মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেতে পেতে পরপারে ৪ বীরাঙ্গনা, জীবনসায়াহ্নে ৬

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০৩ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:১২

রানীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেলেন। কিন্তু সেই মর্যাদার স্বাদ অনুভব করে যেতে পারেননি তারা। তার আগেই অনেক দুঃখ নিয়ে পরপারে চলে গেছেন চার বীরাঙ্গনা।

তাদের সঙ্গে আরও ছয় বীরাঙ্গনাও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়েছেন। তারাও অভাব-অনটন আর অবহেলার জীবনসংগ্রাম লড়তে লড়তে এখন জীবনসায়াহ্নে কাতর। তারপরও এই ছয়জন অন্তত শেষ জীবনে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ও সুবিধা উপভোগ করে যেতে পারবেন।   

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে।

তারা হলেন- বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা, সুষমা সূত্রধর, মায়া রানী সূত্রধর, রাশমনি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। তাদের মধ্যে প্রথম চারজন আর বেঁচে নেই।

রানীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে আতাইকুলা পালপাড়া। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালানো এই গ্রামের সনাতন ধর্মের মানুষের ওপর। গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এসব পরিবারের কিশোর, যুবক ও বিভিন্ন বয়সী নারীদের ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদাররা। পরে ওই গ্রামের সুরেশ্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে ব্রাশফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারণ পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামী জনতাকে হত্যা করা হয়। নারীরা স্বামী-সন্তানদের বাঁচানোর আকুতি করলেও পাক-হানাদারদের মন গলেনি। এসময় তারা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। 

বীরাঙ্গনা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, ‘ওই দিন সকালে আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবিরা আসে। আমরা বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে টেনে-হিঁচড়ে পাঞ্জাবিরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে গেলে আমার চোখের সামনে স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে তারা। আমার ওপরও নানা কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়।’

কালী দাসী পালের একমাত্র ছেলে দিনমজুরের কাজ করেন। তিনিও পেটের তাগিদে কখনো ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে কিংবা শ্রমিকের কাজ করে দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে কোনোরকম বেঁচে আছেন। বলেন, ‘ভেবেছিলাম, বেঁচে থাকতে হয়তো স্বীকৃতি পাব না। অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। সরকারকে অনেক ধন্যবাদ।’ 

বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রানী পাল (৭০) অবশেষে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘স্বামী হারানোর পর ৪৭টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সব সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদের দেয়া হতো, তাহলে যে কদিন বাঁচি তা ভোগ করে যেতে পারতাম।’ 

উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন বলেন, এই স্বীকৃতিপ্রাপ্তির সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বরাদ্দ এলেই বিজয় দিবসে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের হাতেও সম্মাননা তুলে দেয়া হবে বলে আশা করছি।’

নওগাঁ-৬ (রানীনগর-আত্রাই) আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের এই বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছেন। এটি আমাদের অনেক বড় একটি সফলতা। আমার খুবই ভালো লাগছে। যে কজন এখনো বেঁচে আছেন, তারা অন্তত তাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু একটু হলেও ভোগ করে ও স্বীকৃতির মুকুট মাথায় নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারবেন।’

(ঢাকাটাইমস/৬ডিসেম্বর/এলএ/মোআ)