দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অছিম বাজাতে পারেন ১০টি বাদ্যযন্ত্র!

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:৫৬

নূরে আলম সিদ্দিকী নূর, বিরামপুর (দিনাজপুর)

চোখের আলো নেই মো. অছিম উদ্দিনের। তবে সুরের আলোয় আর দশজনকেও ছাড়িয়ে গেছেন। সুরকে ভর করেই চলছে তার জীবন-সংসার। নিজের প্রচেষ্টাই বাজাতে শিখেছেন দশটি বাদ্যযন্ত্র। শুধু তাই নয় গড়ে তুলেছেন সঙ্গীতের একটি দলও। গানের তালিমও দিচ্ছেন আগ্রহীদের।

দোতারার চিকন তারে কথা বাঁধেন অছিম। একের পর এক গাইতে থাকেন ‘এমন সময় ভাঙল আমার মনের ভুল/পাইলাম না তো জীবনের কোনো কুল’ কিংবা ‘কত সাধনার পরে ভালোবেসে পেলাম তোরে’সহ বিভিন্ন গান। তার গলায় এসব গান শুনে বিমুগ্ধ শ্রোতারা অছিমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু জন্মপ্রতিবন্ধী অছিম শ্রোতার সে ভালোবাসার দৃষ্টি দেখতে পান না।

অছিম উদ্দিনের জন্ম ১৯৬৮ সালে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী জোতবানী গ্রামের দরিদ্র পরিবারে। পিতা নজিম উদ্দীন ও মা সখিনা বেগম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে অছিম দ্বিতীয়। জন্মের দেড় বছরের মাথায় মা-বাবা জানতে পারেন আদরের সন্তান অছিমের দুই চোখে কোনো আলো নেই।দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে পিতার অভাব-অনটনের সংসারে অনেকটা অনাদরেই বেড়ে ওঠেন অছিম। স্কুলে পড়া তো দূরের কথা, স্কুলের বারান্দায় প্রবেশের সামান্যতম সুযোগ হয়নি অছিমের। অছিমের বয়স তখন বারো। অনাহার ও অনাদর যখন নিত্যসঙ্গী ঠিক তখন রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা নদীর ভাঙনে ঘরহারা বাউল শিল্পী আব্দুল হান্নান জীবিকার তাগিদে চলে আসেন অছিমের গ্রামের পাশের করমজি গ্রামে।

অছিমের জীবনে তিনি যেন অনেকটাই দেবদূতের মতো। কিশোর অছিমকে দেখে ভালো লেগে যায় বাউল হান্নানের। অছিমের খালি গলায় গানের সুর বাউলের মনে দাগ কাটে। অছিমের হাতে তুলে দেন একটি দোতারা। অছিমকে বাউল হান্নান বলেন, ‘দোতারার চিকন তারে গান তুলতে পারলে তোমার জীবনে আর কখনোই ভাতের অভাব হবে না’। এরপর দোতারার চিকন তারে টুংটাং শব্দের খেলা ও গানের তালিম নেয়া শুরু হয় অছিমের।

পরে বিরামপুর শহরে উদয়ন সংগীত ক্লাবে সংগীত গুরু গোপাল চন্দ্র রায়ের কাছে ভর্তি হন অছিম। গানের প্রতি আগ্রহ ও কণ্ঠ ভালো হওয়ায় সেখানে বিনা বেতনে গান শেখার সুযোগ পান অছিম। গান শিখতে শিখতে কেটে যায় চার বছর।

শুধু তাই নয় গান গাওয়ার পাশাপাশি অছিম বাজাতে পারেন দশটি বাদ্যযন্ত্র। দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে অনেকটা শখের বসে বাজাতে বাজাতে হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, দোতারা, তবলা, বাঁশের বাঁশি, মন্দিরা, খোল, কাঠি ঢোল, বেঞ্জু ও বেহালা বাজাতে পারদর্শী হয়েছেন অছিম।১৬ বছর বয়সে গ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। নিজের গ্রাম ছাড়িয়ে পাশের গ্রাম ও পরে বিভিন্ন শহরের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ হয়। তার মিষ্টি কণ্ঠের গানে মুগ্ধ গ্রাম-গঞ্জের শ্রোতারা।

২০১০ সালে স্থানীয় কাটলাবাজারে একটি সঙ্গীত স্কুল খোলেন অছিম। পরে সেটি শিক্ষার্থী ও অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। রাজশাহীর তানোর উপজেলার চৌবাড়িয়া বাজারে তার এক শিষ্য কাবিল হোসেনের অনুরোধে সেখানে গড়ে তোলেন একটি সংগীত স্কুল। ‘আমরা কজন শিল্পগোষ্ঠী’ নামের সেই স্কুলে বিভিন্ন  শ্রেণি-পেশার মানুষ শিক্ষার্থী।

অছিম গ্রামের বাড়ি জোতবানী থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে প্রতি মাসে তানোরে গিয়ে দুই দিন ক্লাস নিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন। আর নিজ গ্রামে জোতবানী যুব উন্নয়ন সমিতিতে বিকাল বা সন্ধায় সংগীতচর্চার আসরে এলাকার সংগীত অনুরাগীদের গানের তালিম দেন।

অছিমের শিষ্য বেনুপর গ্রামের তায়েব উদ্দিন বলেন, ‘আমার গুরু অছিম ভাইয়ের কাছে গান শিখছি। তার কাছে দোতারা ও হারমোনিয়াম বাজানো শিখছি। এলাকায় যেখানেই গানের আসর বসে সেখানেই আমি তার সঙ্গে যাই।’

প্রতি সপ্তাহে কোথাও না কোথাও গানের আসরে ডাক পড়ে শিল্পী অছিমের। আর এভাবে গান গেয়েই যা আয় হয় তা দিয়েই চলছে অছিমের সংসার। তার সংসারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে। গান থেকে আয়ের টাকায় দুই মেয়ের বিয়ে হলেও বড় মেয়ের ডিভোর্স হওয়ায় অছিমের সংসারেই থাকছেন তিনি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অছিমের কুঁড়েঘরে ভাঙা হাঁড়ির খবর জেনেশুনেই সংসারে বউ হিসেবে আসা স্ত্রী তাকে গান গাইতে উৎসাহ দেন।

অছিম জানান, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে তিনি লিখতে ও পড়তে না পারলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, রেডিও ও টেলিভিশনের সামনে বসে গান শুনতে শুনতেই প্রায় ৩০০-এর বেশি গান মুখস্থ করে ফেলেছি। আমি লোকসংগীত গাইতে বেশি পছন্দ করি।’

দেশের প্রায় ৪০টি জেলাতে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লালন সাঁই, লাল মিয়া বয়াতী, মাখম দেওয়ান, মুজিব পরদেশী ও রশিদ সরকারের গানগুলো গেয়ে শ্রোতাদের গানপাগল মনকে করেছে তৃপ্ত অছিম।

প্রত্যন্ত এক গ্রামের পরিবেশে গান শেখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ও গান গাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও অছিমের হৃদয়ে একটি স্বপ্ন সব সময়ই খেলা করে। আর তা হলো টিভি চ্যানেলে গান গাওয়ার ইচ্ছা।

অনেকে নিজ থেকে তাকে সেই সুযোগ দেয়ার আশ্বাস দিলেও সেকথা রাখেননি তারা। এক দিন টিভির পর্দায় গলা ছেড়ে গান গেয়ে মনের সেই আশা পূরণ করবেন- এমন আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন অছিম।

প্রবীণ ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গাফফার (বাবলু) বলেন, ‘কষ্টের সংসারে বেড়ে ওঠা শিল্পী অছিম গানের শিল্পী হিসেবে সবার মন জয় করেছে। আমাদের অছিম এক দিন বড় পর্দায় গান গেয়ে সবাইকে চমকে দেবে এমন স্বপ্ন আমরাও দেখি।’

(ঢাকাটাইমস/০৮ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/ডিএম)