ট্রাক্টর নিয়ে বিপাকে কৃষক!

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:০৪

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস, শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে। তাই দেশের কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় জোর দিচ্ছে সরকার। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা শরিকানার ভিত্তিতে হালচাষের জন্য বড় ধরনের ট্রাক্টর কিনছেন প্রান্তিক কৃষক।

এই যন্ত্রযান দিয়ে কৃষক জমি চাষ করছেন, আবার স্থানীয়ভাবে পণ্য পরিবহনও করছেন তারা। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেক সময় পণ্য পরিবহন করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হয়রানির শিকার হন ট্রাক্টর মালিকরা। ফলে ট্রাক্টর কিনে সংকটে পড়ার কথা বলছেন কেউ কেউ।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমান। কৃষিকাজের জন্য একটি ট্রাক্টর কেনেন তিনি। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ট্রাক্টরগুলো জমিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাকি সময় খুব বেশি ব্যবহার হয় না। কৃষিকাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে ট্রাক্টর দিয়ে মালামাল পরিবহন করে কিছু আয় করেন ট্রাক্টর কেনার টাকা তুলতে।

আব্দুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বছরে এক মাসের মতো কাজ থাকে জমি চাষ ও ফসল মাড়াইয়ে। আমরা এ ট্রাক্টর কিনেছি ১০ লাখ টাকা দিয়ে। খরচ ওঠাতে ট্রাক্টর দিয়ে মালামাল টানার কাজ করা হয়। মাঝেমধ্যে তেল নিতে শহরে যেতে হয়। এ সময় জেলা সদরের সড়ক পার হতে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হতে হয়।‘

ট্রাক্টর নিয়ে তারা এখন সংকটে পড়েছেন বলে জানান আবদুর রহমান। বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি এমন যে ট্রাক্টর ব্যবহার করে শুধু জমি চাষ করলে আমাদের চলছে না। এখন আমরা সংকটে পড়েছি। সরকার আমাদের ট্রাক্টর ব্যবহারের জন্য যেন সুনির্দিষ্ট একটা নীতিমালা করে দেয়, যাতে আমরা হয়রানির শিকার না হই।’ 

কম সময়ে কম খরচে অধিক জমি চাষে সামর্থ্যবান কৃষকদের অনেকেই ব্যবহার করেন ট্রাক্টর। লাঙল দিয়ে বহু শ্রমে হাল চাষের বিকল্প হিসেবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে জমি চাষে বাড়ছে এই প্রযুক্তির ব্যবহার। কিন্তু যাদের অল্প জমি, তাদের শুধু হাল চাষে পোষায় না বলে কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাক্টর। পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে কোনো নীতিমালা না থাকায় হযরানির শিকার হতে হয় বলে বেশি দামে ট্রাক্টর কিনতে উৎসাহ কমছে কৃষকদের মধ্যে।

তাদের ভাষ্য, শুধু জমি চাষ করার জন্য বড় ধরনের ট্রাক্টর কিনে তাদের পোষায় না। জমি চাষের পাশাপাশি তাদের ট্রাক্টর দিয়ে স্থানীয়ভাবে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দিলে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো কৃষিকাজ শতভাগ যান্ত্রিকীকরণের আওতায় আসেনি। চাষাবাদে উৎপাদন খরচ কমানো ও মাটির গুণাগুণ ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ট্রাক্টর। তাছাড়া শ্রমিক সংকট মেটাতেও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে যন্ত্রটির। জমি তৈরি ছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহন ও বহুমুখী ব্যবহারে কৃষকের আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে ট্রাক্টর।

এগ্রিকালচারাল ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার ট্রাক্টর কার্যকরভাবে চালু রয়েছে। তবে কিছু এলাকায় এই ট্রাক্টর এখন মালিকের জন্য ভীতির কারণ হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে গত কয়েক মাস ধরে চলতে দেয়া হচ্ছে না ট্রাক্টর। ট্রাক্টর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা, তেলের পাম্প থেকে তেল নিতে গেলে কিংবা কোনোভাবে সড়কে উঠলে আটক করা হচ্ছে ট্রাক্টর।

অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রয়োজনের সময় চলাচলে বাধার কারণে ট্রাক্টর বিক্রি বন্ধ থাকলে সরকারের যান্ত্রিকীকরণে চলমান ভর্তুকি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। তাদের মতে, এক বছরের মধ্যে ট্রাক্টরগুলো লাইসেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। কীভাবে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামকৃষ্ণ বর্মন ঢাকা টাইমসকে জানান, ট্রাক্টরগুলো মূলত কৃষিকাজের জন্য আমদানি করা হয়। এখন সেগুলো পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বালু উত্তোলনের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। আমরা কৃষকদের মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করেছি। বালু উত্তোলন ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করলে আমরা এ বিষয়ে মানবিকভাবে বিবেচনায় করব।’ 

‘কৃষকরা ট্রাক্টরগুলো অনেক সময় ঋণ নিয়ে কিনে থাকেন। আমরাও চাই কৃষকরা ট্রাক্টরগুলো ব্যবহার করে তাদের পরিবার চালাক।’ বলেন ইউএনও।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক শেখ মো. নাজিম উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা কৃষকের সমস্যার কথা বিবেচনা করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে বিভিন্ন অংশিজনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। এ নিয়ে সরকার একটা নীতিমালা করছে। শুধু ট্রাক্টর ব্যবহার নয়, সারা দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে নীতিমালায় উল্লেখ থাকবে।’ শিগগির এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হবে বলে জানান তিনি।

দেশের বাজারে ট্রাক্টর সংযোজন, আমদানি ও বিপণন করছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ট্যাফে, এসিআই মোটরসের সোনালিকা, র‌্যানকন ও কর্ণফূলী লিমিটেডের মাহিন্দ্র, মেটাল প্লাসের আইসার, পারফরমেন্স মোটরসের স্বরাজ, গেটকোর নিউ হল্যান্ড, ইফাদ অটোসের এসকর্ট ও এনার্জিপ্যাকের জন ডিয়ার ব্রান্ডের ট্রাক্টর বাজারে রয়েছে।

দ্য মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল বলেন, বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এ তিন মাস ট্রাক্টর বিক্রির সময়। কিন্তু এবার সারা দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। ট্রাক্টর চালানোর ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে তা দ্রুত সমাধান করতে হবে। চালকদের লাইসেন্সিং করা এবং গাড়িগুলো রেজিষ্ট্রেশন করার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে কৃষকের মনে আস্থাহীনতা তৈরি হবে। এতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/মোআ)