমদানি দাম পড়ে প্রায় ৩৫ টাকা।

আমদানিকৃত পেঁয়াজ মুনাফাসহ খুচরা পর্যায়ে বিক্রির দাম কত হতে পারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভোক্তা পর্যন্ত একটি হিসাব তুলে ধরেন ঢাকা টাইমসকে। তার হিসাবমতে, পেঁয়াজের আমদানি খরচ যদি ৩৫ টাকা হয় তবে এর সঙ্গে ১০ শতাংশ শুল্ক বা ৩.৫ টাকা যোগ করে দাম পড়বে ৩৮.৫ টাকা। এর সঙ্গে অভ্যন্তরীন খরচ কেজিপ্রতি আরো ৩ টাকা ধরে কাওরান বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে এ পেঁয়াজের দাম পড়বে সবোর্চ্চ ৪১ টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর আগে পেঁয়াজের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি ঘোষণা দিলে দেশে পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। ৫০-৬০ টাকা কেজির পেঁয়াজ বাড়তে বাড়তে নভেম্বরের মাঝামাঝি তা ২৮০ টাকা ছোঁয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১৫০ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টন। মাসে চাহিদা দুই লাখ টনের মতো।

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী জানান, দেশের চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। গত বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ভালো হয়েছিল। কিন্তু আগাম বৃষ্টির কারণে কৃষকেরা সেই পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পারেনি বলে দাবি মন্ত্রীর। ফলে পেঁয়াজ সংকট হয়েছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ দেশে থেকে চার লাখ ৭২ হাজার ৫৭৮ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করে দেশের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে ২ দশমিক ৪ মেট্রিক টন, যার মূল্য দুই লাখ ৭৭ হাজার ৪৯৬ টাকা। চীন থেকে এক হাজার ১৩২ মেট্রিক টন, যার মূল্য চার কোটি চার লাখ ৫৪ হাজার ৫১৫ টাকা। মিসর থেকে তিন হাজার ৯৮০ দশমিক ৬৬ মেট্রিক টন, যার মূল্য নয় কোটি ৮৩ লাখ ১৯ হাজার ৩০৮ টাকা।

ভারত থেকে এক হাজার দুটি চালানে চার লাখ ৩১ হাজার ২৪ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসে, যার মূল্য ১ হাজার ৪৮৩ কোটি ৮৬ লাখ ১২ হাজার ৯১৯ টাকা। জাপান থেকে দমশিক ছয় মেট্রিক টন, যার দাম ৬৮ হাজার ২৬৮ টাকা।

৫১৪টি চালানে মিয়ানমার থেকে ৩৬ হাজার ৬২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসে, যার মূল্য ১৫৫ কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৩ টাকা। পাকিস্তান থেকে দুটি চালানে ১৩৯ মেট্রিক টন আসে, মূল্য ৩৫ লাখ ৮৩ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। থাইল্যান্ড থেকে আসে ২১ দশমিক ৬৪ মেন্ট্রিক টন, মূল্য ২৮ লাখ ৬৪ হাজার পাঁচ টাকা। তুরস্ক থেকে দুটি চালানে ৭৩ লাখ ৯১ হাজার ৭২৬ টাকামূল্যের ২৮৬ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসে ২ দশমিক ৪১ মেন্ট্রিক টন পেঁয়াজ, যার মূল্য ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৭২২ টাকা।

সাধারণত বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণ হয় পর্যাপ্ত সরবরাহের ঘাটতির কারণে। সরবরাহ সংকটের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করেছে। ভোক্তাদের পকেট কেটেছে। যারা অবৈধ উপায়ে মজুদ রেখে কৃত্রিমভাবে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি ও দাম বাড়িয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও মনে করেন, বাজারে সরবরাহ ঘাটতির কারণেই দাম বেড়েছে।

তিনি বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার আগে যেগুলোর এলসি খোলা হয়েছে তার সবগুলো তখনই এসেছে কি না জানি না। কিন্তু এটাও ঠিক যে দামে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার সুযোগেই দাম বেড়ে গেছে।’

একই সঙ্গে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের মজুত ও কৌশলের কথা বলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মজুদ করে যে দাম বাড়ায়নি, তা নয়। এ ক্ষেত্রে তাদেরও কৌশল ছিল। সেজন্য সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো আগেই সতর্ক থাকলে বাজারে এত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো না। পেঁয়াজের দামের এত উল্লম্ফন হতো না।’ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যারা আগেই আমদানি করে রেখেছেন, সংকটের সময় তারা অধিক লাভ করতে পেরেছেন। তারা ভাগ্যবান। আবার দাম কমে গেলে তাদের লোকসানও গুনতে হবে। তবে মূল কথা হলো যারা মুনাফা করেছেন তারা যেন আয়করটা ঠিকভাবে পরিশোধ করেন। এটা এনবিআরকে দেখতে হবে।’

মুনাফা যা করার তা ব্যবসায়ীরা করে নিয়েছে মন্তব্য করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দাম আর বাড়বে না। কারণ দেশি পেঁয়াজ বাজারে এসে গেছে। পাতাসহ ৮০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে।’

(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :