সুখ হলো না ইসির

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১০:১৩ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৪৪

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের পর থেকে নানা বিষয়ে অসন্তোষ ছড়িয়েছে কমিশনারদের মধ্যে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় সময়ই আলোচনায় থেকেছে ইসি। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে কমিশনারদের মতবিরোধে নাকাল হয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। গণমাধ্যমও সরব ছিল ইসি-অসন্তোষে। মতবিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বয়কট করে একজন কমিশনারের বেরিয়ে আসার নজিরবিহীন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশ।

ভোটের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও অসন্তোষ-সংকট একেবারে কেটে যায়নি। সম্প্রতি ইসিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আবার আলোচনায় এসেছে নির্বাচন কমিশন। এই বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছাড়া বাকিরা একাট্টা হয়েছেন। তাদের দাবি, একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন সিইসি। চার কমিশনারের মতকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্তে চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়োগ প্রক্রিয়া। এর আগেও গেল বছর চার কমিশনার একাট্টা হয়ে আন-অফিসিয়াল (ইউও) নোট’  লিখেছেন সিইসিকে। সেখানে তাদের দাবি ছিল, তাদের পাশ কাটিয়ে ইসিতে অনেক সিদ্ধান্ত হয়। যা তারা পরে পত্রিকা মারফত জানতে পারেন। বিষয়টি বিব্রতকর বলেও মন্তব্য করেন তারা।

এবার কমিশন সচিবালয়ে নিয়োগ ইস্যুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে চার কমিশনার একজোট হয়েছেন। তারা এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে সিইসির কাছে আন-অফিসিয়াল (ইউও) নোট’ লিখেছেন। এর ফলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ‘কর্তৃত্ব’ নিয়ে এক বছরের মধ্যে ফের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এতে সমন্বয়হিন হয়ে পড়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এমন সমন্বয়হীন চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও মত এসেছে এক নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে।

এত সব কিছুর মধ্যেও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব (জ্যেষ্ঠ সচিব) মো. আলমগীর মনে করেন, কমিশনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সবকিছু আইন অনুযায়ী হচ্ছে।

এ বিষয় নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারে বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, সিইসি কে এম নূরুল হুদা দেশের বাইরে রয়েছেন। এ মাসেই তিনি দেশে ফিরবেন। তখন সিইসি চাইলে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানান ইসি সচিব।

তবে ইসির ভেতরের এ দ্বন্দ্ব বাইরে আনা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও আবু হাফিজ। তারা গণমাধ্যমে বলছেন, অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্থাটির কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মানুষের মধ্যেও কমিশন নিয়ে অনাস্থা বাড়বে।

গত রবিবার চার নির্বাচন কমিশনার যৌথভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে আনঅফিসিয়াল (ইউও) নোটিস দিয়েছেন। এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের সব বিষয়ে সংবিধানসহ বিদ্যমান সব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত আমরা জানতে পারি না। সিদ্ধান্তগুলো আমাদের অবহিতও করা হয় না। এটা যাতে করা হয়, সে জন্য আমরা জানিয়েছি।

চার কমিশনারের ইউও নোটে বলা হয়, ১২তম-২০তম গ্রেডভুক্ত শূন্য পদে কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম নিয়ে সিইসির সভাপতিত্বে ১৪ নভেম্বর একটি সভা হয়। সভায় একপর্যায়ে একজন নির্বাচন কমিশনারের প্রশ্নের উত্তরে ইসি সচিব মো. আলমগীর জানান, নিয়োগের বিষয় ও এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত। বিষয়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনারও সমর্থন করেন।

সচিব আরও জানান, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়াদি কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অন্যান্য বিষয়াদি সিইসির অনুমোদন সাপেক্ষে সচিবালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন।

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনে গত সেপ্টেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এমন বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সিইসি ও ইসি সচিব ছাড়া অন্য নির্বাচন কমিশনারদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না জানানোর অভিযোগ তখনও উঠেছিল। আইন-বিধি যথাযথ অনুসরণ করা হচ্ছে না দাবি করে তখনও সিইসিকে চিঠি দিয়েছিলেন চার নির্বাচন কমিশনার।

পরে ইসি সচিবালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালনায় আইন ও বিধিমালা অনুসরণে চার নির্বাচন কমিশনারকে জানানোর বিষয়ে অফিস আদেশ হলে ‘অসন্তোষ’ প্রশমিত হয়।

ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নের শঙ্কা

ইসি সচিবালয়ের এমন কর্তৃত্বের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন চার নির্বাচন কমিশনার। তারা মনে করেন- নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের সব বিষয়ে সংবিধানসহ বিদ্যমান সব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হবে। একইসঙ্গে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে গত সোমবার তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, তা নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা সমর্থন করে না।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি সচিবালয়ের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে ১২তম থেকে ২০তম গ্রেডের ১০টি পদে ৩৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি সচিবালয়।

মাহবুব তালুকদার তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এই অর্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুমোদন করলেও কতজন পরীক্ষককে কীভাবে প্রদান করা হয় সেই হিসাব কমিশনের কাছে নেই। এমনকি নিয়োগ কমিটির সদস্যবৃন্দও এ বিষয়ে জানেন না।

গত ১৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে এক সভায় অন্য নির্বাচন কমিশনাররা অভিযোগ করেন, ইসি সচিবালয় এই নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত ও অর্থ ব্যয় সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনকে কোনো পর্যায়েই জানায়নি। তবে ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব তাদের জানান, এ নিয়োগ বা তার ব্যয় নির্বাচন কমিশনারের এখতিয়ার বহির্ভূত। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন বলে অভিযোগ মাহবুব তালুকদারের। এ কারণেই বাকি চার নির্বাচন কমিশনার গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে একটি ইউনোট মাধ্যমে ইসি সচিবালয়ের কার্যাদির বিষয়ে কমিশনের এখতিয়ার সম্পর্কে জানতে চান।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি মনে করি অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। অনেক ক্ষেত্রে সচিবালয়ের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

আইন দেখিয়ে দিলেন ইসি সচিব

নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে চার নির্বাচন কমিশনারের সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর। তিনি বলেছেন, কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নির্বাচন কমিশনারদের ‘অবগত’ করার বিষয় নয়’।

চার নির্বাচন কমিশনারকে না জানানো আইনসম্মত হয়েছে কি না-প্রশ্ন করা হলে ইসি সচিব বলেন, “এটা হানড্রেড পার্সেন্ট আইনসম্মত। সংবিধান, আইন, বিধি ও নিয়মকানুন ফলো করে করা হয়েছে। এ নিয়োগে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।”

স্বাধীন ইসি সচিবালয় আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে আলমগীর বলেন, ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সিইসির কাছে ন্যস্ত থাকবে এবং সচিব ইসি সচিবালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেখবেন।

মানুষের মধ্যেও কমিশন নিয়ে অনাস্থা বাড়বে

তবে ইসির ভেতরের এ দ্বন্দ্ব বাইরে আনা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও আবু হাফিজ।  তারা বলছেন, ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন কার্যকর হওয়ার পর আগের দুই মেয়াদের মোট দশ বছরে সচিবের সঙ্গে তাদেরও কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলেও তা কখনও প্রকাশ্যে আসেনি।

সাবেক দুই নির্বাচন কমিশনার বলেন, অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্থাটির কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মানুষের মধ্যেও কমিশন নিয়ে অনাস্থা বাড়বে। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন সংশোধনের বিষয়টি নিযে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। সেই সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

এবিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল গনমাধ্যমকে বলেন, সিইসি ও ইসি সচিবের একক কর্তৃত্ব দেওয়ায় আমরা ওই আইনটি তখনই সংশোধনের জন্য বলেছিলাম। এসব ঝামেলার বীজ তো তখন বপন হয়েছিল। কমিশন একটা কম্পোজিট বডি; ইসি সচিবালয় কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু একক নিয়ন্ত্রণ থাকলে স্বচ্ছতা তো প্রশ্নের মুখে পড়বে।”

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, “আমাদের সময়েও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ ছিল। আমরা বলার পরও আইন সংশোধনটা করেনি। কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে বলিনি আমরা। নিজেরা আলোচনা করে যতটুকু সম্ভব সমঝোতায় কাজ করেছি।

ঢাকাটাইমস/৩০নভেম্বর/জেআর