আমার বড় মামার কথা

প্রকাশ | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৩৬ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:১৮

আলী কবীর

আমার বড় মামা মরহুম আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত ওরফে সিদ্দিক মিয়া ছিলেন একজন ঋষিতূল্য মানুষ। আমার মাতামহ মরহুম আব্দুল খালেক সেরনিয়াবাত ওরফে রাঙ্গা মিয়া ওরফে বড় মিয়ার প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। তার দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন আমাদের ছোট মামা মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ওরফে টিপু। এই দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন ছিলেন আমার মা বেগম আশরাফুন নেসা সেরনিয়াবাত ওরফে খুকী। তিন ভাই বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠা। আমাদের কোনও খালা ছিল না।

আমাদের নানী বেগম হুরুন নেসা গোপালগন্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের মেয়ে ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে নানা-নানীর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তার মাতুলালয় টুঙ্গিপাড়া শেখ সাহেবদের বাড়ীর নাজির সাহেব নামে খ্যাত শেখ লুৎফর রহমান ওরফে লাল মিয়ার তৃতীয় কন্যা আমেনা বেগম ওরফে হেলেন এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইনিই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোন, জনাব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মা এবং আমাদের ছোট মামী।

আমাদের বড় মামা তার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে বরিশাল শহরের কালিবাড়ী রোডে বিখ্যাত গোলপাতার ঘরে তার ছোট ভাই ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর সংসারে বসবাস করেছেন। সেই সময় বড় মামী তার বাকী ছেলে মেয়েদের নিয়ে তার শ্বশুড় শাশুড়ী অর্থাৎ আমাদের নানা-নানীর সঙ্গে নানার পৈতৃক বাড়ীতে বসবাস করতেন।

জীবনের সুদীর্ঘ সময় বড় মামা জেলা কালেক্টরেটে স্বল্প বেতনের একটি পদে চাকরি করেছেন। অত্যন্ত সাধারণ ও সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। তার ছোট ভাইয়ের মত তিনিও খুবই সাধারণ মানের খাবার খেতে অভ্যস্ত ছিলেন।

সারাটা জীবনই মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। কালেক্টরেট থেকে বাড়ি করার জন্য প্রতীকী মূল্যে দেওয়া জমিটি ভাগ করে অর্ধেক ছোট ভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে দিয়েছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় বরিশালের সেরাল গ্রামে মামাদের এবং আমাদের পাশাপাশি দুটি বাড়ী হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা জ্বালিয়ে দেয়। মামাদের বরিশাল শহরের কালিবাড়ী রোডের বাড়ীটি লুন্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু এত জুলুমের মধ্যেও মামার ৬ ছেলের মধ্যে ৪ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। বাকী দুইজন ছিল নাবালক।

এর পরে আসে মহা দূর্যোগের দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। মামা একই দিনে হারান তার নয়নের মনি, জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত ওরফে ঝিলুকে। আরো হারান আদরের ছোট ভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে, মেয়ে, জামাতা, নাতি সহ পরিবারের তিন প্রজন্মের সদস্যদের।

ঝিলু ভাই ছিলেন আমাদের প্রজন্মের প্রথম সদস্য, আমাদের সব চেয়ে বড় ভাই। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে আইনজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি ঢাকায় বেড়াতে এসে মিন্টো রোডে তার চাচা বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে উঠেছিলেন। দেশদ্রোহী ঘাতকরা যখন তাদের উপর গুলি চালায় তখন ঝিলু ভাই তার চাচার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। আর শিশু ভ্রাতুষ্পুত্র সুকান্ত বাবু ছিল ঝিলু ভাইয়ের কোলে। তিন প্রজন্মের তিন প্রতিনিধি এক সঙ্গে নিহত হন মর্মান্তিক ভাবে। এ ছাড়া মারা যান আরও পাঁচ জন।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে অকালে হারিয়ে মামার পরিবারের পথে বসে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু সেই সব দূর্যোগও এই পরিবার কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় সকলের সমবেত চেষ্টায়। কিন্তু এবারে যে আক্রমণ এসেছে এই পরিবারের প্রয়াত অভিভাবকের উপর তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত, দূর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাজনক। একটি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের প্রধান এবং চারজন মুক্তিযোদ্ধার পিতাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অত্যন্ত নির্লজ্জ ভাবে। এটা গোটা জাতির জন্য একটি কলঙ্ক।

শুধু ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়। বিষয়টি তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে এই কলঙ্কের পুনরাবৃত্তি না হয়।

লেখাটি আলী কবীরের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত