আমার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৩ মার্চ

মো. নুরুল আলম
| আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:০৭ | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৩
মো: নুরুল আলম

৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমি চট্টগ্রাম রওনা করি। ৯ মার্চ আমার অঞ্চলে আমি প্রথমে ঘোষণা দিলাম ‘আমাদের এক দফা এক দাবি ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই। বঙ্গবন্ধু বলেই দিয়েছেন যার যা যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ তারপর থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে দুটি রাইফেল নিলাম। রাঙ্গুনিয়াতে আমরা ১২ মার্চ রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করি। আমরা প্রায় ৪৫ জনকে দিয়ে প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করি। আমাদের হাইস্কুলের পাশে ‘জাগৃতি সংঘ’ নামের ক্লাবটা ব্যবহার করতাম। উপজেলা হেডকোয়ার্টারের পাশে পাহাড়ে উঠে দুই রাউন্ড ফায়ার করে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। বললাম, ‘আজ থেকে আমাদের যুদ্ধ শুরু।’ ১৩ মার্চ নিজেরাই যুদ্ধে নেমে পড়ি। চট্টগ্রামে যেখানে এখন রাইফেল ক্লাব, সেখানে সরকারিভাবে অস্ত্র-গুলি মজুদ ছিল। আমরা ওগুলো ভেঙে নিয়ে চলে আসি। তারপর যতগুলো বন্দুকের দোকান ছিল, যত কার্তুজ পাওয়া গেছে সব আমরা সার্চ করে নিয়ে চলে এসেছিলাম।

১২ মার্চ আমাদের কাছে খবর আসে। কাপ্তাই লেক ও কর্ণফুলী পেপার মিল এই দুই জায়গায় যুদ্ধ লেগে গেছে। ওখানে ইপিআরের ঘাঁটি ছিল। ওখানে বিহারি, পাকিস্তানি আর্মি, নেভির সদস্যরা একজোট হয়ে বাঙালিদের হত্যা করছে। আবার বাঙালিরাও তাদের পেলে হত্যা করতো। তখন যুদ্ধ লেগে গেছে। এমন সময় আমাদের কাছে খবর আসে তারা (পাকিস্তানিরা) একত্রিত হয়ে আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করতে আসবে। তখন আমার বাবার লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল সেটা নিয়ে নিলাম। মোট তিনটা বন্দুক জোগাড় করলাম, কার্তুজ জোগাড় করলাম। দা, কুড়াল, খন্তা এগুলো নিয়ে তাদের দিকে গেলাম যুদ্ধ করার জন্য তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে। আমরা গোলাগুলি শুরু করলাম। দেখি অনেক বিহারি পালাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক রাইফেলে ছিল ২০ রাউন্ড গুলি। ১২-১৪ রাউন্ড গুলি শেষ হয়ে যায়।

১৩ মার্চ এটাই আমার জীবনে প্রথম সশস্ত্র মুক্তির জন্য যুদ্ধ। ওখান থেকে ফিরে আসতেই শুনলাম আমাদের অঞ্চলে পাকিস্তানি আর্মি ঢুকে গেছে। মানুষ পালাচ্ছে। তারপর আমি এবং আমার বন্ধু দুজনে মিলে ৭০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে চলে গেলাম রামগড়ে। সেখান থেকে ২ মে সকালে আমরা ভারতে চলে গেলাম। আগরতলায়। সেখানে হরিনা ক্যাম্পে গেলাম। তারপর দেরাদুনায় ট্রেনিং করেছি প্রথম ব্যাচে। সেখানে তান্দুয়া ক্যাম্পে ট্রেনিং করি। জুলাই মাসের ২৮ তারিখ রওনা করি আগরতলা থেকে। ফিরে আসি ১ তারিখের আগস্টে। তারপর অনেক অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। যেমন অপারেশন মোগলের দীঘি, অপারেশন ভোমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী অপারেশন, অপারেশন গোমাই বিল প্রভৃতি। অপারেশন গোমাই বিলের ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমার ওপর শেখ ফজলুল করিমের নির্দেশ ছিল কর্ণফুলী পেপার মিল ও কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু কাপ্তাই যাওয়া আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ খাঁড়া পাহাড় তারপর পাকিস্তানিদের নিচ্ছিদ্র ঘেরাও ছিল। তখন গোমাইর বিলের মাঝদিয়ে যে বিদ্যুতের লাইন গেছে সেটার তিনটি খুঁটি বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করি।

অপারেশনটা ছিল রাত ১২টা ১ মিনিটে। সেদিন মনে হয়েছিল এ অঞ্চলে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে। এটা ১৪ আগস্টের ঘটনা। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে প্রথম অপারেশন ছিল এটা। এসময় আর্মি মিলিটারিরা ঘোষণা দেয়। বলা হয় কেউ কমান্ডার নুরুল আলমকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার দেওয়া হবে। এলাকার কোব্বাত চেয়ারম্যান আমাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তার ইউনিয়ন পরিষদ আমি অপারেশন চালিয়ে উড়িয়ে দেই। এটাও রাঙ্গুনিয়ার অনেক অপারেশনের মধ্যে বড় একটা অপারেশন।

মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে দুদিন ধরে মাইকিং করে প্রচার করা হয় যে, কোব্বাত চেয়ারম্যানকে ধরা হয়েছে। হাইস্কুলের মাঠে প্রায় ২০ হাজার লোকের সামনে সব দোষ সে স্বীকার করে। সে সরাসরি ৬টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সে আর্মি দিয়ে বরুয়াপাড়া ঘেরাও করে ধর্ষণ করায়। সেখানে একজন ডাক্তারকে গুলি করে মারে। সবশেষে জনতার সবাই তার মৃত্যুদণ্ড চায়। তখন আমরা তাকে ওই স্পটে দাঁড়িয়ে ফায়ার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করি।

মো. নুরুল আলম: অতিরিক্ত আইজিপি (অব.)

অনুলিখন: শেখ সাইফ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :