আচার্যের কাছে খোলা চিঠি

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫৬ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০৬

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ

মহামান্য আচার্য

শুভ সকাল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের রক্তার্জিত স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত করছি।  বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হতে পেরেছি ওই মুক্তিকামী জনতা এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে।

মহামান্য আচার্য, আপনি আমাদেরকে প্রতিবছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর নিমন্ত্রণ জানান। আমরা এমন সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল বলে। আপনারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন বলে আমরা আজ গর্বিত জাতি।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্র, কর্মচারী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ওই বছরের অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার একটি।

আজ দেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েক শত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আজ দেশে আছে, যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আজ উপাচার্যের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে বন্ধ। ১৪ হাজার ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকসহ সারাদেশের মানুষ হতবাক। কীভাবে একজন উপাচার্যের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের মুখোমুখি। প্রায় তিন মাস আন্দোলন আর একমাস বন্ধের কারণে শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে।

এমনিতে দেশের তরুণ সমাজ মাদক, নেশা ও সন্ত্রাসসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়ছে।  সরকার এবং পরিবারগুলো সেসব সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেই সময় এতো দীর্ঘ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে উপাচার্যের চরম অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সরকারের নিষ্ক্রিয়তা সমগ্র জাতিকে হতাশ করছে। এমনি সময় জাতি আপনার বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।

আগামী ৮ তারিখ থেকে সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালনে দিন গণনার সূচনা হবে। ঠিক সেই সময়ে একটি গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জনৈক উপাচার্যের জন্য বন্ধ থাকতে পারে কি?

বারবার একটি পক্ষ আন্দোলকারীদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বোঝাতে চাইছে, বিশ্ববিদ্যালয় তারা ধ্বংস করছে।

মহামান্য আচার্য, ৩০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখ বিকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আপনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন নৈতিকতা ও দৃঢ়তা দিয়ে দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। মহামান্য আচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষক ও ছাত্ররা আপনাকে সেই দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে চিঠি লিখেছিল। তারা আপনার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। আন্দোলনকারীরা কিন্তু আজও তাদের লেখা চিঠির উত্তর আপনার কাছ থেকে পায়নি।

মহামান্য আচার্য, আজ বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম একটি লেখা লিখেছেন যার শিরোনাম ‘রাজনীতিবিদরা কি মানুষের ভাষা বোঝেন’। বাংলাদেশ ইনসাইডার-এর শিরোনাম, ‘সর্বদলীয় সরকার-ইউনুস রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী?’। নামিদামি সম্পাদকদের এমন সব শিরোনামের অর্থ কী?

আন্দোলনের সঙ্গে ‘বরদাস্ত’ যুক্ত করে কোনো মন্ত্রী যদি কথা বলেন, তা হলে কী বুঝতে হবে জানি না। তবে ব্যক্তি যখন সমষ্টির থেকে বড় হয়ে যায় তখন কী হতে পারে সেটা ভাববার বিষয়।

জাহাঙ্গীরনগরের দুর্নীতির অভিযোগ পদ্মা ব্রিজের দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে এক করে ফেলার মাশুল এখন ছাত্ররা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের মনে ক্ষোভ চিরদিন থাকবে। সেই ক্ষোভের মূল্য সরকারকে দিতে হবে। এই ১৪০০০ ছাত্র-ছাত্রী কিন্তু সরকারকে অভিযুক্ত করবে। ব্যক্তিকে রক্ষার মূল্য এভাবে সরকার দেবে কেন?

পথ একটাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপ নিতে দেরি হলে যা হারাবে তা সহজে ফিরে পাওয়া যাবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ হাজার ছাত্রছাত্রী আপনার পদক্ষেপ কামনা করছে। বিজয়ের আনন্দ সকলের ঘরে ঘরে যাতে আলোর মতো পৌঁছে যায় সেজন্য অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার চেয়ে জরুরি আর কিছু হতে পারে কি?

আন্দোলকারীরা এদেশের মানুষ এবং তারা বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপনার পাশে ছিল। ভিন্ন মতের হলে তাদেরকে অপমানিত হতে হবে সেটা কেউ সমর্থন করে না।

৫ নভেম্বর ২০১৯ তারিখ যে ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী একদল ছাত্রকে দিয়ে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তা যেকেনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেয়। সেই ঘটনার দায় ইতিমধ্যে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত উপাচার্য স্বীকার করে নিয়েছেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কারও কোনো নিন্দা বাক্য আজও কেউ শোনেনি। যদি আন্দোলনকারীরা কোনোভাবে অপরাধী হতো তাহলে মিডিয়া এতটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতো না।

আপনি ৬৯, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান দেখেছেন। সমগ্র জাতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ নভেম্বরের ঘটনা দেখেছে। এমনকি বিশ্বের আরও অনেক মিডিয়া এসব প্রচার করেছে। তারা সকলে উপলব্ধি করেছে, They have a point.

শত শত পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল। সকলে হতবাক হয়ে দেখেছে। সকলে হতবাক হয়ে শুনেছে উপাচার্য কাকে গণঅভ্যুথানের দিন বলছেন। তিনি যে দিনটিকে আনন্দের দিন বলছেন সেই দিনটি জাতির ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। আপনি রাষ্ট্রের অভিভাবক। আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরও অভিভাবক।  আন্দোলনকারীদের দিকে আপনার কোমল দুহাত বাড়িয়ে দিলে জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

আপনার অপেক্ষায় শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারই নয় সমগ্র জাতি অপেক্ষা করছে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়। আপনি ভালো থাকবেন। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।