শশীকাহন: পৌরাণিক উপাখ্যান: ফ্যান্টাসি থ্রিলার সিরিজ,পর্ব- এগার

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৪৯

ড. রাজুব ভৌমিক

একসাথে প্রায় দুই লক্ষ সেনা সদস্য হারিয়ে মহারাজা মঞ্জট চিতলা রাজ্যের রাজা চিগুর উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। রাজা চিগুর অতর্কিত হামলায় মহারাজা মঞ্জট কোনমতে বেঁচে যায়। লাগগিন্তা রাজ্যে পৌঁছে মঞ্জট রাজা চিগুর উপর ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। সাথে সাথে মহারাজা মঞ্জট তার সেনাপতি কে তার কক্ষে ডেকে পাঠায়। সেনাপতি আসার পর মহারাজা মঞ্জট তাকে নির্দেশ দেয় রাজ্যের বাকী তিন লক্ষ লাগগিন্তা সেনা নিয়ে চতুর্দিক থেকে ছোট্ট চিতলা রাজ্যের উপর অতর্কিত হামলা করার জন্য এবং পুরো চিতলা রাজ্য ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। মহারাজা মঞ্জটের আদেশ অনুযায়ী সেনাপতি তিন লক্ষ সেনা নিয়ে গভীর রাত্রে চিতলা রাজ্যের উপর আক্রমণ চালায়। এতে মুহূর্তের মধ্যে চিতলা রাজ্যের বিশহাজার সেনা সহ রাজ্যের শিশু, বয়স্ক, বৃদ্ধকে সমানে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। রাত শেষ না হতেই পুরো চিতলা রাজ্য আগুনে ধূলিস্বাত হয়ে যায়। চিতলা রাজ্যে লাগগিন্তা সেনারা এমন আক্রমণ চালায় যে পুরো রাজ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। 

রাজা চিগুর মৃত্যুর খবর দ্রুত চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রাসঙ্কের কানে পৌঁছে যায়। মহারাজা তার প্রিয় এক বন্ধুকে হারিয়ে খুবই মর্মাহত হন। এজন্য মহারাজা রাসঙ্ক একটি জরুরী রাজসভার আহ্বান করে এবং সভায় উপস্থিত সকলের কথা শুনল। সভায় উপস্থিত চলদাজ রাজ্যের মন্ত্রীরা মহারাজ রাসঙ্ককে লাগলিন্তা রাজ্যে আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ করে। মহারাজা রাসঙ্ক লাগগিন্তায় আক্রমণ করবে না বলে সরাসরি জানান। ‘রাজা চিগু আমার বন্ধু ছিল—সেটা সত্য কিন্তু তার রাজ্য লাগগিন্তা রাজ্যের অধীনে ছিল। রাজা চিগু তার ব্যক্তিগত কারনে মহারাজ মঞ্জট ও তার সেনার বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে। আমাদের উচিত চলদাজ রাজ্যের উন্নয়নে মনোযোগ দেয়া। গতবার লাগগিন্তা রাজ্যে বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের বহু ক্ষতি হয়েছি যা এখনো সাধারণ প্রজা কে বহন করতে হচ্ছে। আমাদের প্রজাদের সুখের কথাও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। তাই আমাদের প্রতিহিংসামূলক আচরণ বর্জন করতে হবে।’ মহারাজা রাসঙ্ক রাজসভায় উপস্থিত সবাই কে বলল। রাজসভায় উপস্থিত মন্ত্রিবর্গ রাসঙ্কের কথায় শান্ত হয়। 

এদিকে চলদাজ রাজ্যের যুবরাজ শিহিল সেনা ক্যাম্প থেকে রাজপ্রাসাদে মহারাজা রাসঙ্কের সাথে দেখা করতে আসল। মহারাজার সাথে যুবরাজ শিহিল তার কক্ষে দেখা করতে যায়। যুবরাজ শিহিল মহারাজাকে প্রণাম করে।  ‘পিতাশ্রী, আমাদের কে লাগগিন্তা রাজ্যে অতি শীঘ্র আক্রমণ করা উচিত। না হলে মঞ্জট শীঘ্রই আমাদের রাজ্যে উপর আক্রমণ করবে।’ যুবরাজ শিহিল মহারাজ রাসঙ্ককে বলল। মহারাজ রাসঙ্ক তার রাজ্যের উপর লাগগিন্তা সেনার আক্রমণ নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। কারণ চলদাজ রাজ্যে রয়েছে দেবতা কিতমুর আশির্বাদের নিরাপত্তা-বেষ্টনী—যা যুবরাজ শিহিল জানত না। শুধু যুবরাজ শিহিল কেন—মহারাজ রাসঙ্ক ছাড়া চলদাজ রাজ্যের কেউ জানত না। যুবরাজ শিহিল বারবার মহারাজা রাসঙ্ককে লাগগিন্তা রাজ্যের উপর আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ করছে কিন্তু রাসঙ্ক এতে কিছুতে সাড় দিচ্ছে না। পরে তিনি বাধ্য হয়ে যুবরাজ শিহিল কে বলল—’শোন যুবরাজ, এ কথাটি আজ পর্যন্ত আমি কাউকে বলি নি কিন্তু আজ আমি তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি— মনোযোগ দিয়ে শোন। চলদাজ রাজ্যে কেউ কখনো আক্রমণ করে কোন দিন সফল হতে পারবে না কারণ আমাদের রাজ্যে স্বয়ং দেবতা কিতমুর প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ আছে। দেবতা কিতমু আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন আমাকে দর্শন দিয়ে বলেন, আমি তোকে আশীর্বাদ করছি যতদিন তোর রাজ্যে সব দেবতাদের মন্দির ও পূজা হবে ততদিন তোর রাজ্যে আক্রমণ করে কেউ সফল হবে না।’  যুবরাজ শিহিল তখন সব বুঝতে পারে এবং তার মন শান্ত হয়। একটু পরে যুবরাজ শিহিল আবার সেনা ক্যাম্পের উদ্দেশে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়। এদিকে মহারাজা রাসঙ্ক ও যুবরাজ শিহিলের মধ্যে কথোপকথনের পুরো অংশ আড়াল থেকে লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর সুনেন্দ শুনতে পায়। সাথে সাথে এই গোপন তথ্যটি মহারাজা মঞ্জটের কানে সুনেন্দ পৌঁছে দেয়। 

মহারাজা মঞ্জট গুপ্তচর সুনেন্দের কাছে এই গোপন তথ্যটি জানার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে তিনি সহসাই চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করবে না। তিনি জানেন এই মুহূর্তে চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করা মূর্খতা হবে। মঞ্জট সিদ্ধান্ত নেয় তাকে শুধু সঠিক সময়ে চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করতে হবে। মহারাজ মঞ্জট বিশ্বাস করে যে চিতলা রাজ্যের আক্রমণের পিছেন চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রাসঙ্ক প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ছিল। তাই মঞ্জট প্রতিজ্ঞা করে যে সঠিক সময়ে সে অবশ্যই চলদাজ রাজ্য আক্রমণ করে তার উপরে চিতলা রাজ্যে হামলার প্রতিশোধ নিবে। মহারাজা মঞ্জট হারতে পছন্দ করে না। সে ঠিক করে তার রাজ্যের সৈনসংখ্যা অবিলম্বে বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া নতুন সেনা নিয়োগের পর তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে অনেক সময় কেটে যাবে।  

এভাবে এক-যুগ সময় অতিবাহিত হয়। এরই আগেই বহু রাজ্য ভ্রমণ করে দেবী আজ্রিয়ার পুত্র কিবন চলদাজ রাজ্যে এসে পৌঁছে। চলদাজ রাজ্যে পৌছার পর সে শশীমুখে জানতে পারে যে লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজা মঞ্জট তার পিতা নিম্বকে নৃশংস-ভাবে হত্যা করেছে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিবে বলে কিবন ঠিক করে। তাই পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে কিবন চলদাজ রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। প্রায় এক যুগ পরে কিবন এখন চলদাজ রাজ্যের একজন সেনা কমান্ডার। কিবনের বুদ্ধিমত্তা ও যুদ্ধকৌশলে পটুতার সম্পর্কে সবার জানা। তাই যুবরাজ শিহিল কিবনকে চলদাজ রাজ্যের সেনা প্রশিক্ষনের দায়িত্ব দিয়েছে। একদিন যুবরাজ শিহিল সেনাগুরু কিবনের কাছে তার সন্তান তৃষকে নিয়ে আনে। যুবরাজ শিহিল কিবনকে বলল, ‘আমার বালক সন্তান তৃষকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। আশা করি তৃষ একদিন আপনার মত দক্ষ একজন যোদ্ধায় পরিনত হবে।’ সেনাগুরু কিবনও সাদরে তৃষকে তার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করল। 

বালক তৃষ দিন দিন একজন যোদ্ধায় পরিণত হচ্ছে। গুপ্তচর সুনেন্দ নিয়মিত তৃষের সব খবর মহারাজা মঞ্জটের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে মহারাজা মঞ্জট তার সেনা সংখ্যা তিন-গুন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। লাগগিন্তা রাজ্যের এখন সেনা সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। অন্যদিকে চলদাজ রাজ্যের সেনা সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। সেনাগুরু কিবন তৃষকে নিয়মিত অস্ত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এভাবে প্রায় আরো একটি যুগ চলে যায়। এরমধ্যে যুবক তৃষ তার গুরু কিবনের কাছে তার সব প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করিল। তৃষের প্রিয় অস্ত্র হচ্ছে কুঠার। সে তার কুঠার দিয়ে এক মাইলের বেশি দূর থেকেও শত্রুকে হত্যা করতে পারে। চন্দ্রগ্রহে তৃষের মত দক্ষ কুঠারযোদ্ধা নাই। 

সেনাগুরু কিবন একদিন তৃষকে বলল, ‘আজ তোমার প্রশিক্ষণের শেষ দিন। আমার যতটুকু জ্ঞান দিবার তার সব আমি তোমাকে দিয়েছি। তোমাকে আমার আজ আর কিছু দিবার নাই।’ তৃষ উত্তরে বলল, ‘গুরুদেব, আপনার জন্য আজ আমি এত বড় একজন যোদ্ধা হতে পেরেছি। এর জন্য আমি আপনার কাছে চিরঋণী। দয়া করে বলুন গুরু দক্ষিণা হিসেবে আপনাকে কি দিতে পারি। যদি চান গুরুদেব আপনার গুরুদক্ষিণা হিসেবে আমি আমার প্রাণও দিতে প্রস্তুত।’ গুরু কিবন শিষ্য তৃষের কথা খুব সন্তুষ্ট হয় এবং বলল, ‘গুরু দক্ষিণা আমি তোমার কাছে একটি অবশ্যই চাইব। বল তুমি দিতে রাজী?’ তৃষ হাতজোড় করে বলল, ‘গুরুদেব, এই চন্দ্রগ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু আমার দেয়া বচন কখনো ভঙ্গ হবে না। গুরুদেব আমার প্রতিজ্ঞা আমার কুড়াল নিক্ষেপের মত—একবার সেটা ছুঁড়লে আর ফেরত নেবার মত নয়। দয়া করে আপনি  আমায় আদেশ দিন। গুরুদক্ষিণা হিসেবে আপনি যা চাইবেন আমি তাই দেব।’ তখন গুরু কিবন তৃষকে বলল, ‘লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজ মঞ্জট আমার পিতাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছে। যদি তোমার সাথে মহারাজ মঞ্জটের দেখা আমার আগে হয় তাহলে কথা দাও তুমি মহারাজ মঞ্জটকে সাথে সাথে হত্যা করবে।’ তৃষ একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুরুদেব, মহারাজ মঞ্জট চলদাজ রাজ্যের শত্রু—সে নির্বিচার বহু শশীকে হত্যা করেছে। আমাদের পরিবারেরও অনেক কে সে হত্যা করছে। আপনি না বললেও আমি মহারাজ মঞ্জটকে হত্যা করতাম। তবে আপনি যেহেতু গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন তাই আজ সূর্যগ্রহের সকল দেব-দেবীকে সাক্ষী রেখে আপনাকে কথা দিচ্ছি যে আমার সাথে যেই দিন মহারাজা মঞ্জটের সাথে দেখা হবে সেদিন তার মৃত্যু হবে।’ গুরু কিবন তার শিষ্য তৃষকে আশীর্বাদ করল। 

এদিকে লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর ও চলদাজরাজ্যের রাজকর্মচারী সুনেন্দ তৃষের দেয়া প্রতিজ্ঞার কথা দূর থেকে আড়ালে শুনে ফেলল। তৃষের প্রতিজ্ঞার কথা শুনে গুপ্তচর সুনেন্দের চোখে জল এসে যায়। কারণ একমাত্র সুনেন্দই জানে যে তৃষ হচ্ছে মহারাজ মঞ্জটের পুত্র। আজ তৃষ অজান্তে তার জন্মদাতা পিতা কে হত্যা করার জন্য তার গুরু কিবনকে বচন দেয়। সুনেন্দ ভাবল, ‘আজ যদি তৃষ তার প্রকৃত পরিচয় জানত তাহলে সে কোন দিন এই নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞা করত না।’ গুপ্তচর সুনেন্দ তৃষের এই প্রতিজ্ঞার কথা মহারাজ মঞ্জটকে বলবে কিনা ভাবতে থাকে। মহারাজ মঞ্জট যদি তৃষের এই প্রতিজ্ঞার কথা জানতে পায় তাহলে সে মনে অনেক দু:খ পাবে। সুনেন্দ প্রথমে ভাবল যে সে এই কথা মহারাজ মঞ্জটকে বলবে না— পরে সে আরো ভেবে ঠিক করল মহারাজের এই কথা জানা উচিত। একজন গুপ্তচরের কর্তব্য হচ্ছে তথ্য দেয়া—কিন্তু তথ্যটি ভাল কিনা খারাপ তার বিচার করার ক্ষমতা গুপ্তচরের থাকে না। তাই সুনেন্দ মহারাজ মঞ্জটকে এই তথ্য দিতে লাগগিন্তা রাজ্যে চলে যায়। 

লাগগিন্তা রাজ্যের প্রজারা মহারাজ মঞ্জটের শাসনে প্রায় অস্থির। মঞ্জট তার রাজ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজ্যের সব যুবককে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনী যোগদান করার প্রথা চালু করে। এ প্রথা সাধারণ প্রজারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। উপরন্তু, মঞ্জট তার সেনাপতিকে নির্দেশ দিয়েছে যে যুবকেরা রাজ সেনাবাহিনী তে যোগদান করতে অস্বীকার করে তাদের কে ধরে এনে সরাসরি মৃত্যুদন্ড দন্ডিত করতে। মঞ্জট বিশ্বাস করে চিতলা রাজ্যে তার ও তার সেনাবাহিনীদের উপর আক্রমণ চলদাজ রাজ্যের কারণে হয়েছে। চিতলা রাজ্যে মঞ্জট তার দুই লক্ষ সেনা হারায় এবং সে অল্পতে কোনমতে বেঁচে যায়। এত বছর পরেও মঞ্জট চিতলা রাজ্যের কথা বিন্দুমাত্রও ভুলে যায় নি। চিতলা রাজ্যের রাজা চিগু ও চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রসাঙ্কের সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। এটা সে কিছুতে মেনে নিতে পারল না। তাই মঞ্জট ঐদিন ঠিক করে একদিন সে চলদাজ রাজ্য আক্রমণ করে সবকিছু ধ্বংস করে দিবে। কিন্তু তার জন্য মঞ্জটের বিশাল সেনাবাহিনী প্রয়োজন। ইতিমধ্যে মঞ্জট লাগগিন্তা রাজ্যের সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় দশ লক্ষ করেছে। মহারাজ মঞ্জটের ইচ্ছা সে সেনা সংখ্যা পনের লক্ষতে করার জন্য—তাই সে প্রজাদের উপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। এদিকে সেনাবাহিনীর খরচ যোগাতে মঞ্জট প্রায় হিমশিম খাচ্ছে তাই বিশাল এই সেনাবাহিনীর খরচ যোগাতে মঞ্জট সাধারণ প্রজাদের খাজনা দিনের পর দিন বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। প্রজারা খাজনা দিতে অসমর্থ হলে লাগগিন্তার সেনাপতির নেতৃত্বে প্রজাদের উপর কঠিন নির্যাতন করা হচ্ছে। বহু লাগগিন্তাবাসী ইতিমধ্যে লাগগিন্তা রাজ্য থেকে পালিয়ে চলদাজ রাজ্যে চলে যায় এবং নিয়মিত প্রজারা লাগগিন্তা রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।  

গুপ্তচর সুনেন্দ লাগগিন্তা রাজপ্রাসাদে পৌছে মহারাজ মঞ্জটকে তার পুত্রের কঠিন প্রতিজ্ঞার কথা বলল। মহারাজ মঞ্জট এ কথা শুনে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। মঞ্জটের বিশ্বাস এসব কিছু চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রাসঙ্কের ষড়যন্ত্র। মঞ্জট মনে মনে চলদাজ রাজ্যের উপর প্রতিশোধ নিতে শীঘ্র আক্রমণ করার জন্য মনস্থির করে। কিন্তু মঞ্জট জানত যে চলদাজ রাজ্যে যুদ্ধে জয়ী হতে হলে শুধু সেনা সদস্য বৃদ্ধি করে চলবে না। তাকে দেবতাদের সাহায্য ও লাগবে। মঞ্জট আরো জানে তার উপর বর্তমানে দেবতারা খুশি নয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় অসম্ভব ‘পঞ্চযজ্ঞ’ করবে। চন্দ্রগ্রহের ইতিহাসে এই পর্যন্ত কেউ পঞ্চযজ্ঞ করে নি—তবে কথিত আছে পঞ্চযজ্ঞ করে সফল হলে পাঁচ দেবতা ( পাপ ও দুষ্কর্মের দেবতা কিতমু, অস্ত্রের দেবতা আম্ভু, সমুদ্র ও বৃষ্টির দেবতা জিনরু, ধন সম্পদের দেবতা শিশক্রু, এবং পর্বতের দেবতা কুন্ত্রা) অত্যন্ত খুশি হয় এবং তাদের দর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চযজ্ঞ করা দুঃসাধ্য। পঞ্চযজ্ঞটি এক সাথে পর্বত, সমুদ্র, এবং স্থলে করতে হয়। উপরন্তু যজ্ঞকারী কে এক সাথে তিনস্থানে বসে মন্ত্রগুলো একসুরে পাঠ করতে হয়। যদি কেউ পঞ্চযজ্ঞ শুরু করে শেষ না করে তাহলে যজ্ঞকারীর শরীর সাথে সাথে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়। মঞ্জট সবকিছু জেনেও মনস্থির করে সে পঞ্চযজ্ঞ করবে। এই পাঁচ দেবতার সাহায্য ছাড়া চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করে সে কখনো সফল হবে না। 

মঞ্জটের স্ত্রী সুনীতি একজন রাক্ষসী। রাক্ষসীরা স্বভাবত মায়া জানে—তাছাড়া রাক্ষসকূলে সুনীতি মায়ার রাণী হিসেবে পরিচিতি আছে। মঞ্জট তার পঞ্চযজ্ঞ করার কথা মহারাণী সুনীতি কে জানায়। সুনীতি প্রথমে মঞ্জটকে এই কঠিন যজ্ঞ করতে নিষেধ করে কিন্তু মঞ্জটের মনস্থির দেখে মহারাণী পরে রাজী হয়। মহারাণী সুনীতি বলল, ‘মহারাজ, আমি পূর্বে কখনো এমন মায়ার অনুশীলন করি নি। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। আমার আপনাকে নিয়ে প্রচণ্ড ভয় হয়। যদি আমার কোন ভুলের কারণে আপনার মৃত্যু হয় তাহলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। তাছাড়া আপনার মৃত্যুর জন্য লাগগিন্তা রাজ্যের সবাই আমাকে দায়ী করবে—যা মিথ্যে নয়। এই রাজ্য শাসন হীন হয়ে যাবে। মহারাজ দয়া করে একটু ভেবে দেখুন।’ মহারাণীর কথা শুনে মঞ্জটের মেজাজ গরম হয়ে যায়। মঞ্জট আর কোন কিছু শুনতে রাজী নয়। সে চায় যেভাবে হোক চলদাজ রাজ্যকে ধ্বংস করে দিতে—আর তার উপর চিতলা রাজ্যে অতর্কিত হামলার প্রতিশোধ নিতে। ‘বহু বছর ধরে আমি এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছি মহারাণী সুনীতি! চলদাজ রাজ্য আমার চাই!’ চিৎকার করে মঞ্জট মহারাণী সুনীতি কে বলল। মঞ্জটকে রাগান্বিত হতে দেখে মহারাণী সুনীতি রাজী হয়ে যায়। সুনীতি তখন মঞ্জটকে একটি শর্ত দেয়, ‘মহারাজ, আমার মায়া-শক্তি প্রয়োগ করে এই যজ্ঞে আপনাকে সাহায্য করতে রাজী। তবে আমার একটি শর্ত আছে।’ মঞ্জট একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তোমার শর্তটি বল।’ মহারাণী সুনীতি বলল, ‘মহারাজ, আপনি আমার স্বামী। আমি আপনাকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসি। আপনার মৃত্যু হলে আমি বাঁচতে পারব না। তাই আমি চাই আসল যজ্ঞ শুরু করার আগে আপনাকে নিয়ে কয়েক বার অনুশীলন করতে—এতে অন্তত নিশ্চিত হতে পারব।’ মঞ্জট রাণীর কথায় রাজী হয়ে যায়। 

পরেরদিন মহারাণী সুনীতি সহ মহারাজ মঞ্জট লাগগিন্তা রাজ্যের অধীনে একটি ছোট রাজ্য কুনিকা তে যায়। কুনিকা রাজ্যটির একদিকে বিশাল সমুদ্র, আরেকদিকে বিশাল এক পর্বত। মহারাজ প্রায় একলক্ষ সেনা নিয়ে কুনিকা তে যায়। কুনিকা রাজ্যের রাজা সিয়ন্ত মহারাজা মঞ্জটকে স্বাগত জানায়। রাজা সিয়ন্ত মহারাজ মঞ্জটের সাথে প্রায় এক লক্ষ সেনা দেখে ভয় পেয়ে যায়। কুনিকা রাজ্যর বাসিন্দা দুইলক্ষের বেশি হবে না। আর সেনা সংখ্যা মাত্র সাত হাজার। এত বিশাল সৈন্যবহর রাজা সিয়ন্ত পূর্বে কখনো দেখে নি। তাই মহারাজা মঞ্জটের সাথে বিশার সেনাবহর দেখে রাজা সিয়ন্ত ভয় পেয়ে যায়। মহারাজা মঞ্জট রাজা সিয়ন্তকে অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয়ের কোন কারণ নেই রাজা সিয়ন্ত। আমি তোমার রাজ্যে এসেছি পঞ্চযজ্ঞ করার জন্য’ প্রথমে এই যজ্ঞের অনুশীলন করব এরপর সঠিক সময়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করব। আমার এই বিশাল সেনাবহর তোমার রাজ্যের চারিদিকে পাহারা দিব যাতে করে আমার যজ্ঞে কোন প্রকার বাধার সৃষ্টি না হয়।’

চলবে...

লেখক: কবি ও লেখক, অধ্যাপক: অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগ, জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইর্য়ক, মনস্তাত্তিক বিভাগ, হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউইর্য়ক। কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা, নিউইর্য়ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)।