চিনি খাব নাকি খাব না

আবুল কাশেম, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:৩৬

যারা বেশি মিষ্টি খায় তারা টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সুগারের দোষ হতে পারে না। এক গবেষণায় এমন তথ্য পেয়েছে বিবিসি।

এখন কল্পনা করা কঠিন, কিন্তু এমন একটি সময় ছিল যখন এক বছরের মধ্যে কয়েক মাস শুধুমাত্র ফল খেয়েই বেঁচে থাকতো মানুষ। যখন ফলের মৌসুম থাকতো, অনেক সময় ফল খেতে পাখির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতো তারা।

কিন্তু বর্তমানে চিনিজাতীয় জিনিস বছরের সব সময়েই আমাদের পাশে থাকে। অনেক সময় কম পুষ্টিকর মান এবং অনেক বেশি সহজেই চিনি মিলে থাকে। কোমল পানীয় বা খাদ্যশস্যের বাক্সের মধ্যে এসব চিনি থাকে। এটা দেখার জন্য বিশেষজ্ঞের দরকার হয় না যে, আদিম যুগের তুলনায় আমাদের আধুনিক সময়ের চিনি কম স্বাস্থ্যবান।

বর্তমানে চিনি জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু। সরকার এটির ওপর কর বসাচ্ছে, স্কুল ও হাসপাতালগুলো থেকে ভেন্ডিং মেশিন অপসারণ করা হচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞরা নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা থেকে চিনিকে বাদ দিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এত দূরে এসেও বিজ্ঞানীরা এটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, কিভাবে এটি আমাদের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। চিনি যা আমাদের কাছে ‘যুক্ত চিনি’ নামে পরিচিত। খাদ্য এবং পানীয়কে আরো স্বাদযুক্ত বানানোর জন্য টেবিল চিনি, মিষ্টি, মধু এবং ফলের রসজাতীয় জিনিস মিশ্রণ করা হয়।

কিন্তু চিনি প্রকৃতপক্ষে জটিল এবং সহজ উভয় কার্বোহাইড্রেটগুলোর জন্য একটি বিস্তৃত শব্দ যা গ্লুকোজের মধ্যে পচন দ্বারা ভাঙা হয় ও শরীরের প্রতিটি কোষে শক্তি উৎপন্ন করে এবং মস্তিষ্ককে শক্তি জোগায়। কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটগুলোতে শস্যদানা এবং সবজি রয়েছে। সাধারণ কার্বোহাইড্রেটগুলো খুব সহজে জারিত হয় এবং দ্রুত রক্তে চিনি ছড়িয়ে দেয়। আমরা সাধারণত যেসব খাবার খাই তার মধ্যেই চিনি রয়েছে। যেমনÑ ফ্রুক্টোজ (ফল শর্করা), ল্যাকটোজ (দুগ্ধ শর্করা), সুক্রোজ (ইক্ষু বা চিনি জাতীয় শর্করা) এবং গ্লুকোজ ও অন্যান্য। এছাড়া রয়েছে উচ্চ ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ কর্ন সিরাপ যা মানুষ তৈরি করেছে।

১৬ শতকের পূর্বে শুধুমাত্র ধনীদের সমর্থ ছিল চিনি কেনার। কিন্তু পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের কারণে তা আরো সহজলভ্য হয়ে ওঠে। তারপর ১৯৬০ এর দশকে গ্লুকোজের বড় আকারের রূপান্তরের ফলে ফ্রুক্টোজকে কেন্দ্র করে উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ, গ্লুকোজের প্রবর্তন ঘটে। এই শক্তিশালী সংমিশ্রণের কারণে সুগারের একক টাইপকে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটিই একটা কারণ যখন মানুষ চিনি নিয়ে চিন্তা করে।

চিনি রশ্মি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে অন্যান্য খাদ্যের তুলনায় উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপের ব্যবহার দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন যে, এই কারণে বিশ্বব্যাপী স্থূলতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি হয়তো হতে পারে, কারণ অন্যান্য খাবারের বিপরীতে উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ লেপ্টিনে (একটি হরমোন যা আমাদের পূর্ণাঙ্গ হতে সহায়তা করে) বৃদ্ধি পায় না।

আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর সুগারের প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। ৮৮টি গবেষণার বিশ্লেষণ করে চিনি এবং শরীরের ওজন বৃদ্ধির একটি সংযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতার পাশাপাশি কোমল পানীয় এবং চিনিযুক্ত পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপের কারণে স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন কথার সঙ্গে অনেকেই একমত নন। কিছু বিশেষজ্ঞ নির্দেশ করেছেন যে, গত দশ বছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে চিনির খরচ অনেক কমেছে। তবে চিনির খরচ কমলেও স্থূলতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। এছাড়া উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপের উপস্থিতি একেবারেই নেই এমন দেশগুলোতেও স্থূলতা ও ডায়াবেটিস মহামারি রূপ নিয়েছে। যেমনÑ অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ।

উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ কর্ন সুপ শুধুমাত্র সুগারের কারণেই সমস্যাযুক্ত নয়। চিনিযুক্ত, বিশেষ করে ফ্রুক্টোজ বিভিন্ন সমস্যার জন্য দায়ী। তাদের মধ্যে একটি হলো হৃদরোগ। যখন লিভার কোষগুলো ফ্রুক্টোজগুলোকে ভাঙে, তখন এর মধ্যে থাকে ট্রাইগ্লিসারাইড (ফ্যাটের একটি ফর্ম), যা সময়ের সঙ্গে লিভারে কোষ তৈরি করতে পারে। পরে এটি রক্তকণিকার প্রবাহে যুক্ত হয়। এরপর ধমনীর দেয়ালের ভেতরে চর্বি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

১৫ বছর ধরে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা তাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় ক্যালোরির চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি গ্রহণ করে তাদের হার্টের সমস্যার কারণে বেশি মৃত্যু হয়। আর যারা ১০ শতাংশ বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করে তাদের মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। টাইপ টু ডায়াবেটিসের জন্যও চিনিযুক্ত খাবার দায়ী। ১৯৯০ এর দশকে দুই বড় গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন একাধিক নরম পানীয় বা ফলের রস খাওয়া মহিলাদের ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ ছিল।

মিষ্টি কি কিছুই না? তবুও চিনি আসলে হার্ট সমস্যা ও ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী কি না তা এখনো অস্পষ্ট। লুসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেহতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লুক টাপি অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন যিনি যুক্তি দেন যে, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের মূল কারণ অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করা। আর চিনি কেবল এর একটি উপাদান।

তিনি বলেন, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এনার্জি গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এটি চর্বি জমায়, ইনসুলিন প্রতিরোধ করে এবং একটি ফ্যাটি লিভার তৈরি করে। বেশি শক্তি ব্যয় হলে বেশি এনার্জি গ্রহণ করলেও সমস্যা হয় না। যদিও উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও চিনি গ্রহণ করা হয়।

এক্ষেত্রে টাপি উদাহরণ হিসেবে অ্যাথলেটদের কথা উল্লেখ করেন। তারা উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত খাবার খেলেও তাদের কার্ডিওভাস্কুলার রোগের মাত্রা খুবই কম। উল্টো আরো উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ খাবার তাদের অনুশীলনের সময় কাজে দেয় এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যায়, টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা এবং ক্যানসারের জন্য সুগারের দায় খুবই কম। হ্যাঁ উচ্চমাত্রায় চিনি গ্রহণ এই রোগগুলোর জন্য দায়ী।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, চিনি আমাদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্নের সেন্টার ফর হিউম্যান সাইকোফার্মাকোলজির এক গবেষক সহকর্মী ম্যাথিউ পেস এ বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। পেস বলেন, যারা বেশি ফলের রস বা নরম পানীয় পান করেন তারা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অন্য খাদ্যতালিকাগত বা জীবনধারা অভ্যাস ভাগ করে নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কম ব্যায়াম করতে পারে।

এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, চিনি এমনকি বৃদ্ধ বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের অল্প পরিমাণে গ্লুকোজ ধারণকারী একটি পানীয় দিয়েছেন এবং বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তির বিভিন্ন পরীক্ষা করেছেন। অন্য অংশগ্রহণকারীদের কৃত্রিম মিষ্টান্ন ধারণকারী একটি পানীয় দেওয়া হয়।

এর ফলাফলে দেখা যায় যে, চিনি খাওয়ার কারণে বয়স্ক ব্যক্তিরা পূর্ণ ক্ষমতায় কঠিন কাজগুলো করতে আরো বেশি অনুপ্রাণিত হতে পারেÑ তাদের মতোই তারা কঠিন চেষ্টা করে। রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির কারণে তাদের কাজের সময় আরও সুখী করে তোলে।

এছাড়া দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে গ্লুকোজ পানীয় শক্তি বৃদ্ধি করে, কিন্তু এটি তাদের মেজাজ বা স্মৃতিকে প্রভাবিত করে না। বর্তমানে প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ শতাংশ চেয়ে চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ উচিত নয় বলে নির্দেশ প্রদান করা হয়। খাদ্য বিশেষজ্ঞ রেনে ম্যাকগ্রেগর বলেছেন, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্য প্রত্যেকের জন্য আলাদা। আসলে খাদ্যতালিকা থেকে চিনিকে বাদ দিয়ে দেওয়াটা বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। এমন হতে পারে চিনি বাদ দিয়ে আপনি হয়তো অতিরিক্ত ক্যালরি-সমৃদ্ধ কোনো খাদ্য বেশি খেতে শুরু করলেন, তাতে ক্ষতিই বেশি।

আমরা স্বাস্থ্যকর ফল যাতে শর্করা আছে তার সঙ্গে কোমল পানীয়কে গুলিয়ে ফেলছি, যাতে বাড়তি শর্করা ছাড়া কোনো পুষ্টিকর উপাদান নেই। তাহলে আমরা চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার মানেই তা খারাপ- ব্যাপারটা এরকম নেতিবাচক চিত্রিত করি কেন?

জেমস ম্যাজিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান লেভিনোভিৎজ বলছেন, এর একটা কারণ হলো, আমরা যে জিনিসটার আকর্ষণ ঠেকাতে পারি না, সেটাকেই অশুভ হিসেবে চিত্রিত করি। এজন্য চিনি গ্রহণ বাদ নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/১৯ডিসেম্বর/একে/এসএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :