শশীকাহন: পৌরাণিক উপাখ্যান: ফ্যান্টাসি থ্রিলার সিরিজ, পর্ব- তের

ড. রাজুব ভৌমিক
 | প্রকাশিত : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৪৯

যুবরাজ শিহিল দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে চলদাজ রাজ্যে রাজপ্রাসাদের যুদ্ধকক্ষে যুদ্ধবিষয়ক পরিকল্পনা করার জন্য সবাইকে ডাকল। একে একে মন্ত্রী, মহারাজ রাসঙ্ক, সেনাগুরু কিবন, শিহিল পুত্র তৃষ, এবং সেনা কমান্ডাররা যুদ্ধকক্ষে আসল। যুবরাজ শিহিল প্রথমে তার সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ‘লাগগিন্তা রাজ্যের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুধু সময়ের ব্যাপার। আপনারা সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকুন—এবং সেনাদের যুদ্ধের জন্য শীঘ্রই প্রস্তুত করুন।’ যুবরাজ কমান্ডারদের বলল। এরপর যুবরাজ শিহিল সেনাগুরু কিবনকে বলল, ‘সেনাগুরু, আমি আপনার দায়িত্বে এক-লক্ষ সেনা দিতে চাই। আপনি এই এক-লক্ষ সেনা নিয়ে রাজ্যের সকল মন্দির পাহারা দিবেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। যখনি আপনার সেনাদের প্রয়োজন হবে তখন আপনার কাছে সংবাদ পৌঁছে দিব।’ সেনাগুরু কিবন যুবরাজ শিহিলের কথার কোন অর্থ বুঝতে না পেরে বলল, ‘যুবরাজ যুদ্ধ ঘটতে যাচ্ছে লাগান্ত এলাকায়—তাহলে কেন আমি এবং আমার সৈন্যরা মন্দির পাহারাতে চলদাজ রাজ্যের মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট করব?’

শুধু যুবরাজ শিহিল এবং মহারাজ রাসঙ্ক জানে যে চলদাজ রাজ্যে দেবতাদের মন্দিরের মূল্য আসলে কত। কারণ দেবতা কিতমুর দেয়া বর অনুযায়ী যতদিন চলদাজ রাজ্যে সব দেবতাদের মন্দিরে পূজা হবে ততদিন কোন শক্তিই চলদাজ রাজ্য দখল করতে পারবে না। মহারাজ রাসঙ্ক ইশারা দিয়ে যুবরাজ শিহিলকে জানাল যেন যুবরাজ সেনাগুরু কিবনকে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলে। যুবরাজ শিহিল তখন সেনাগুরু কিবনকে বলল, ‘গুরুদেব, দয়া করে আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। সময় হলে আমি আপনাকে এ সব নিয়ে খুলে বলব। দয়া করে আপনি ও আপনার সেনারা চলদাজ রাজ্যের সব মন্দিরের সুরক্ষার দায়িত্বটি নিন।’ কিবন আর অযথা কোন কিছু না বলল না। ‘ঠিক আছে—তাই হবে।’ কিবন বলল। যুবরাজ শিহিল বলল, ‘আমার পুত্র তৃষও মন্দিরের সুরক্ষার কাজে আপনাকে সহযোগিতা করতে যাবে।’ এ কথা শুনে তৃষ খুব খুশি হয়। এরপর যুবরাজ শিহিল তার বাকি চার লক্ষ সেনাকে দুই ভাগে ভাগ করল। দুই লক্ষ সেনা যুবরাজ তার নিজ দায়িত্বে রণভূমিতে নিয়ে যুদ্ধ করবে আর বাকী দুই-লক্ষ সেনা মহারাজ রাসঙ্ক যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাবে। মহারাজ রাসঙ্ক তার সেনা নিয়ে ডান দিক থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ করবে আর যুবরাজ শিহিল তার সেনা নিয়ে বামদিক থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা সর্বসম্মতিতে ঠিক হল।

সেনাগুরু কিবন অনেক ভাল একজন যোদ্ধা—যার কাছে বহু বলবান যোদ্ধাকে হার মানতে হয়েছে। কিবন দেবী আজ্রিয়ার ও মৃত নিম্বের পুত্র। শশী ও দেবতার রক্ত তার শরীরে বয়ে যাচ্ছে। কথিত আছে সেনাগুরু কিবনের গায়ে বিশ হাজার হাতির জোর। সেনাগুরু কিবন হঠাৎ বলল, ‘যুবরাজ শিহিল, আমাকে পঞ্চাশ হাজার সেনা দিয়ে বাকী পঞ্চাশ হাজার সেনা আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান।’ কিবনের কথায় যুবরাজ শিহিল সায় দিল। যুদ্ধের পরিকল্পনা শেষে সবাই যুদ্ধ-কক্ষ ত্যাগ করল।

পরেরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে মহারাজ রাসঙ্ক তার দুই-লক্ষ সেনা এবং কিবনের দেয়া পঞ্চাশ হাজার সেনা সহ লাগান্ত-এর দিকে যাত্রা শুরু করে। লাগান্ত-চলদাজ সীমান্ত থেকে চলদাজ রাজ্যের রাজপ্রাসাদটি বেশি দূরে নয়। পায়ে হেঁটে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছানো যায়। যেহেতু লাগান্ত-চলদাজ সীমান্তে যুদ্ধ হবে তাই মহারাজ রাসঙ্ক পঞ্চাশ হাজার সেনাকে প্রতিনিয়ত খাবার, পানীয়, ও অস্ত্র সরবরাহের জন্য দায়িত্ব দেয়। চলদাজ রাজপ্রাসাদ থেকে লাগান্ত সীমান্ত যেহেতু খুব দূরে নয় তাই খাবার, পানীয় এবং অস্ত্র সরবরাহে সৈন্যদের সমস্যা হচ্ছে না। এই সৈন্যরা আকাশ পথে উড়ে গিয়ে যুদ্ধের জন্য সব কিছু প্রতিনিয়ত সরবরাহ করার জন্য মহারাজ আদেশ দেয়। মহারাজ রাসঙ্ক কয়েক ঘন্টার মধ্যে লাগান্ত-চলদাজ সীমান্তে পৌঁছে যায়। লাগান্ত মানে লাগার অন্ত, বা লাগগিন্তা রাজ্যের শেষ অংশ। তাই লাগগিন্তার শেষ ভাগের এই এলাকাটির নাম লাগান্ত।

এদিকে পৌঁছে মহারাজ রাসঙ্ক কোন লাগগিন্তা যোদ্ধাকে দেখতে পেল না। রাসঙ্ক ভেবেছিল লাগগিন্তা সেনারা এতদিনে সীমান্তে না পৌঁছলে ও সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার কথা। রাসঙ্ক লাগান্ত-চলদাজ সীমান্তের কাছে লাগগিন্তা সেনাদের কোন চিহ্নও দেখতে না পেয়ে কৌতূহল হয়। এরপর মহারাজা রাসঙ্ক কয়েক জন গুপ্তচরকে এ বিষয়ে তথ্য জানার জন্য লাগান্তের কাছে পাঠায়। গুপ্তচররা কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এসে মহারাজ রাসঙ্ককে জানায় যে লাগগিন্তা রাজ্যের সেনা এখনে লাগান্ত-এর অন্যপাশে শিবির করে আছে এবং লাগগিন্তার মহারাজ মঞ্জটের উপস্থিতি তারা নিশ্চিত করেছে।

এদিকে লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর সুনেন্দ চলদাজ রাজ্যের রাজপ্রাসাদ থেকে মহারাজ রাসঙ্কের সব যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে মহারাজ মঞ্জটকে অবহিত করে। মহারাজ মঞ্জট ঠিক করল তাকে এই যুদ্ধ কৌশলে জয়ী হতে হবে কারণ তার সৈন্যের সংখ্যা চলদাজ সৈন্য সংখ্যার তিন-গুন হলেও যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত স্থানটির সুবিধাটি তার কাছে নেই। কিন্তু সে সুবিধাটি চলদাজ রাজ্যের সেনাদের আছে। মঞ্জট জানে তাকে যুদ্ধ করতে হলে দুর্গম লাগান্তা অতিক্রম করে চলদাজ রাজ্যে বা সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। সেটি যদি এখন মঞ্জট করতে যায় তাহলে হাজার হাজার সেনা মরুভূমির পথেই তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে মারা যাবে। যদিও বর্তমানে তাদের সেই সমস্যা নেই কারণ তাদের এখন একশত পুকুর ভর্তি বৃষ্টির পানি আছে। কিন্তু পুকুর তো সঙ্গে নেয়া যাবে না, মঞ্জট ভাবল। যদিও মঞ্জটের ইচ্ছা বৃষ্টির বর আছে কিন্তু চলদাজ সেনাদের মুখোমুখি হয়ে লাগগিন্তা সেনারা আবার পুকুর খনন করতে পারবে না। মঞ্জট আরো জানে যে চলদাজ রাজ্যের সেনারা লাগান্ত-এর মধ্যে এসে যুদ্ধ করতে চাইবে না কারণ তারা জানে যে যতদিন পর্যন্ত তাদের মন্দিরে সব দেবতাদের পূজা হচ্ছে ততদিন কোন শক্তিই তাদের রাজ্য দখল করতে পারবে না। সুতরাং চলদাজ রাজ্যের সেনারা লাগান্ত-এর ভিতরে এসে যুদ্ধ করার আশাটি একেবারেই অবাস্তবিক।

মঞ্জটের মাথায় এক বুদ্ধি আসল। পঞ্চযজ্ঞ শেষে মঞ্জট পর্বত দেবতা কুন্ত্রার কাছে বর হিসেবে এক হাজার সিংহ পেয়েছিল। মঞ্জট ঠিক করল সে তার বর হিসেবে পাওয়া একহাজার সিংহ দিয়ে চলদাজ রাজ্যের উপর আক্রমণ আরম্ভ করবে। মঞ্জট ভাবল শুধু সিংহ দিয়ে আক্রমণ করলে কোন লাভ হবে না। সিংহের সাথে সেনা পাঠানোর দরকার—তাহলে যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে। কিন্তু সিংহের সাথে সেনা কিভাবে পাঠাতে হবে তা নিয়ে মঞ্জট তার বিচক্ষণ সেনাপতি কৈন্তানির সাথে আলাপ করছে। ‘মহারাজ, লাগান্ত-এর দুর্গম মরুভূমির উপর কোন চাকা যুক্ত রথ চলবে না। আর সেনারা যদি আকাশ পথে উড়ে লাগান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে তাহলে চলদাজ রাজ্যের সেনারা তাদের কে অনেক দূর থেকে দেখত পারবে আর চলদাজ রাজ্যের সেনারা সাথে সাথে আমাদের সেনাদের আক্রমণ করবে। মহারাজ, রণভূমিতে যে পক্ষ চমকপ্রদ আক্রমণ বেশি করতে পারে সে পক্ষেরই যুদ্ধ জয় হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আকাশপথে উড়ে লাগান্ত- এ বিশাল মরুভূমি অতিক্রম করতে গেলে সেনারা চলদাজ রাজ্যের সীমান্তে পৌঁছার পূর্বেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। মহারাজ, আপনি তো জানেন ক্লান্ত সৈনিক মৃত সৈনিকের সমতুল্য। উপরন্তু আকাশ পথে সেনারা উড়ে যাবার সময় বেশি অস্ত্র বা খাদ্য সামগ্রী বহন করতে পারবে না। সুতরাং আমাদেরকে স্থল পথে যাবার জন্য একটি উপায় অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।’ সেনাপতি কৈন্তানি বলল। মঞ্জট সেনাপতির কথায় একমত পোষণ করে বলল, ‘সবি বুঝলাম কিন্তু আমাদের অতি শীঘ্রই স্থলপথে সেনা পাঠানোর একটি ব্যবস্থা করতে হবে সেনাপতি।’ সেনাপতি কৈন্তানি খুব বুদ্ধিমান সেনাপতি—বিচক্ষণ ও বটে। রণকৌশল সম্পর্কে তার বিশেষ জ্ঞান ও ধারণা আছে। সেনাপতি কৈন্তানি বলল, ‘মহারাজ, আমাদেরকে চাকাবিহীন রথ তৈরি করতে হবে এবং সে রথ যদি আমরা সিংহের পিঠে লাগাতে পারি তাহলে খুব দ্রুত আমাদের সেনা চলদাজ সীমান্তে পৌঁছতে পারবে। আমি যত দূর জানি সিংহ খুব দ্রুত দৌঁড়াতে পারে। তাছাড়া এ বিশাল মরুভূমি পার হলে সিংহগুলো ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে—এবং তারা সহজেই আমাদের শত্রুর উপর ঝঁপিয়ে পড়বে।’ মহারাজ মঞ্জট সেনাপতি মঞ্জটের কথা শুনে অনেক খুশি হয়। ‘সেনাপতি, সত্যি আপনার বিচক্ষণতার তুলনা নাই। কিন্তু একহাজার সিংহ দিয়ে কয় জন সেনা-ইবা পাঠানো যাবে। প্রতি রথে বড়জোর পাঁচজন সেনা পাঠানো যাবে। তার মানে সব মিলিয়ে আমরা পাঁচ হাজার সেনা পাঠাতে পারব। পাঁচ হাজার সেনা দিয়ে কি আর যুদ্ধ জেতা যায়? আমাদের প্রায় পনের লক্ষ সেনা আর চলদাজ রাজ্যের রয়েছে পাঁচ লক্ষ সেনা।’ সেনাপতি কৈন্তানি আবার চিন্তায় পড়ে যায়। ‘মহারাজ, উপায় একটি আছে। আমি বাছাই করে সবচেয়ে দক্ষ ও শক্তিশালী পাঁচ হাজার সেনা সনাক্ত করব—এবং তাদেরকেই সিংহ রথের সাথে পাঠানো হবে। এই পাঁচ হাজার দক্ষ সেনারা যখন চলদাজ রাজ্যের সেনাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করবে তখন আমাদের বাকী সেনারা নিরাপদে আকাশপথে যেতে লাগান্ত অতিক্রম করতে পারবে। চলদাজ রাজ্যের সেনারা আমাদের এই পাঁচ হাজার সেনাদের সাথে যুদ্ধে এত ব্যস্ত থাকবে যে আমাদের বাকী সৈন্য যখন আকাশপথ দিয়ে উড়ে যাবে তার টের পাবে না।’

মহারাজ মঞ্জট সেনাপতি কৈন্তানির বুদ্ধিমত্তায় অভিভূত। ‘ঠিক আছে সেনাপতি। আপনি এখন সেনাদের চাকা-বিহীন একহাজার রথ বানানো নির্দেশ দিন। রথ বানানো সম্পন্ন হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে অবহিত করবেন।’ সেনাপতি মহারাজ মঞ্জটের আদেশ নিয়ে চলে যায়। লাগগিন্তা রাজ্যের পনের লক্ষ সেনাদের সেনাপতি একহাজার চাকা-বিহীন রথ বানানোর নির্দেশ দেয়। এরপর সেনাপতি পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঁচ হাজার দক্ষ ও শক্তিশালী সেনা নির্বাচিত করে। পনের লক্ষ সেনাদের একহাজার চাকাবিহীন রথ বানাতে বেশিক্ষণ লাগেনি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেনারা একহাজার চাকা বিহীন রথ বানাতে সক্ষম হয়। সেনাপতি কৈন্তানি সেনাদের কর্মদক্ষতা দেখে খুব খুশি হয়।

বেলা তখন খুব বেশি হয়নি। সূর্য এখনো আকাশের মধ্যভাগে আসেনি। দুপুর হতে তখনো অনেক সময় বাকি। সেনাপতি মঞ্জটের শিবিরে প্রবেশ করে। ‘মহারাজ, আপনার আদেশ অনুযায়ী একহাজার চাকাবিহীন রথ বানানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর আমিও পাঁচ হাজার দক্ষ সেনা বাছাই করে ভিন্ন এক শিবিরে তাদের কে যুদ্ধের অপেক্ষায় রেখেছি।’ মঞ্জট সেনাপতির কর্মতৎপরায় বেশ মুগ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জট দেবতা কুন্ত্রার কাছে এক হাজার সিংহ দিতে আহ্বান জানায়। এক হাজার সিংহ সঙ্গে সঙ্গে লাগান্ত-এর মরুভূমিতে তার সামনে দৃশ্যমান হয়। মহারাজ মঞ্জট সিংহগুলোকে চাকা বিহীন রথের সাথে বাঁধার জন্য সেনাপতি কে আদেশ দেয়। সিংহগুলোকে চাকাবিহীন রথের সাথে বাঁধানোর পর প্রতি রথে পাঁচজন করে সেনা উঠে বসে। মহারাজ মঞ্জট সিংহগুলো কে লাগান্ত অতিক্রম করতে এবং চলদাজ রাজ্যের সেনাদের উপরে আক্রমণ চালাতে আদেশ দেয়।

সিংহ-চালিত রথগুলো মরুভূমির উপর দিয়ে বায়ুবেগে দৌড়ে চলতে থাকে। এদিকে মহারাজ রাসঙ্ক তার সেনা নিয়ে সীমান্তের ডান দিকে অবস্থান করছে এবং যুবরাজ শিহিল তার সেনা নিয়ে সীমান্তের বামদিকে অবস্থান করছে।

মহারাজ রাসঙ্কের আদেশে যে পঞ্চাশ হাজার সেনাকে প্রতিনিয়ত খাবার, পানীয় ও অস্ত্র সরবরাহের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা ইতিমধ্যে চলদাজ রাজপ্রাসাদ থেকে লাগান্ত সীমান্তে প্রচুর পরিমানে খাবার, পানীয় এবং অস্ত্র সরবরাহ আকাশ পথে করে ফেলল। এবার মহারাজ রাসঙ্ক তাদের বিশ্রামের জন্য আদেশ দিল।

এদিকে লাগান্ত-চলদাজ সীমান্তের ডান পাশের একটি এলাকার নাম চিনদাট। চিনদাট চলদাজ রাজ্যেরই একটি অংশ। চিনদাট এলাকা তে সাধারণত সাধকের বসবাস—এবং এখানে যুদ্ধ ও বিচারের দেবী আজ্রিয়ার একটি বিশাল মন্দির আছে। এখানকার অধিকাংশ শশীরা দেবী আজ্রিয়ার ভক্ত। যুদ্ধ ও বিচারের দেবী আজ্রিয়ার ভক্ত হলেও এই সাধকেরা যুদ্ধ ও হিংসাতে বিশ্বাস করে না। চিনদাটের বাসিন্দারা কৃষি-কাজ এবং দেবীর উপাসনা করেই জীবন কাটায়। চিনদাট এলাকার প্রধান সাধকের নাম রোনিত। রোনিত যখন জানতে পারল যে লাগগিন্তার মহারাজা মঞ্জট চলদাজ রাজ্যের উপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন রোনিত দলবেঁধে মহারাজ রাসঙ্কের কাছে আসল। ‘মহারাজ, আমরা যুদ্ধ ও হিংসায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন আমরা শুনতে পেয়েছি দেবী আজ্রিয়ার স্বামী নিম্বকে হত্যাকারী তারই ছোট ভাই মহারাজা মঞ্জট চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আর আমাদের সামলাতে পারলাম না। আমার সাথে প্রায় দশ হাজার চিনদাটবাসী রয়েছে। দয়া করে বলুন আপনাদের আমরা এই যুদ্ধে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’ রোনিত মহারাজ রাসঙ্ককে বলল। মহারাজ রাসঙ্ক রোনিতের সাহায্যের কথা শুনে খুশি হয়। ‘সত্যি আপনারা মহান। চলদাজ রাজ্যের এই দুর্দিনে আপনারা আমাদের সহায়তা করার জন্য চলে এসেছেন। সে জন্য আন্তরিকভাবে আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু আপনাদের যুদ্ধবিষয়ক কোন প্রশিক্ষণ নেই তাই আমি আপনাদের রাজা হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে আপনাদের ঠেলে দিতে পারব না। দয়া করে আমার ক্ষমা করুন এবং আপনাদের নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান।’ মহারাজা রাসঙ্ক বলল। মহারাজার কথা শুনে রোনিত ব্যথিত হয় কিন্তু সে আশা ছাড়েনি। ‘মহারাজ, আমাদের সেনা প্রশিক্ষণ নেই কিন্তু আমরা সেনাদের সেবা-শশ্রুষা অন্তত করতে পারি।তাদের কে রান্না করে খাওয়ানো, আহত সেনাদের চিকিৎসার কাজে সহায়তা, এবং জিনিসপত্র আনা নেয়াতে আমরা সাহায্য করি। দয়া করে প্রিয় চলদাজ রাজ্যের সেনাদের এই মহান যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য আমাদের সুযোগ দিন।’ রোনিত কাকুতি মিনতি করে বলল। মহারাজ উত্তরে বলল, ‘আমাদের ওসবের সব ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু আপনারা যেহেতু অনেক করে বলছেন আপনাদের সে সুযোগ অবশ্যই আমি দিব। কিন্তু প্রথমে আপনাদের কিছু সেনাবাহিনীর সাধারণ নিয়ম-কানুন শিখতে হবে। সে জন্য আপনাদের স্বল্প প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’ রোনিত শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়।

সীমান্তে মহারাজ রাসঙ্কের ও যুবরাজ শিহিলের সেনা শিবিরের মাঝখান বরাবর একটি নির্জন স্থান রয়েছে। এ স্থানটি অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক উঁচু’ তাই মহারাজ এই স্থানকে সাধকদের সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন প্রশিক্ষণের জন্য নিরাপদ ভাবল। তাছাড়া এই স্থানটি লাগান্ত-চলদাজ সীমান্তের সামান্য দূরে চলদাজে রাজ্যের অভ্যন্তর অবস্থিত। মহারাজ তার একশত সেনাকে আদেশ দিল যাতে তারা দশ হাজার চিনদাটবাসী সাধকদের সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়। এরপর কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব সাধক এবং একশত সেনারা ঐ উঁচু এলাকাতে প্রশিক্ষণের জন্য যায়।

এদিকে সিংহ-চালিত লাগগিন্তা রাজ্যের রথগুলো মরুভূমির উপর দিয়ে এমন ভাবে বায়ুবেগে চলছে যে দূর থেকে মনে হচ্ছে মরুভূমিতে বালুর ঝড় হচ্ছে। তা দেখে ডান ও বাম দিকের চলদাজ সেনারা সীমান্ত থেকে কিছুটা দূরে চলে যায়। কিন্তু একশ চলদাজ সেনাসহ দশ হাজার সাধকেরা তাদের প্রশিক্ষণের জায়গা তে থেকে যায় কারণ তাদের স্থানটি কিছুটা উচ্চ ছিল। এদিকে সিংহ-চালিত রথগুলো মরুভূমির উপর দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সীমান্তে পৌঁছে যায়। তারা দূর থেকে দেখতে পায় চলদাজ সেনারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে এক হাজার সিংহ এবং পাঁচ হাজার দক্ষ লাগগিন্তা সেনারা একে একে সব সাধুদের এবং একশত সৈনিকদের হত্যা করে। পরে তারা ঐ স্থানটি দখল করে নেয়। এ সুযোগে মঞ্জট প্রায় পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে সাধুদের প্রশিক্ষণের স্থানটি তে পৌঁছে যায়।

চলবে...

লেখক: কবি ও লেখক, অধ্যাপক: অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগ, জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইর্য়ক, মনস্তাত্তিক বিভাগ, হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউইর্য়ক। কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা, নিউইর্য়ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :