আইনের গ্যাঁড়াকলে আইনের মানুষ

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৪২ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০৩

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও নাজমুল হুদা (ফাইল ছবি)

আদালত অঙ্গনের একসময়ের ব্যাপক ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি এস কে সিনহা ও নাজমুল হুদা। বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। আর সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও আইন অঙ্গনের পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে। দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের। আইন অঙ্গনের এই দুই প্রভাবশালীই এখন আইনের গ্যাঁড়াকলে। দুজনেই দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামি হয়ে এখন বেকায়দায়।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ১৯৭৪ সালে আইনজীবী হয়ে লড়েছেন অনেক মক্কেলের পক্ষে। কোনো মামলায় হেরেছেন, আবার কোনোটাতে জিতেছেন। কিন্তু আইনি লড়াই করেই গেছেন। কখনো ফি নিয়ে, আবার কখনো ফি ছাড়া। একসময়কার তুখোড় এই আইনজীবী নিয়োগ পান বিচারপতি হিসেবে। প্রথমে হাইকোর্ট বিভাগে, পরে আবার আপিলে। একপর্যায়ে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের পর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সাজিয়েছিলেন নিজের পছন্দের লোক দিয়ে। যখন তার পতন হয়, তখন তার সেই পছন্দের কর্মকর্তাদেরও সরিয়ে দেয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায়।

এস কে সিনহা দেশ-বিদেশের অনেক আইনজীবী ও বিচারপতিদের শিক্ষা দিয়েছেন আইনি বিষয়ে। প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে খোরাক জুগিয়েছেন মিডিয়ার। এমন কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। ভুল হলে ইচ্ছামতো বকতে ছাড় দেননি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকেও। এজলাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও কথা বলেছেন প্রাণ খুলে। এমন কিছু কথাও বলেছেন, যাতে বিব্রত হয়েছে সরকার।

ভুলের কারণে তার আদালতে এসে সরকারের বড় বড় কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কেউ মাফ পেয়েছেন আবার কেউবা খালি হাতে ফিরতে পারেননি। সাজা মাথা নিয়ে ঢুকেছেন কারাগারে। তার আদালত সম্পর্কে মন্তব্য করায় এক সাংবাদিক ছয় মাসের জেলে খেটেছেন। সেই ক্ষমতাবান বিচারপতিই আবার রাতের আঁধারে দেশ ত্যাগ করেছেন। দেশের বাইরে গিয়ে পদও ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকি দেশে ফেরারও সুদিন নেই তার। শেষ পর্যন্ত মামলা খেয়েছেন দুর্নীতি ও বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে। তাহলে এটাই কি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস?

সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী সাজা হতে পারে?

ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণ হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার যাবজ্জীবন সাজা হতে পারে। দুদকের মামলায় দণ্ডবিধির ১০৯, ৪০৯ ও ৪২০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযোগ আনা হয়েছে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনেও।

আলোচিত মামলাটির তদন্তে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়ে বুধবার অভিযোগপত্র অনুমোদন দেয় কমিশন। এখন সেটি আদালতে জমা দেয়া হবে। এরপর অভিযোগ গঠন হলে শুরু হবে বিচারকাজ। মামলায় ধারা ৪০৯-এ বলা আছে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক অথবা ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা প্রতিনিধি কর্তৃক অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ। এ অপরাধটি প্রমাণ হলে যাবজ্জীবন সাজা অথবা দশ বছর মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম সাজা হতে পারে।

ধারা ৪২০-এ বলা আছে প্রতারণা ও সম্পত্তি অর্পণ করার জন্য অসাধুভাবে প্রবৃত্ত করা। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজার কথা বলা হয়েছে সাত বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড। আর ১০৯ ধারায় অপরাধে সহায়তা করা প্রমাণিত হলে অপরাধ সংঘটনকারীর অনুরূপ সাজা ভোগ করতে হবে।

গত ১০ জুলাই দুদকের জেলা সমন্বিত কার্যালয় ঢাকা-১ এ এই মামলাটি করা হয়। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২), (৩) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ঋণ জালিয়াতি এবং চার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছাড়াও আরও ১০ জন এ মামলার আসামি। তাদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকেরই রয়েছেন ৬ জন।

পলাতক সিনহার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হবে যেভাবে

সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হবে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাপ্তাহিক এই সময়কে বলেন, ‘অভিযোগপত্র এখন আদালতে যাবে। আদালত চার্জশিটের ওপর শুনানি করবে। আদালত সন্তুষ্ট হলে এটি আমলে নেবে। তারপর বিচারের কাজ শুরু হবে। যেসব ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেখানে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ রয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী। দেশের বাইরে থাকায় এস কে সিনহা আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন না জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘আদালত তার নিজস্ব বিধি অনুযায়ী চলবে। উনি দেশের বাইরে মানে পলাতক। পলাতক অবস্থায় আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন না।’

২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেয়া ঋণের চার কোটি টাকা বিচারপতি সিনহার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢোকার অভিযোগ ওঠে। এরপর অভিযোগের তদন্তে নামে দুদক। প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ার পর এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

যেভাবে তোপের মুখে পড়েন সিনহা

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। সেখানে তার বাড়ি নির্মাণের বিষয় নিয়েও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।

এমপির টিকিটও পেলেন না, মামলাও খেলেন হুদা

ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী, ২০০১ সালের যোগাযোগমন্ত্রী। একসময় আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু বেফাঁস কথার হোতা। বেঁফাস কথা নাজমুল হুদা বলেছেন বিএনপি এবং তার দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে নিয়েও। আর এর কারণেই বহিষ্কার, দলে ফিরিয়ে নেয়া, আবার বহিষ্কার, নতুন দল গঠন, নিজ দল থেকে বহিষ্কার আর আবার নতুন দল গঠন তার। সেই দলের নামেও আবার বিএনপি আছে। সঙ্গে যোগ করেছেন তৃণমূল শব্দটি।

আবার আওয়ামী লীগও তার অপছন্দের দল নয়। তিনি এক টেলিভিশনের টক শোতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রাচীন দল হিসেবে যে ভিত্তি, তা গণতন্ত্র সুসংগঠিত করার জন্য বিরাট বড় শক্তি। তার ভেতরে আরও একটা বিরাট শক্তি থাকা উচিত, যা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। এভাবে আমি বিএনপিকে দেখার চেষ্টার করেছি।’

এ সময় একজন দর্শক নামজুল হুদাকে প্রশ্ন করেন, ১৪ দলে যোগ দেয়ার বাসনায় মন্ত্রিত্ব পাওয়ার লোভে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিত্বের লোভ তো আমার নেই। এমপি হয়ে ২০টি বছর, মন্ত্রী হয়ে কাটিয়েছি ১০টি বছর। যতবার মন্ত্রী-এমপি হয়েছি, দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি এবং কাজ করেছি। ভবিষ্যতে যদি মন্ত্রী হবার কোনো সুযোগ থাকে হব, সেটা কাজ করার জন্যই।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করে এমপিও হতে চেয়েছিলেন তিনি। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে স্থিতিশীল রাজনীতিকে স্থায়ী করার জন্য দল করেছি। দেশের মানুষ শান্তি চায়। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও এই প্রজন্মের মানুষ চায় না। এসব বন্ধে যদি ১৪ দলের গিয়ে বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে সাহায্য করতে পারি, সেই উদ্দেশ্যে আছে আমাদের।’

এমন ঘোষণা দিয়ে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বাহবা পাওয়ার জন্য। কিন্তু বিধি বাম। এমপিও হলেন না, মামলাও খেলেন। শেষ বয়সে কী অবস্থা হয়, সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের।

সিনহার বিরুদ্ধে মামলা করে আইনের প্যাঁচে নাজমুল হুদা

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করায় এবার ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বুধবার কমিশন এ মামলার অনুমোদন দেয়। পাশাপাশি মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এস কে সিনহাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক।

কোন প্রেক্ষাপটে সিনহার বিরুদ্ধে হুদার মামলা?

গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন নাজমুল হুদা। মামলার এজাহারে তিন কোটি ২৫ লাখ টাকা উৎকোচ (ঘুষ) নেওয়ার দাবি করেছিলেন তিনি। দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলা হওয়ায় মামলাটির তদন্ত করে দুদক। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এ জাতীয় মিথ্যা মামলা দায়ের করায় নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে কমিশন ২০০৪-এর ২৮(গ) (২) ধারায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করার অনুমোদন দিয়েছে। বৃহস্পতিবার কমিশনে এ মামলাটি করা হয় বলে জানা গেছে।

দুদক সূত্র জানায়, ওই মামলার তদন্তে নাজমুল হুদার অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। মামলাটি কাল্পনিক সাজানো ঘটনা মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এবং এজাহারকারী অসৎ উদ্দেশ্যে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য মিথ্যা মামলাটি রুজু করেছেন বলেও প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের সুপারিশ করেন। এবং একই সঙ্গে নাজমুল হুদা জেনেশুনে অসৎ উদ্দেশ্যে এজাহারে বর্ণিত মিথ্যা ঘটনার সৃষ্টি করে মামলাটি রুজু করায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন, ২০০৪ এর ২৮(গ) (২) ধারায় একটি নিয়মিত মামলা রুজু করার আবেদন করেন। পরে কমিশন নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে মামলাটির অনুমোদন দেয়।

হুদার মামলায় সাজা কী?

ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে দুদক যে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে কী ধরনের সাজা হতে পারে, এমন বিষয়ে কথা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৪-এর ২৮(গ) (২) ধারায় নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বনিম্ন ২ ও সর্বোচ্চ ৫ বছরের সাজা হতে পারে।

নাজমুল হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী, ২০০১ সালের যোগাযোগমন্ত্রী। একসময় আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু বেফাঁস কথার হোতা। বেঁফাস কথা নাজমুল হুদা বলেছেন বিএনপি এবং তার দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে নিয়েও। আর এর কারণেই বহিষ্কার, দলে ফিরিয়ে নেয়া, আবার বহিষ্কার, নতুন দল গঠন, নিজ দল থেকে বহিষ্কার আর আবার নতুন দল গঠন তার। সেই দলের নামেও আবার বিএনপি আছে। সঙ্গে যোগ করেছেন তৃণমূল শব্দটি।

(ঢাকাটাইমস/এআইএম/জেবি)