দূষিত পানি শোধন ও দুর্গন্ধ দূর করবে অণুজীব

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:০৬ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৯, ১৮:৫৫

কাজী রফিক

মাছের প্রজনন সংক্রান্ত একটি প্রকল্প দেড় বছর আগে শুরু করেন অধ্যাপক ড. এস এম রফিকুজ্জামান। তিনি গাজীপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি এবং অ্যাকুয়াটিক এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক। প্রকল্পটি শুরু করেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়। কাজ করার সময় তিনি দেখেন, চিংড়ি চাষে খুব সমস্যা হচ্ছে। চাষিরা মাছগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। সমস্যাটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই গবেষক দেখলেন, মূল সমস্যা পানিতে। এখানে পানির গুণগত মান ঠিক নেই। তাই বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই আক্রমণ করছে। সমস্যা সমাধানের জন্য একটি জীববিজ্ঞানগত পদ্ধতির কথা ভাবলেন তিনি। চিংড়ি চাষের জন্য একটি ‘ব্যাকটেরিয়াল সলিউশন’ বা ‘অণুজীব’ তৈরি করলেন, যা পানির অন্যান্য গুণাগুণ ঠিক রেখে কাজ করে। গত দেড় বছরে এই পদ্ধতি সফলতা এনে দিয়েছে সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষিদের।

প্রকল্পে কাজ করার সময় অধ্যাপক রফিকুজ্জামানের চোখে ধরা পড়ে তার ক্যাম্পাসের পাশের একটি সমস্যা। যেখানে ক্যাম্পাসের পেছনের কিছু কারখানার বর্জ্য নালা দিয়ে বয়ে যায়। সেখানে প্রচুর গন্ধ হয়। সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে আবারও সেই ব্যাকটেরিয়াল সলিউশনের দিকেই ঝুঁকলেন এই গবেষক।

ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা সেখান থেকে ময়লা পানি নিয়ে এলাম। ওর মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল সলিউশন বা অণুজীব সমাধান নির্দিষ্ট মাত্রায় দিয়ে দিলাম। ২৪ ঘণ্টা পর দেখলাম পানির রং সাদা। নিচে যে ভারী দ্রব্য জমার কথা, সেটিও নেই। একেবারে ভেঙে ফেলেছে। গন্ধ তো একেবারেই নেই।’

‘আমরা পিএইচ চেক করলাম। এখানকার ফলাফলে আমরা দেখলাম পিএইচ নেমে যাচ্ছে। পিএইচগুলো একেবারে ভেঙে ফেলেছে, কিছু কিছু অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলাফলে আমরা অনেকটা আশাব্যঞ্জক হলাম।’

কারখানার বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করে কারখানা মালিকদের বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা এবং দণ্ড প্রদান করছে। কিন্তু কারখানার বর্জ্য পরিশোধনের পদ্ধতি ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অনেক কারখানাই এখনো সেই নীতির বাইরে অবস্থান করছে। সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছেন গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক। তবে গবেষণা এখনো বড় পরিসরে প্রয়োগের পর্যায়ে যায়নি।

এই গবেষণার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ বা সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। এমনকি কারো নির্দেশে তিনি এই গবেষণায় নামেননি। বরং কেবল দেশকে নতুন কিছু দিতে স্বউদ্যোগে এই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক বছর আগে শুরু করা এই প্রকল্পটি অন্যান্য গবেষণা কাজের ফুরসতে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

অধ্যাপক রফিকুজ্জামান বলেন, ‘কিছু কিছু গবেষণা আছে, যেটা প্রকল্প দিয়ে হয় না। বেসিক গবেষণার ক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে প্রকল্প হাতে নেওয়া সম্ভব না। সেখানে বলা যায় না কতটা সময় লাগবে বা আমি সফল হবো কি না। বেসিক গবেষণার মাধ্যমে একটা শর্ত হচ্ছে প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, আমি সফল হবো। তাই আমাদের দেশে বেশিরভাগ গবেষণা পিছিয়ে আছে। কারণ এই জায়গাগুলোতে ফান্ডিং অথরিটিরা একমত হয় না।’

কারখানার তরল বর্জ্য দুই ধরনের। একটি পয়েন্ট সোর্স, অপরটি অন পয়েন্ট সোর্স। কারখানা থেকে বের হওয়া প্রথম তরল বর্জ্যটিকে পয়েন্ট সোর্স বলা হয়। কারণ এক্ষেত্রে এই বর্জ্যরে সঙ্গে অন্য কোনো কিছু যুক্ত থাকার সুযোগ থাকে না। আর নন পয়েন্ট সোর্সের ক্ষেত্রে কারখানার বর্জ্য যখন একটি খাল বা নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন এর সঙ্গে অনেক ধরনের বর্জ্য বা যৌগ একত্রিত হয়।

খালের পানি নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করে সন্তুষ্ট হয়ে এবার তিনি নজর দিয়েছেন কারখানা থেকে সরাসরি বেরিয়ে আসা বর্জ্যরে দিকে। সম্প্রতি তিনি একটি কারখানায় কেমিক্যালযুক্ত ময়লা পানি তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট দেখতে গিয়েছিলেন। ওই কারখানা থেকে বের হওয়া প্রথম তরল বর্জ্যটি নিয়ে এসেছেন, যা নিয়ে কাজ করছেন।

রফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা কারখানা থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্যমিশ্রিত খাল বা নালার পানি নিয়ে কাজ করেছি। এবার সরাসরি কারখানার বর্জ্য পানি নিয়ে কাজ করছি। দূষিত বা কারখানায় ব্যবহৃত পানিতে কী কী উপাদান পাওয়া যাচ্ছে, ভারী দ্রব্য কী থাকছে, এই পানি কোথাও ব্যবহার করা যাবে কি না, খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারব কি না-এখন সেগুলোই দেখা হচ্ছে।’

এই গবেষণা পুরোপুরি জীববিজ্ঞাননির্ভর উল্লেখ করে গবেষক বলেন, ‘এখন আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। আমাদেরকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। আমার জানা মতে, দেশে অনেক বিজ্ঞানী এটা শুরু করেছে। তবে বিদেশে এটা নতুন নয়। আমরা চাচ্ছি পুরোপুরি জীববিজ্ঞান মেনে করতে। এখানে কোনো রসায়ন প্রয়োগ করছি না। পুরোপুরি জীববিজ্ঞানের ওপর ফোকাস রাখছি।’

গবেষণার পেছনে নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই জীববিজ্ঞানী বলেন, ‘আমার মূল চাওয়াটা হচ্ছে মানুষ ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাবে কিন্তু সে কোনো গন্ধ পাবে না। আমরা এই লিকুইড স্প্রে করে দিলে গন্ধ একেবারেই দূর হয়ে যাবে। মানুষ খালের পাশ দিয়ে যাবে, কোনো দুর্গন্ধ পাবে না। আমাদের পরিবেশে বাস্তব ব্যবহারের দিকে নজর দিতে চাই। বোঝাতে চাই এই অণুজীব কোনো ক্ষতি করছে না বরং উপকার করছে।’

নদী-খালের পানিতে অণুজীব প্রয়োগে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে

পয়ঃনিষ্কাশন খাল থেকে নিয়ে আসা পানিতে অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের প্রথম ধাপে সফলতা পেয়েছেন এই গবেষক। ভাবনা এবার প্রবহমান পানি নিয়ে। খালের পানি তুলে এনে পরিষ্কার করে সেটি ফের খালে ঢেলে দেওয়া দুঃসাধ্য। তাই কী করে প্রবহমান পানিতে অণুজীব প্রয়োগ করে সফলতা পাওয়া যায় সেই চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে প্রবহমান পানিতে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ উপকারী অণুজীব সমাধান (ব্যাকটেরিয়াল সলিউশন) ঢেলে দিবে। সেটি প্রবাহ হতে থাকবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর এখানে নতুন পানি যুক্ত হচ্ছে এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করে আমরা এই ব্যাকটেরিয়া দিতে থাকব। এইটুকু নিশ্চিত করতে পারি, নোংরা পানির গন্ধটা একেবারেই থাকবে না। এই প্রক্রিয়ায় পানি পুরোপুরি পরিষ্কার হবে কি না সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’

উৎপাদিত ব্যাকটেরিয়াল সলিউশন বা এই ধরনের অণুজীব বেঁচে থাকতে এবং প্রজননের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন তা খাল বা নালার নোংরা পানিতে পাওয়া গেছে। ফলে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অণুজীব খালের প্রবহমান পানিতে দিতে পারলে তা প্রজননের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে।

তিনি বলেন, ‘প্রবহমান পানির মধ্যে এটি কাজ করবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যাকটেরিয়া এখানে বেঁচে থাকে বিধায় ব্যাকটেরিয়া সলিটোয়াস্ট বা বর্জ্যগুলোকে ভেঙে ফেলে। প্রবহমান পানিতে অণুজীব দিলে সেখানে অক্সিজেন পাবে, নড়াচড়া করবে। সেটি তার জন্য অনুকূল পরিবেশ হবে।’

‘এখন দেখার বিষয় যে প্রবহমান পানিতে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়াল সলিউশন বা অণুজীব দিতে হবে, কত সময় পরপর দিতে হবে এবং কতগুলো জায়গা থেকে দিতে হবে।’

পোল্ট্রি খামারে অণুজীব ব্যবহারে সফলতা

এই একই ব্যাকটেরিয়া পোল্ট্রি সেডে ব্যবহার করা হয়েছে। সেডে ব্যাকটেরিয়াল সলিউশনটিকে স্প্রে করার ৩০ মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ গন্ধ দূর হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘একবার স্প্রে করলে তিনদিন গন্ধ থাকে না। এটি ব্যবহারে প্রমাণিত এবং এখন ব্যবহার হচ্ছে। যদিও আমরা বিষয়টি বড় পরিসরে কাউকে জানাইনি।’

গবেষণার ফল ইতিবাচক হলেও এর নেতিবাচক কোনো দিক আছে কি না- জানতে চাইলে রফিকুজ্জামান বলেন, ‘নিশ্চিন্তে বলতে পারি এটি মানবদেহ বা অন্য কোনো প্রাণীর দেহের জন্য ক্ষতিকর হবে না। কারণ আমরা প্রথম দিকে সাতক্ষীরায় মাছের ওপর এই অণুজীব প্রয়োগ করেছি। মাছ খুব নাজুক ধরনের প্রাণী। যদি ক্ষতিকারক কিছু হতো তা হলে মাছের ক্ষতি হতো। বরং সেখানে স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে। এছাড়া পোল্ট্রি ফার্মেও প্রয়োগ করছি। সেখানেও মুরগির কোনো ক্ষতি হয়নি।’

 

প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা এই গবেষণা চূড়ান্ত হলে ব্যবহার ব্যয় নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকবে না। কারণ এই অণুজীব প্রজনন সক্ষম। তাই খরচও নামমাত্র হবে বলে জানান তিনি।

দীর্ঘ এই গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো পর্যায় থেকে আর্থিক সহযোগিতা চান না রফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘গবেষণা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ফান্ডিং অথরিটির কাছে অ্যাপ্লাই করিনি এবং করবো না। কারণ ফিশারিজের জন্য ফান্ডিং আছে। সেটা দিয়ে ধাপে ধাপে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। অর্থায়নের বিষয়টি যখন আসে, তখন কী পারলাম, কী পারলাম না এই প্রশ্নটিও বড় হয়। একজন গবেষক হিসেবে নিজের কাছে জবাবদিহিতা থাকুক, অন্যের কাছে নয়।’

মশক নিধনেও ভূমিকা রাখতে পারে অণুজীব

অতীতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শতাধিক প্রাণ ঝরে গেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে মশা নিধনের কার্যক্রম থাকলেও এডিস প্রতিরোধ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ আনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। এই গবেষক আশা করেন, গবেষণায় সফল হলে মশা নিধনেও কাজ করবে অণুজীব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মশার লার্ভিসাইড ধ্বংসে অণুজীবের ব্যবহার কাজ করতে পারে। অণুজীবের মাধ্যমে পরিবেশের পরিবর্তন না করে মশার উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করা গেলে বংশবিস্তার বন্ধ হবে। এতে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমরা এটি নিয়ে কাজ করবো।

ফিশারিজ বায়োলজি এবং অ্যাকুয়াটিক এনভায়রনমেন্ট বিভাগের আরেক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা যদি এই গবেষণাটিকে সফলতার দিকে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য উপকার হবে। এই গবেষণা দিয়ে অনেক কম খরচে অণুজীবগুলো অনুকূল পরিবেশে বংশবিস্তার করবে। কারখানার বর্জ্যে যে ক্ষতিকর উপাদানগুলো থাকে সেগুলো ভেঙে ফেলবে। অণুজীব প্রয়োগ করে কাজ করতে পারলে পরিবেশ, নদী দূষণের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে। পরিবেশ উপকৃত হবে। দেশ এবং দেশের মানুষ উপকৃত হবে।’

ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/কারই