উপাচার্য অপসারণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হলে আন্দোলন স্থগিত হবে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ছাত্রাবাস নির্মাণকে কেন্দ্র করে অনিয়মের অভিযোগে ছাত্র আন্দোলন চলছে। আন্দোলকারীরা উপাচার্যের অপসারণসহ বেশকিছু দাবি উপস্থাপন করছেন। আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে নানামুখী তর্ক-বিতর্ক চলছে। জাবির চলমান আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ শীর্ষক আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাবি প্রতিনিধি রাইয়ান বিন আমিন।
জাবির উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার পুনর্বিন্যাস আন্দোলন থেকে উপাচার্য অপসারণের আন্দোলন কেন?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অংশীজনদের পরামর্শ ও মতামত না নিয়ে তড়িঘড়ি করেই নিজেদের মতো অপরিকল্পিত একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। যার ভিত্তিতে গাছ কাটা শুরু করে। আমরা এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছিলাম। কিন্তু ঈদুল আজহার পর শুনতে পেলাম কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করতে উপাচার্যের মধ্যস্থতায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ দুই কোটি টাকা ‘ঈদ সেলামি’ পেয়েছে। বিষয়টি গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়। এরপর কে কত টাকা পেয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা স্বীকারও করলেন এবং এ সম্পর্কে একটি ফোন রেকর্ডও ফাঁস হলো। ১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠকে দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলা হলেও তিনি আগ্রহ দেখাননি। এরপর দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তার অপসারণ দাবি করা হয়।
ফোন আলাপই কি প্রমাণ করে উপাচার্য দুর্নীতি করেছেন?
প্রথমত যারা টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তারা এখনো জোর দিয়ে বলছেন, উপাচার্য ও তার পরিবার আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে কেন্দ্র ও শাখা ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চার নেতার ৮, ৯ ও ১০ আগস্টের কললিস্ট চেক করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। এছাড়া ছাত্রলীগের জুনিয়র পর্যায়ের অনেকেই বলেছেন, তারা কে কত টাকা পেয়েছেন। উপাচার্য নিজেও ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের কাছে বলেছেন, ‘ঠিকাদার দুই কোটি টাকা দেবে বললেও এখন দিচ্ছে এক কোটি।’ এ নিয়ে ৩০ আগস্ট ওই দৈনিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে উপাচার্যের কাছে ‘কমিশন চাওয়া’র অপরাধে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকেও পদ ছাড়তে হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি সুষ্ঠু তদন্ত করতে। কিন্তু এখানেই তার বড় ভয়। এসবই প্রমাণ করে এখানে আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ জমা দিতে বলেছিলেন। সেটি না করেই উপাচার্যের বাসার সামনে অবস্থান নিলেন কেন?
মন্ত্রী মহোদয় কর্মসূচি প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাভাবিক করতে বলেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, তদন্তের মাধ্যমে উপাচার্য অপসারণ প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেই আন্দোলন স্থগিত হতে পারে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি আমরা দেখিনি। আর উপাচার্যের বাসার সামনে অবস্থান নেওয়া তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনে হামলা-ধাক্কাধাক্কির কী ঘটনা ঘটেছিল?
আমরা ধাক্কা দিয়েছি বা হামলা করেছি এরকম কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। হামলাটা একপাক্ষিক। উপাচার্যের প্রত্যক্ষ মদদে এবং তার পন্থি শিক্ষকদের উসকানিতে ছাত্রলীগের একটি অংশ এ হামলা চালিয়েছে। যেখানে নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আহত হয়েছে। ন্যক্কারজনক হামলার মাধ্যমে উপাচার্য ‘মুক্ত’ করাকে তিনি ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি উল্লাস প্রকাশ করে এটিকে তার আনন্দের দিন বলে ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
আন্দোলনে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ছাত্রলীগ সেখানে গিয়েছিল কি?
তাদের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনকারীদের সেখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া। শিবিরমুক্ত করতে সেখানে গিয়ে থাকলে মেয়েদের কেন আহত করা হলো? তিনজন হিন্দু ছেলেকেও ‘শিবির’ বলে মেরেছে। আর যাকে শিবির বলে ধরা হয়েছে সে প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সন্দেহবশত তাকে ধরা হয়েছে। সে ‘শিবির’ এমন কোনো দালিলিক প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। কয়েকজন আন্দোলনকারীর সঙ্গে তার হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ও ভয়েস রেকর্ডের সংযোগ দেখিয়ে শিবির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে। এরকম চেষ্টা পুরোনো কৌশল। প্রশাসন আন্দোলন দমানোর রাস্তা খুঁজতেই শিবির সংশ্লিষ্টতার ধুয়া তুলেছে।
আন্দোলনে আসলেই কি শিবিরের সংশ্লিষ্টতা আছে?
আমরা দেখেছি, যাকে শিবির বলে ধরা হয়েছে তাকে নিয়ে প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল হাসান এবং উপাচার্যপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক বশির আহমেদের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে তারাও শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট! তাদের ভাষ্যমতে, এসব তৈরি করা হয়েছে। যদি তাদের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা মিথ্যা হয় তাহলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বার্তা সত্য কীভাবে হয়? আর ভয়েস রেকর্ডগুলো একপাক্ষিক। ফলে বোঝা যায় না কার সঙ্গে কথা বলছে। আর আমরা শুনেছি ছাত্রলীগের মধ্যেও শিবির আছে। সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
পুলিশ আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে হয়রানি করছে। এ বিষয়ে জানতে চাই
দুজন শিক্ষকের বাসায় রাতে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গেছে, এমন শুনেছি। এছাড়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাড়িতেও পুলিশ গিয়ে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে এবং তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে বলেছে। এরকম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে নাগরিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাগরিক অধিকার খর্ব করা এবং দমন-পীড়ন চালানোর কর্তৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই।
অজ্ঞাতনামা হিসেবে আন্দোলনকারীদের নামে একটি মামলা করা হয়েছে। সেটার কী অবস্থা?
নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ঢাল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটা করেছে। এর আগেও এই উপাচার্য মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জেলহাজতে পাঠিয়েছিলেন। হামলা-মামলা করে পদে টিকে থাকতে হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কত নাজুক এবং তিনি প্রশাসন চালাতে কতটা ব্যর্থ!
বর্তমানে ক্লাস-পরীক্ষা ও হল বন্ধ। আপনারাও চাচ্ছেন স্বাভাবিক পরিস্থিতি; সেটা কীভাবে?
আমরা ২১ নভেম্বরের মধ্যে শিক্ষা-কার্যক্রম স্বাভাবিক করার আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি। এখন আমরা আচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। হল খুলে শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক করা, হামলার বিচার করা এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে উপাচার্যকে অপসারণের দাবি জানিয়েছি। এছাড়া তদন্তকালীন সময়ে উপাচার্যকে সাময়িকভাবে সরিয়েও শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
হামলার বিচার আপনারা উপাচার্য এবং তার প্রশাসনের কাছে করছেন না কেন?
উপাচার্য যেহেতু নিজেই এই হামলার মদতদাতা। এজন্য আমরা তার কাছে বিচার দাবি করব না।
জাবির চলমান অবস্থায় রাষ্ট্রের মনোভাব কেমন?
আমারা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তারা আমাদের তথ্য-উপাত্ত জমা নিয়েছে। আমরা শুনেছি ইউজিসি তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী সুষ্ঠু তদন্ত হলে উপাচার্যের দুর্নীতির সব প্রমাণ বেরিয়ে আসবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
ঢাকা টাইমস এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/১ডিসেম্বর/এজেড)