মুক্তি পেল ‘নিরপরাধ’ সেই কিশোর, ফুলে ফুলে বরণ

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:১৫

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ‘নিরপরাধ’ কিশোরটি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। গত ১৬ জুন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। প্রায় ছয় মাস কারাভোগ করার পর রবিবার রাতে সে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পায়।

সোমবার সকালে সে তার নিজ গ্রাম পুঠিয়া উপজেলার রামজীবনপুরে গেলে গ্রামের মানুষ তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এ সময় সে আবেগে কাঁদতে থাকে। পরে ছেলেটি নিহত নুরুল ইসলামের কবর জেয়ারত করে। নুরুল ইসলামের মেয়ে নিগার সুলতানা ছেলেটিকে নিজের বাবার কবর চিনিয়ে দেন।

গত ১১ জুন পুঠিয়ার কাঁঠালবাড়িয়া এলাকার একটি ইটভাটা থেকে শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই নিহতের মেয়ে নিগার সুলতানা বাদী হয়ে পুঠিয়া থানায় আটজনকে আসামি করে এজাহার দেন। ওই এজাহারে বলা হয়, মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বীরা এ হত্যাকাণ্ড করে। কিন্তু ওই এজাহারটি গ্রহণ করেননি পুঠিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাকিল উদ্দিন আহমেদ।

নিগারের অভিযোগ, পরবর্তীকালে তাকে ডেকে নিয়ে জব্দ তালিকা, সুরতহাল প্রতিবেদনসহ কিছু সাদা কাগজের উপর স্বাক্ষর নিয়ে রাখে পুলিশ। পরে ওই সাদা কাগজেই এজাহার টাইপ করে থানায় তা রেকর্ডভুক্ত করা হয়। পরে ১৬ জুন ১৫ বছর বয়সের এই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এরপর জেলা পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নিহত শ্রমিক নেতা নুরুল এই কিশোরের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হতেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়েই সে ইটের আঘাতে নুরুলকে হত্যা করে। এসব বিষয় স্বীকার করে সে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে।

তবে যৌনাচারের জন্য কিশোরের হাতে খুন হওয়ার বিষয়টি শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছিল নিহতের পরিবার। তারা বলছে, মূল আসামিদের বাঁচাতে ও ঘটনা ভিন্নখাতে নিতেই এই কিশোরকে ‘বলি’ দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তের দায়িত্ব পান রাজশাহীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদার।

সরেজমিন তদন্ত করে তিনি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেন।

এর ভিত্তিতে গত ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেন। এতে শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার বাদীর মূল এজাহার গ্রহণ না করে মনগড়া এজাহার সৃজনের সঙ্গে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত হন থানার তৎকালীন ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদ। থানার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ, যা দণ্ডবিধির ১৬৬ ও ১৬৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও রায় দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, এ দুটি ধারার অপরাধ দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের তফসিলভুক্ত। এ কারণে ওসি সাকিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও আনুষাঙ্গিক নথি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর জন্য রাজশাহীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

একইসঙ্গে গত ১১ জুন নিগার সুলতানার দেয়া মূল এজাহারটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেদিন হাইকোর্ট বলেছেন, শ্রমিক নেতা নুরুল হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় এক শিশু। রাজশাহীর পুলিশ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। কিন্তু শিশু আইনের ৮১ ধারা অনুযায়ী শিশুর স্বার্থের পরিপন্থি কোন ছবি বা তথ্য গণমাধ্যমে বা ইন্টারনেটে প্রচার করা যাবে না। যা দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়। এ বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার দেয়া ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়।

আদালত আরও বলেন, এ ঘটনায় একজন শিশুর জবানবন্দি প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করে রাজশাহীর পুলিশ-প্রশাসন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন এবং আইন ভঙ্গ করেছেন। তাই শিশু আইন সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের সচেতনতামূলক ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ প্রয়োজন। এ বিষয়ে আইজিপিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বরই হাইকোর্টে ওই কিশোরের জামিন হয়। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে জামিনের আদেশের কপি এসে পৌঁছায় রবিবার বিকালে। সেদিনই রাতে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরিবারটি প্রত্যাশা করছে, নিরপরাধ এই কিশোর যেন মামলার অভিযোগ থেকে দ্রুত অব্যাহতি পায়। আর যেন আইনের আওতায় আসে মূল অপরাধীরা।

(ঢাকাটাইমস/৯ডিসেম্বর/এলএ)