রংপুরের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদশা

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৯:২২

মোন্তাশির পারভেজ (অংকুর)

বীরমুক্তিযোদ্ধা মরহুম এ কে এম ফজলুল হক (বাদশা)। বয়স তখন ১৫ থেকে ১৬ বছর। টগবগে এক তরুণ। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান বাদশার ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে বড় হবে, চাকরি করবে। কিন্ত দেশ তখন পরাধীন। উর্দু ভাষায় কথা বলা, অন্য দেশের কথা মতো চলা। এরকম পরাধীনতা অন্য দেশপ্রেমিক বঙালির মতো তারও ভালো লাগছিল না।

শেখ মুজিবুর রহমানের কন্ঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক এলো। তার বন্ধুরা যখন দেশের জন্য যুদ্ধে যাচ্ছেন তখন ঘরে বসে থাকলেন না কিশোর বাদশা। দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রণাঙ্গনে।

মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরে (রংপুর –দিনাজপুর) সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী, বোদাসহ বিভিন্নস্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

সে সময় সদ্য তরুণ ছিলেন বাদশা। তাই ভারী অস্ত্র হাতে তাকে যুদ্ধ করতে দেয়া হয়নি। তার কাজ ছিল হানাদারদের ঘাঁটি, তাদের যাওয়া-আসার বিভিন্ন ব্রিজে বোমা পুতে রাখা। এরপর সময় বুঝে তা বিষ্ফোরণ ঘটানো।

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়। তখন লাল-সবুজের পতাকা হাতে যে যার ঘরে ফেরে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। গাজীর বেশে সেদিক ঘরে ফিরেছিলেন বাদশার বন্ধুরা। সবাই যখন বিজয়ের হাসি হাসছে তখন টাইফয়েডে জ্বরে অসুস্থ হয়ে বাদশা পরে ছিলেন দহগ্রাম ট্রানজিট ক্যাম্পে।

যুদ্ধের শেষ সময় দিন-রাত বৃষ্টিতে ভিজে শত্রু পক্ষের ক্যাম্প বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন রংপুরের সূর্য সন্তান ফজলুল হক বাদশা। টানা বৃষ্টি ভেজার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

এদিকে মা-বাবাসহ বাড়ির সকলে ভেবেছিলেন তাদের ছেলে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বাড়িতে খবর আসে বাদশা বেঁচে আছেন। খবর পেয়ে ক্যাম্প থেকে অসুস্থ অবস্থায় তার পরিবারের লোকেরা তাকে নিয়ে আসেন। মার বুকে ফিরে আসে তার বীর সন্তান। যদিও সেদিন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো বিজয়ের উল্লাস করা হয়নি ফজলুল হক বাদশার। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল দেশ মুক্তির তৃপ্ততা, ঠোটের কোণে ছিল বিজয়ের হাসি।

যুদ্ধের পর সুস্থ হয়ে তিনি লেখাপড়া শেষ করেন। যোগদান করেন সরকারী চাকুরীতে। এরপর রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মেয়ে মমতা পারভীন রেখার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। মেয়ে সোহানা তানভীন। ছেলে মোন্তাশির পারভেজ (অংকুর) রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমাণ্ডের সদস্য।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের ভারি অস্ত্রের মোকাবেলা অনায়াসেই করেছিলেন এই রণাঙ্গনের বীর। যুদ্ধ জয় করা এই বীরের মৃত্যু হয় সড়ক দূর্ঘটনায়। ২০১৬ সালের ৬ই জুলাই সড়ক দুর্ঘনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান তিনি। রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করা হলে একদিন পর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম ফজলুল হক বাদশা রংপুর সদর উপজেলার তপোধনের বাহার কাছনা গ্রামে ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কাদের মিয়া ও মা ছাহেরা খাতুন ছেলে বাদশা ১১ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন ষষ্ঠ। তার বেড়ে ওঠা রংপুর শহরের শালবনে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

বাদশা মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। তার পরিবারের আরও দুই ভাই যুদ্ধ করেন মুজিব বাহিনীতে। তাদের একজন বৃহত্তর রংপুর জেলা মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) এর ডিস্ট্রিক্ট লিডার মুকুল মোস্তাফিজ। অন্যজন একই বাহিনীর আজিজুল ইসলাম।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মোন্তাশির পারভেজ (অংকুর)