মহাবিশ্বের ধারণা বদলাচ্ছে, মানুষ বদলেছে কি?

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:২৮ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৮

হুমায়ুন কবির ভূইয়া
হুমায়ুন কবির ভূইয়া

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞানী দার্শনিকদের পর্যবেক্ষণমূলক মতবাদগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। যান্ত্রিক যুগে আকাশ-মহাকাশ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে এবং নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। এ বছর (২০১৯) তিনজন বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন মহাবিশ্বের ধারণা বদলে দিয়ে। সৌর জগতের বাইরে আরও একটি গ্রহের সন্ধান মিলেছে। সুইজারল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানী মাইকেল মেয়ব ও দিদিয়ারকুয়েলজ ১৯৬৪ সালে প্রথম ঘোষণা দেন যে তারা সৌরজগতের বাইরে একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছেন।

সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে মানুষের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জেগেছে এবং মানুষ তার উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আলোচনার নিবৃত্তি হয়নি, মানুষের জানার কৌতূহল আজও অপরিতৃপ্ত। এক যুগে যে মীমাংসা গৃহীত হয়েছে, পরবর্তী যুগে তাতে সংশয় জেগেছে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের বর্তমান সভ্যতায় পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় এসেছে। তাই বলে থেমে নেই মহাবিশ^ ভাবনার বর্তন-পরিবর্তন।

অবিরত এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যে কেবল সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবিদার মানুষের হিংসা, ক্রোধ, লোভ, নিষ্ঠুরতা, অহংকার একই রূপে বিদ্যমান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ধর্ম। নিত্যনতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে মানুষের ভেতরকার পশুত্ব। ফলে মানুষ ও পশুর উৎপত্তি মতবাদ ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বারবার উসকে দেয়।

পৃথিবী ও সূর্যের ঘূর্ণন দ্বন্দ্ব

পৃথিবী, আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে ধর্মীয়, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে। এই জ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস আছে। পৃথিবী শূন্যে কীভাবে অবস্থান করছে, এর ব্যাখ্যায় বলা হতো, বাসুকীর (সর্পরাজ) স্বীয় মস্তকে পৃথিবীকে ধারণ করে আছেন। এ জন্য হিন্দুধর্মের দেবতা মহাদেবের কাঁধে সাপ দেখা যায়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখাগুলোর অন্যতম। লিপিবদ্ধ ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন ব্যাবলনীয়, গ্রিক, ভারতীয়, মিসরীয়, নুরিয়ান, ইরানি, চীনা, মায়া ও বেশ কয়েকটি আমেরিকান আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নিয়মবদ্ধ পদ্ধতিতে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করত।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্যোতিমিতি, সেলেস্টিয়াল নেভিগেশন, পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পঞ্জিকা প্রণয়নের মতো নানা রকম বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্তর্গত।

গ্রিক রাশিচক্রের বিকাশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় কীভাবে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা একে-অপরের সঙ্গে স¤পর্কিত। সেই প্রাচীন যুগের অনেক জ্যোতির্বিদই জ্যোতিষী ছিলেন- এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার (গ্রিক) বহুশাস্ত্রবিদ ক্লডিয়াস টলেমি এবং তার সময় পর্যন্ত পৃথিবী স্থির এবং পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্ব ধারণা ছিল।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলিম জ্যোতির্বিদ জ্ঞানীদের অবদান কম নয়। আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.) অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তাধারার অধিকারী বড় দার্শনিক ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থ, রসায়ন ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তিনি পারদর্শী ছিলেন। কোপারনিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর আগে আল-বিরুনি বলে গেছেন, পৃথিবী বৃত্তিক গতিতে ঘোরে। তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অঙ্কের গণনায় ভুল ধরে দিয়ে তার সঠিক সমাধান দেন। তিনিই প্রথম অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ স¤পর্কে সঠিক ধারণা দেন। তিনিই প্রথম প্রাকৃতিক ঝরনা ও অরটোজিয়া কূপের রহস্য উ™ঘাটন করেন।

ফার্সি তথা বিশ্বসাহিত্যের মহান কবি, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানের মহানায়ক উমর খৈয়াম হিজরি পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সেলযুক যুগে জন্মগ্রহণ করেন। উমর খৈয়ামের বিজ্ঞান সাধনার ফিরিস্তি দিয়ে রচিত একটি একটি কিতাবে (বই) আল-কাত্তাজানি মন্তব্য করেন, কালের নিরিখে সেকালে বিজ্ঞান গবেষণার মূল্যায়ন ছিল না, তা নইলে উমর খৈয়ামই তার মানমন্দির থেকে প্রথম প্রমাণ করেছেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।

প্রাচীন বিজ্ঞানচর্চায় ধর্মের রক্তচক্ষু

প্রাচীন আমল থেকে চলে আসছে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, অর্থাৎ পৃথিবী স্থির। পৃথিবীকে ঘিরে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ টলেমির এমন সূত্রের বিরুদ্ধে রোমান শাসকরা ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসকে একটি বই লিখতে বলেন। কোপার্নিকাস ১৫১০ সালে বইটি লেখা শুরু করেন। ‘ঙহ ঃযব জবাড়ষঁঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঐবধাবহষু ঝঢ়বপরবং. ১৫৩০ সালে কোপার্নিকাস বইটি প্রকাশ করতে নিষেধ করেন, কারণ তিনি ধর্মগুরুদের চটাতে চাননি।

কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করতে গিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল দক্ষিণ ইতালির নোলা নগরে জন্ম নেওয়া জিওরদানো ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০)। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের দর্শনে ব্যুৎপত্তি লাভ করা এই দর্শনিকের কোপার্নিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের পর ক্যাথলিক ধর্মে তার বিশ্বাস শিথিল হতে থাকে। প্রকাশ্যে কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করেন এবং এতে তার শক্তি বেড়ে যায়। ধর্মযাজকদের ভয়ে তিনি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে বেড়ান।

মকানিগো (গড়পধহরমড়) নামের এক সম্ভ্রান্ত যুবকের নিমন্ত্রণে তিনি ভেনিসে যান। ওই বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ইঙ্কুইজিশনের (ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ আদালত) হাতে সমর্পণ করে। ৬ বছর তিনি কারাগারে বন্দী থাকেন। পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে- এই মতবাদ থেকে সরে আসার জন্য বিচারকরা চাপ দেন। কিন্তু তিনি সরে আসেননি। ইঙ্কুইজিশনের বিচারকরা তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ করেন এবং ১৬০০ সালে তাকে বর্তমান ভ্যাটিকান রাষ্ট্রের চত্বরে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়।

ইতালির সৌরবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও ৪০০ বছর আগে ১৬০০ সালে গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং অবলোকনের পর নিশ্চিত হন যে পৃথিবী স্থির নয়, তা সূর্যেরচারদিকে ঘোরে।

সূর্য নয় বরং পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে এ সত্য বলার জন্য ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে ধর্মীয় আদালতে দাঁড় করানো হয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি পুরোহিতদের বারবার বলেছিলেন- একবার আমার টেলিস্কোপে চোখ রাখুন, নিজের চোখে দেখুন। কিন্তু পুরোহিতরা তার কথা শোনা দরকার মনে করেনি। কারণ তাদের বিশ্বাস সত্য দেখা যায় না। তা ধর্মগ্রন্থে লেখা থাকে।

পৃথিবীর আকার ও কলম্বাসের অভিযাত্রা

পৃথিবীর আকার সম্বন্ধেও প্রাচীন মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। প্রাচীনতম গ্রিক দার্শনিক (৬৪০-৫৫০ (খ্রিষ্টপূর্ব) থেলিসের মতে, যাবতীয় পদার্থের আদি কারণ হলো জল। জল থেকেই সমস্ত পদার্থের উৎপত্তি এবং জলেই তাদের পরিণতি। থেলিসের শিষ্য আনমান্দার (৬৪৯-৫২৭ খ্রিষ্টপূর্ব) পৃথিবীকে নলের আকারবিশিষ্ট মনে করতেন। পৃথিবীর আদি কারণ বায়ু বা অগ্নি বলেও অনেকে মত প্রকাশ করেন।

পৃথিবীর আকার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের মতামত থাকলেও বর্গাকৃতির ধারণাই মানুষের মনে স্থান লাভ করেছিল। এ জন্য কলম্বাস (১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ) তার ভ্রমণের জন্য মানুষের সাহায্য পেতেন না। মানুষ ভাবত- ভ্রমণে বের হলে তিনি পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে নির্ঘাত মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। তখনকার ¯েপনের রাণী তাকে সাহায্য করেছিল। কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর আকার সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যায়। পৃথিবী যে গোলাকার এতে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞানী-দার্শনিকদের পর্যবেক্ষণমূলক মতবাদের দ্বন্দ্ব-মতভেদের মধ্য দিয়েই বারবার পরিবর্তিত হয়েছে পৃথিবী ও মহাবিশে^র ধারণা। যান্ত্রিক যুগে আকাশ-মহাকাশ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে এবং নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। এ বছর (২০১৯) বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া তিন বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের ধারণা আবার বদলে দিয়েছেন। সৌর জগতের বাইরে আরও একটি গ্রহের সন্ধান মিলেছে। সূর্য যে ছায়াপথের সদস্য সেই ছায়াপথ মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গার সদস্যা অপর একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে একান্ন পেগাসি বি নামের গ্রহটি। (সূত্র- এএফসি ও রয়টার্স, প্রথম আলো ৯ অক্টোবর ২০১৯)।

সভ্যতা ও মত  প্রকাশ

সভ্যতার চরম উ’সর্গের এই যুগে ধর্ম নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ কমে আসার কথা। এখন সাধারণ মানুষও যেকোনো ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারছে। পৃথিবীর সর্বত্র সব ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায়। তা হলে ধর্মীয় উন্মাদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? মিশর ও তুরস্ক, আফ্রিকা মহাদেশের বেশির ভাগ রাষ্ট্রে বিশেষ করে সিরীয়, ইরাক, আফগানিস্তাান, পাকিস্তান,  ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন- এসব দেশে ধর্মীয় কারণে হত্যা-নির্যাতন প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৃহ’ রাষ্ট্র ভারতে হিন্দুত্ববাদের জজবা তুলেছে দেশটির সরকার। তাতে নিগৃহীত হচ্ছে বিশেষ করে উসলাম ধর্মের লোকজন।

সত্যতা বিকাশের প্রধান উপাদান মানুষ ও প্রকৃতি। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষে মানুষে সংঘাতের জন্য তৈরি হচ্ছে নানা যুদ্ধাস্ত্র ও সমরাস্ত্র। এর সঙ্গে আছে ধর্মের অস্ত্র। মানুষ মরছে, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। সক্রেটিস বলেছেন জ্ঞানই শক্তি (কহড়ষিবফমব রং চড়বিৎ)। জ্ঞান-বিকাশের প্রধান উৎস হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ছাড়া প্রকৃত সত্য উ™ঘাটন সম্ভব নয়। ফরাসি কবি ও দার্শনিক ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেন- ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারি।’

পবিত্র কোরআন শরিফে সূরা-হুদ আয়াত ১১৮তে উল্লেখ আছে,  ‘(হে নবী) তোমার মালিক চাইলে দুনিয়ার সব মানুষকে তিনি একই উম্মত বানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কারো উপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেন না, আর এভাবেই তারা হামেশাই নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করতে থাকবে।’

এই মতবিরোধ থেকে সেই প্রাচীনকাল থেকে সৃষ্টিজগত ও তার কার্যক্রমের ধারণা নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। হিংসা-বিদ্বেষ আর হত্যা-নির্যাতনের কারণ হয়ে আছে চিরকালের জন্য। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- এ সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হকো, কামনা করি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া।