ঢাকা টাইমসের সংবাদের পর পুলিশের হস্তক্ষেপে সেই মাকে নিলেন সন্তানরা

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:৫১ | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:১৭

সিরাজুম সালেকীন

মায়ের মৃত্যু হলে খবর দিতে বলা সেই সন্তানরা অবশেষে বৃদ্ধাশ্রম থেকে তাদের মাকে নিয়ে গেছেন। নিজেদের পরিচয় গোপন করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার প্রায় দুই বছর পর পুলিশ সদর দপ্তরের হস্তক্ষেপে স্থানীয় থানার মাধ্যমে রবিবার তারা মাকে বাড়ি নিয়ে যান।

গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে বৃদ্ধা আম্বিয়া খাতুনকে তার এক নাতনি পরিচয় গোপন করে ঢাকার মিরপুৃরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান। আম্বিয়া খাতুনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তারা ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের নিজেদের বাড়িতে থাকেন। তবে নব্বই পার করা শারীরিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলা বৃদ্ধা মাকে তারা ঠাঁই দেননি পরিবারে।

বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার ছয় মাস পর তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে মাকে একবার দেখতে যান। এরপর মায়ের আর কোনও খোঁজখবর নেননি তারা। সম্প্রতি আম্বিয়া খাতুনের অবস্থা সংকটাপন্না হলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানদের খবর দেয়া হয়। তবে তারা মাকে নিতে অস্বিকৃতি জানানোর পাশাপাশি বৃদ্ধার এক পুত্রবধূ বৃদ্ধাশ্রমের নির্বাহী পরিচালক মিলটন সমাদ্দারকে নানা রকম হুমকি দেন।

এই নিয়ে গত বুধবার ‘মা, মারা গেলে জানাবেন, লাশ নিয়ে যাবো’ শিরোনামে ঢাকা টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরের নজরে এলে এআইজি (মিডিয়া) মীর সোহেল রানা কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি এবিএম মশিউর রহমানকে দ্রুত সময়ের মধ্যে আম্বিয়াকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নিতে নিদের্শ দেন।

সদর দপ্তরের নির্দেশ পেয়ে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি গত শনিবার বৃদ্ধা আম্বিয়ার সন্তানদের খুঁজে বের করেন। তারপর রবিবার দুপুরে আম্বিয়া খাতুনের ছেলে ও পুত্রবধূকে নিয়ে মিরপুরের সেই বৃদ্ধাশ্রমে যান। সেখান থেকে বৃদ্ধাকে তার সন্তানদের কাছে বুঝিয়ে দেন ওসি। পরে পুলিশের সহায়তায় কামরাঙ্গীরচরে নিজের বাড়িতে ফেরেন সেই মা।

কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি এবিএম মশিউর রহমান এ প্রতিবদেককে বলেন, ‘বৃদ্ধার খবরটি ঢাকা টাইমসে প্রকাশের পর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মিডিয়া বিভাগের গোচরীভূত হয়। এরপর সদর দপ্তরের নির্দেশনা পেয়ে মানবিক বিষয়টির জন্য কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ কাজ শুরু করে।’

‘এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা স্যার সবসময় নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কিভাবে কাজ করতে হবে। আমরা বৃদ্ধার সন্তানদের খোঁজ করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্টে সন্তানদের নাম-ঠিকানা বিস্তারিত না থাকায় প্রথমে একটু বেগ পেতে হয়।’

ওসি মশিউর জানান, পুলিশ প্রথমে মিরপুর পাইকপাড়ার সেই বৃদ্ধাশ্রমটি খুঁজে বের করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন সমাদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু তার কাছেও বৃদ্ধার কোনও আত্মীয়ের বিস্তারিত নাম ঠিকানা ছিল না।

‘কিন্তু তার কাছে মিল্টনকে হুমকি দেয়া তিনটি নাম্বার পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে নাগরিক তথ্য ডাটাবেজের সাহায্যে বৃদ্ধা মহিলার ছেলে আলাউদ্দিনের ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়’Ñ যোগ করেন ওসি মশিউর।

তিনি বলেন, ‘আমরা বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে তার ছেলের সঙ্গে কথা বলি। এক পর্যায় তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। রবিবার মিরপুরের বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সন্তানরা আম্বিয়াকে নিয়ে যান। এসময় একটা অশ্রু সিক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।’

মানবিক এই ঘটনা পুলিশের মানবিকতার একটা অনন্য স্বাক্ষী হয়ে থাকবে বলেও মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মীর সোহেল রানা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সংবাদটি পড়ার পর নিজের মধ্যেই কেমন একটা কষ্ট অনুভব করেছিলাম। তবে পুলিশ হিসেবে আইন প্রয়োগের একটা সুযোগ ছিল। বিষয়টি ডিএমপির কামরাঙ্গীরচর থানার ওসিকে জানাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেন এবং প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বৃদ্ধা মা তার পরিবার ফিরে পাওয়ায় ভালো লাগা কাজ করছে।’

এদিকে বৃদ্ধা আম্বিয়া যে বৃদ্ধাশ্রমে ছিলেন তার প্রধান নির্বাহী মিলটন সমাদ্দার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বৃদ্ধার পরিবারকে তাদের মাকে নিয়ে যেতে বারংবার বলার পরও তারা রাজি হননি। উল্টো মা মারা গেলে খবর দিতে বলেছিলেন তারা।’

‘কিন্তু এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর পুলিশ সদর দপ্তর ও কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি আমার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতেন। পুলিশ বৃদ্ধার পরিবারকে নিয়ে এসে সবার উপস্থিতিতে সেই বৃদ্ধাকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন।’

উল্লেখ্য, নব্বই বছরের মতো বয়স আম্বিয়া খাতুন সন্তানদের নিয়ে কামরাঙ্গীরচরের বাড়িতে থাকতেন। পাঁচ বছর আগে পড়ে গিয়ে তার ডান হাত ভেযে যায়। হারিয়ে ফেলেন চলাফেরার শক্তি। হয়ে পড়েন মানসিক ভারসাম্যহীন। এরপর সন্তানদের কাছেও অচ্ছুত হয়ে যান এই মা।

গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে আম্বিয়া খাতুনের এক নাতনী গোপনে দাদিকে রেখে যান মিরপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। ছয়মাস পর সন্তানরা মাকে দেখতেও এসেছিলেন। তবে তারা মাকে নিয়ে যেতে রাজি হননি। উল্টো বৃদ্ধাশ্রমের লোকজনকেই হুমকি দেয়।

 

‘মা মারা গেলে বলবেন লাশ নিয়ে যাবো’

 

(ঢাকাটাইমস/০৮ডিসেম্বর/এসএস/ডিএম)