সন্ধ্যার বিউটি, স্বপ্নযাত্রার সদরঘাট এবং আমরা
প্রকাশ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:১২ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:৩৮
কবি-গদ্যকার পিয়াস মজিদ জীবনের প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর পার করেছেন। ২১ ডিসেম্বর ছিল তার জন্মদিন। উদ্যাপনের আয়োজন ছিল হিম বিকেলে।
কদিন ধরেই শীতের শহর ঢাকা। উত্তরের চেয়ে কুয়াশা বেশি রাজধানীতে। শীতও বেশি। ঠিরঠিরিয়ে কাঁপছে প্রাণ। এই হিমলাগা বিকেলে পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে জড়ো হয়েছিল সাহিত্যপ্রাণ মানুষগুলো। ‘পৃথিবীতে পিয়াসের প্রথম পঁয়ত্রিশ’। ‘রাতলিপি দিনলিপি’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক বিউটির উঠোনে গোছানো আয়োজন।
সন্ধ্যার মন্দা আলোয় ভিন্নরূপ পেয়েছিল বিউটি বোর্ডিং। হলদে দালানে কোথাও কোথাও জড়িয়ে আছে শ্যাওলা বসন। সীমানা প্রাচীর ঢেকে গেছে লতাগুল্মের আভরণে। কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি আমগাছ বেয়ে সবুজলতা তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে চূড়ায়। শোকের বাণী বুকে নিয়ে চেয়ে আছেন বিউটির সদ্যপ্রয়াত কর্ণধার তারক সাহা।
দুঘণ্টা হাতে নিয়ে রওনা হয়েছিলাম শ্রীশদাস লেনের বিউটির পথে। সারাপথ এলাম নির্বিঘ্নে। বাসটি পল্টনে পৌঁছতেই কেমন বরফ হয়ে গেল। টানা একঘণ্টা, এগোলো না এক চুলও। যানজটের বরফ আর সহসা গলছে না দেখে নেমে গেলাম। হেঁটে এসে জিপিওর মোড় থেকে চড়লাম অন্যবাসে। আগে যাবো বলে। দুমিনিট পর বাসটি গোলাপ শাহ্’র মাজারের সামনে পৌঁছতে সেই জট। ফুটপাতের পসরা নেমে এসেছে পথে। শীতবস্ত্রের সম্ভার। ফলের দোকান। খোলা খাবারের দোকান তো আছেই। মানুষের মাথা খাচ্ছে মানুষ। বেচাকেনাও হচ্ছে দেদারে। ওদিকে মাজারের ভক্ত-আশেকানরা পথের ওপর পাশে জবুথবু হয়ে বসে আছেন।
দুপাশের জনাকীর্ণ পথ ঠেলে চাকাগুলো ইংলিশ রোডে নেমে যেতে সময় লাগলো আরও ঘণ্টা খানেক। সভাস্থলে যখন পৌঁছেছি তখন ঘড়ির কাঁটা পাঁচ ধরতে মরিয়া। সূর্যবিহন দিনে আলো-আঁধারির আয়োজন। চেনা-অচেনামুখ। যাকে ঘিরে আয়োজন তিনি বসে আছেন অতিথি চেয়ারে। কালো শাল পাট করে রাখা কাঁধে। পরনে পাঞ্জাবি।
সম্মানিত অতিথি হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক শওকত ওসমানের ছোটছেলে জাঁ-নেসার ওসমান, ঢাকা ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাশেম সুফিসহ অন্যরা। তরুণ লেখক আজহারুল হক ফরাজীর অনবদ্য সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান তখন এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ। খানিক বাদে এলেন কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার ভাই। তিনিও যানজটে আটকে ছিলেন দীর্ঘসময়। পল্টন থেকে বাংলাবাজার যেতে লেগেছে একঘণ্টা। তবুও হাল ছাড়েননি। এসেছেন। তার সহকর্মী, অনুজ পিয়াস মজিদকে শুভেচ্ছা জানাতে।
অতিথিদের শুভেচ্ছা বচনে ছিল পিয়াস মজিদের জন্য শুভ কামনা। পরিচয়পর্বের টুকরো স্মৃতি। তার লেখালিখি বিষয়ে আলোচনা। পঁয়ত্রিশ বছরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কবি এখনো একা—এই তথ্যেও বিস্ময় জানালেন দু-একজন। আগামী শীতে কবিকে যুগল জীবনে দেখতে চেয়ে আশীর্বচনও করলেন কেউ কেউ। কবি পিয়াস পুরো আয়োজনটিকে উৎসর্গ করলেন প্রয়াত তারক সাহার স্মরণে। স্মরণ করলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কলকাতার কবি বন্ধু আকাশলীনাকে, দুজনই তখন মহাজাগতিক যাত্রায়।
একে একে অতিথিদের বক্তৃতা পর্ব ফুরিয়ে গেলে কেক কাটা হলো। শেষে বিউটি বোর্ডিংয়ের বিখ্যাত লুচি-সবজি ভোজ।
বিউটির টেবিলে লুচির অপেক্ষা। এক টেবিলে চার চেয়ার। আমি ছাড়া বাকি তিনজন গল্প করছেন। আমি শ্রোতা। একসময় সামনের মানুষটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যালো, আমি জাঁ-নেসার ওসমান।’ আমি সম্মান নিবেদন করে নিচের পরিচয় দিলাম। বললাম, ‘আপনি কথা বলছিলেন বলে বিরক্ত করিনি। আমি আপনাকে চিনি।’ মনি হায়দার ভাই পাশে ছিলেন। জাঁ-নেসার ওসমান তার দিকে আঙুল ইশারা করে বললেন, ‘মনি হায়দার। আমি ওর স্কুল জীবনের বন্ধু। তাহলে বুঝে নিন ওর কত বয়স হয়েছে। হা হা হা।’ মুহূর্তে রসিক মানুষটি তাঁর শিশুর মতো সরল মনটাকে মেলে ধরলেন। তারপর নানা প্রসঙ্গে কথা বললেন। জানুয়ারিতে তার পরিচালিত একটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হবে। জানালে সে কথাও।
শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে জাঁ-নেসার ওসমান গায়ে চাপিয়েছেন বেশ কয়েকটি শীতবস্ত্র। মনি ভাইয়ের দৃষ্টি এড়োনো গেল না। বললেন, ‘আপনি শীতের কাপড় কয়টা গায়ে দিয়েছেন?’
জাঁ-নেসার ভাই হাসতে হাসতে বললেন, গুলিস্তান থেকে পরতে পরতে এসেছি। একেক মোড়ে আসি আর শীত বেশি লাগে। একটা কিনে গায়ে দিই। তারপর আরেক মোড়ে এসে আরও একটি। এভাবে কিনতে কিনতে আর পরতে পরতে এসেছি, হা হা হা। ’
হাশেম সুফিও তরুণ বয়সের স্মৃতিচারণ করলেন। লুচি-সবজি টেবিলে এলো। স্বাদ নিতে ব্যস্ত সবাই। খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘সবজিটা বেশ হয়েছে। এর আরেকটা নাম আছে, জানো তো?’
জাঁ-নেসার ওসমান জবাব দিলেন, ‘লাবরা।’
‘হ্যাঁ।’
ভোজ-আড্ডা শেষ হওয়ার পর মনি ভাই বললেন, চলো সদরঘাট থেকে ঘুরে আসি। আমি বাংলাবাজার এলে প্রায়ই ওখানে যাই। কাউকে না পেলে একাই ঘুরি।
মনি ভাই বলতে অমত করলাম না। কারণ আমার শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সদরঘাট। অনেকদিন যাওয়া হয় না। দীর্ঘদিন ওদিকটায় না যাওয়ায় বদলে যাওয়া সদরঘাট দেখা হয়নি। ছোটবেলায় যখন বাবার হাত ধরে গ্রামের বাড়িতে যেতাম, তখনকার সদরঘাট আর এখনকার সদরঘাটে রাত-দিন তফাত। টার্মিনালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। চকচকে পাথরের ফ্লোর, দেয়াল। লম্বা করিডোর। ইট-পাথরের ছাদ। এসবের কিছুই ছিল না তখন। ছিল টিনের চালের অন্ধকার ছাউনি। রোদ-ঝড়ে যাত্রীদের একমাত্র আশ্রয় ছিল তা।
ডাঙা থেকে পন্টুনে নেমে যাওয়ার ঝুলন্ত পথটিতে ছিল কাঠের পাটাতন।এখন সেখানে কনক্রিটের আস্তরণ। ইস্পাতের অবয়ব। পন্টুনের এমাথা ওমাথায় তাকিয়ে বুঝলাম, দৈর্ঘ্যও বেড়েছে কয়েকগুণ। সারি সারি লঞ্চ ভিড়ে আছে ঘাটে। আরে বাহ্! লঞ্চগুলোও একেকটি যেন আলিশান অট্টালিকা। কী সুন্দর বর্ণিল আলোয় সেজেছে। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে লেখা আছে নাম। উজ্জ্বল বাতির আলো এসে পড়ছে পন্টুনে। কুয়াশাছান্ন রাত টুটে গেছে সেই প্রভায়। নিশীথ সূর্যের দেশ হয়ে উঠেছে সদরঘাট।
সুন্দরবন-১১ লঞ্চটি বুড়িগঙ্গার অর্ধেকটা নিয়ে লম্বা হয়ে আছে। এত বিশাল! এত লম্বা! ছাদে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, একটি ফুটবল মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।
মনি ভাই মুঠোফোনের ক্যামেরায় ধারন করছেন খণ্ড খণ্ড ব্যস্ত সদরঘাট। সারি সারি লঞ্চের রঙিন আলোর রেখা তখন দিগন্তে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ঝাল দিয়ে চানাচুর খেতে চাইলে, চানাচুর বিক্রেতা জানালেন, ‘মরিচ দিতে পারুম। পিয়াইজ হইবো না।’
‘কিন্তু পেঁয়াজের দাম তো কমেছে।’ মনি ভাই বললেন।
‘আমাগো মুন্সীগঞ্জে কমে নাই স্যার। গত কাইলো ১৬০ টাকায় পিয়াইজ কিনছি। এতদাম দিয়া পিয়াইজ দিলে পুষায় না।’ চানাচুর বিক্রেতা অপারগতা প্রকাশ করলেন।
ঘড়ি তখন আটটায়। রাত বাড়ছে। শীতও বাড়ছে। বৃষ্টির মতো কুয়াশার মিহিদানা উড়ে আসছে উত্তর থেকে। ঘাটে ভিড়ছে লঞ্চ। মানুষের সমাগমের শব্দ ছাপিয়ে বজ্রনাদে পোঁ পোঁ শব্দে ডেকে উঠছে কোনোটি। ঘণ্টা বাজিয়ে জানান দিচ্ছে, ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। লস্করেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন আলাত (মোটা দড়ি) গুটিয়ে নিতে। কাঠের সিঁড়িটাও তুলে নেওয়া হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার কালো জলের বুকে যান্ত্রিক ঢেউ তুলে স্বপ্নময় মানুষ নিয়ে ভেসে যাচ্ছে দু-একটি লঞ্চ।সময় হলে সবাইকে যেতে হবে—কেউ চিরকাল থাকতে আসেনি। এ যেন সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ব্যক্তিগত স্মৃতির হাতড়ে মনি ভাই বললেন, ‘১৯৮২ সালে যখন এখানে নেমেছিলাম, তখন পন্টুন ছিল খুবই ছোট। এখনো চোখে লেগে আছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।’ তারপর তার চোখ দুটো হারিয়ে গেল, যাত্রীদের ভিড়ে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনমনা হয়ে বললেন, ‘ এই যে এত মানুষ, সবারই তো স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন নিয়ে আসে। স্বপ্ন নিয়ে ফিরে যায়। সবার স্বপ্ন তো আর পূরণও হয় না। ভেঙেও যায়। কী অদ্ভুত খেলা।’ নজরুলের সেই সুর সহসা মনে পড়ল—‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/ বিরাট শিশু আনমনে/ প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা/ নিরজনে প্রভু নিরজনে।’
ঘুরতে ঘুরতে আমরা এলাম চাঁদপুরের ঘাটে। এখান থেকে চাঁদপুরের লঞ্চগুলো ছেড়ে যায়। ঘাটে তখন একটি লঞ্চ। পন্টুনেরশেষ মাথায় ভিড়ে আছে গ্রিন লাইনের একটি লঞ্চ। আদলটা তিমির মতো। যেন একটা মস্ত তিমি জলে ভেসে আছে। ওদিকটায় এগোতে নজর কারলো জলে ভাসা রেস্তোরাঁ। ইঞ্জিনের নৌকাটিকে সাজানো হয়েছে কাগজের জাতীয় পতাকায়। বোঝাই যাচ্ছে, কদিন আগেই ছিল বিজয়দিবস। উপলক্ষ সেটাই।
ভেতরে রেস্তোরাঁ। রান্না হচ্ছে। গলুই ধরে নেমে গেলে এগিয়ে এলেন এক তরুণ। বললেন, ‘খাবার নেই। শেষ হয়ে গেছে।’ বললাম, ‘খাবার নয়, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ মনি ভাই জানতে চাইলেন, ‘এখানে ক্রেতারা আসেন কিনা?’ সাঈদ নামের ছেলেটি জানালো, ‘আসে। তবে গ্রিনলাইনের যাত্রীরাই মূলত তার ক্রেতা। সকালে একঘণ্টায় চলে নাস্তার আয়োজন। দুপুরে ভাত, মাছ অথবা মুরগি।’ কথায় কথায় বললেন, আড়াই লাখ টাকায় কেনা এই নৌকাটি কিনেছেন তার বাবা। এই ভাসমান রোস্তোরাঁ তার হাতেই শুরু হয়েছে। তিনি বাইরে গেছেন। সম্ভবত বাজারে।’
রাত সাড়ে আটটার দিকে চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা বোগদাদীয়া-৭ লঞ্চটি এসে ভিড়তেই, শত শত মানুষ পিঁপড়ের মতো বেরিয়ে আসতে থাকলো। খানিক আগেও প্রায় নির্জন পন্টুন মুহূর্তে পদচারণায় মুখর হয়ে উঠলো। ঘরে ফেরার সেই কী ব্যস্ততা মানুষের। কেউ কেউ লম্বা সারি এড়াতে জানালা গলিয়ে বেরিয়ে আসছে পাশের সরু পথ বেয়ে। তীরের দিয়ে উঠে যাওয়া মানুষের মিছিল দেখে আমাদেরও মনে পড়লো, ঘরে ফেরার কথা। ধীর পায়ে আমরাও মিলিয়ে গেলাম ব্যস্ত পায়ের মিছিলে। স্বপ্নযাত্রার সদরঘাট তখন আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা ফিরে আসছি শীতরাতের খন্ডকালীন স্মৃতি নিয়ে।
..............................
৭ পৌষ ১৪২৬