বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আসলে কাদের ভয় পাচ্ছে?

মুশফিক উস সালেহীন
| আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:২৭ | প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০৬
মুশফিক উস সালেহীন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে গত ৫ নভেম্বর। আন্দোলনকারীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একাংশের হামলার পর। উপাচার্য যে দিনটিকে গণঅভ্যুত্থানের ও তার জন্য আনন্দের বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই গল্পটা বদলে দিনটি ক্রমশ বিষাদগ্রস্ত হতে থাকে। দুপুরের পর থেকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জরুরি সিন্ডিকেট মিটিংয়ে বসে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেই সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সেই সিন্ডিকেটে কোনো নির্বাচিত শিক্ষকপ্রতিনিধি নেই। বাকি যারা আছেন তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও শূন্য পদগুলোতে নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না, কারণ নির্বাচন হলে উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিদের নির্বাচিত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

৩ মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে কর্মসূচি ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়েছে। শুরুতে ক্লাস-পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত না করার ব্যাপারে আন্দোলনকারীরা সচেতন ছিল। এমনকি ভর্তি পরীক্ষায় বাধা দেওয়া হয়নি। কিন্তু দুর্নীতির তদন্তের দাবির ব্যাপারে যখন সরকার কোনো ভ্রুক্ষেপ করছিল না, আচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করার পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল না, তখন কঠোর কর্মসূচির দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

ধর্মঘটের সময় উপাচার্যপন্থি যেসব শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের, সেসব শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন। ধর্মঘটের মধ্যেও উপাচার্যপন্থি অনেক শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যান। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন একাডেমিক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে ক্লাস বা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি এমনটা কোথাও দেখা যায়নি। উল্টো আন্দোলনকারীরা যাতে কলাপসিবল গেট আটকে ভবনের সামনে বসতে না পারে সেজন্য প্রশাসন বিভিন্ন কলাপসিবল গেটে শিকল পরিয়ে তালা লাগিয়েছে। তার প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন একাডেমিক ভবনে তালা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু এমন সময়েও যারা ক্লাস করতে চেয়েছেন তারা করেছেন। একটি ক্লাস করে ৩-৪ দিনের উপস্থিতির নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটেছে।

যেই শিক্ষকগণ ক্লাস-পরীক্ষার ব্যাপারে মাত্র ১০ দিন আগে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন তারাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণার ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। ২-৩ ঘণ্টার নোটিশে হল খালি করার নির্দেশ বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ভয়ভীতি প্রদর্শন করার অভিযোগ রয়েছে।

ক্লাস-পরীক্ষা ও হল বন্ধ করার এই ঘোষণায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের মানুষ। বছরের এসময়ে অধিকাংশ বিভাগে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট আরো তীব্র হবে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, সেসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা চান দ্রুত ফাইনাল পরীক্ষা দিতে। সামনের দুই মাসে অন্তত ১০টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ফলে অনেকেই সেসব পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হারাবেন। বাকিদের প্রস্তুতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশনি করে নিজেদের খরচ জোগায়। হল বন্ধ করে দেওয়ার ফলে দূরবর্তী অঞ্চলে যাদের বাড়ি তারা প্রচ- আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকেই টিউশনি টিকিয়ে রাখার জন্য ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় বন্ধু-বান্ধবের বাসায় থাকছেন, যারা সে ব্যবস্থা করতে পারেননি তাদের ফিরে যেতে হয়েছে নিজেদের বাড়িতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসের আশপাশে যেসব শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন, তাদেরকেও বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। এসব এলাকায় হঠাৎ পুলিশের আনাগোনা বেড়ে গেছে, ফলে সেখানে যারা অবস্থান করছেন তারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এসব এলাকার দোকানপাট, খাবার দোকান বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বটতলা, টারজান পয়েন্ট, পরিবহন চত্বর, মুরাদ চত্বরের সব ধরনের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বিক্রেতাদেরও ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও দিনের বেলা নিয়মিত প্রশাসনিক কর্মকা- চলছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ চলছে, সব বিভাগ, হলের অফিস ও অন্যান্য প্রশাসনিক ভবনে কাজকর্ম চলছে। শুধু যাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কর্মকা- থমকে আছে।

সামগ্রিক ঘটনার মাধ্যমে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, একাডেমিক কার্যক্রমের ব্যাপারে প্রশাসনের যে উৎসাহ ও উদ্বেগ ধর্মঘটের সময়ে দেখা গেছে, তা কেবলই লোক দেখানো ছিল। উপাচার্য আশংকা করছেন, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ফিরে এলেই আন্দোলন জোরদার হবে এবং সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি ব্যর্থ হবেন। সেজন্যই ক্যাম্পাস, এমনকি ক্যাম্পাসের আশপাশেও শিক্ষার্থীরা যাতে অবস্থান করতে না পারেন সেজন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করছেন। উপাচার্য যদিও বারবার বলছেন যে, এই আন্দোলন গুটি কয়েক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলন, কিন্তু তার এ সব পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়ার ভয়ে আছেন। অন্যদিকে হামলা-পরবর্তী ঘটনাগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে সামনের দিনগুলো উপাচার্যের জন্য আরো সংকটময় হবে। এই পরিস্থিতিতেও সরকারের উচ্চমহল আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু তাতেও উপাচার্য আশ্বস্ত হতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। যদি উপাচার্য ও প্রশাসনের নীতিনির্ধারক ব্যক্তিবর্গ দুর্নীতির অভিযোগের অসারতার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাহলে তাদের এই ভয় পাওয়া উচিত নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের মানুষ নিশ্চিত যে, এই উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। উপাচার্যের অপসারণ ব্যতীত এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, সৌজন্যবোধ ও পারস্পরিক সম্মানবোধ রক্ষায় দ্রুত এই সংকট থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।

লেখক: সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট

অনুলিখন: রাইয়ান বিন আমিন

(ঢাকাটাইমস/৪ডিসেম্বর/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :