৯ কাউন্সিলরের ঝুলিতে কেবলই অনৈতিক কর্মকাণ্ড

প্রকাশ | ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৮:২১ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:১০

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

মাসের নাগালে ঢাকার দুই সিটির ভোটের দিন। এরই মধ্যে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের নিয়ে হিসাবনিকাশ করছেন ভোটাররা। দুই সিটিতেই বেশকিছু কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। সেসবের কারণে ভোটারদের কাছে তারা হতে পারেন প্রত্যাখ্যাত। কারও কারও বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ না থাকলেও নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারাও ছিটকে পড়তে পারেন। আবার কেউ কেউ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন পরিবারের সদস্যদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য।

ঢাকার উত্তর সিটি দক্ষিণের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম। এই অংশের সিংহভাগজুড়েই সচ্ছল নাগরিকদের বাস। এই সিটিতে ওয়ার্ড রয়েছে ৫৪টি। তার মধ্যে ৯টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। চাঁদাবাজি, জমি ও ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান দখল, ক্যাডার লালন, ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অপরাধের অভিযোগ তাদের দিকে।

এই নয়জন কাউন্সিলর হলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ৬ নম্বরের রজ্জব হোসেন, ৭ নম্বরের মোবাশে^র চৌধুরী, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদুর রহমান ইরান, ৩০ নম্বরের আবুল হাসেম হাসু, ৩১ নম্বরের শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ৩২ এর কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, ৩৩ নম্বরের তারেকুজ্জামান রাজীব ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈম।

এই নয়টি ওয়ার্ড পরিক্রমায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের আলাপে জানা গেছে, এসব জনপ্রতিনিধিদের ওয়ার্ডবাসীদের অভিযোগ অনেক। তবে অনেকক্ষেত্রে সেসব ক্ষোভের প্রকাশ করা না গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা থেমে নেই। চায়ের দোকান থেকে ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান আলোচনা হয় তাদের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। নানা অসদুপায় অবলম্বন করে তারা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে ওয়ার্ডবাসীর নাগরিক সুবিধাসহ উন্নয়ন কাজ উপেক্ষিত বলেই অভিযোগ নাগরিকদের।

তারা বলছেন, কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকেই এসব ওয়ার্ড কাউন্সিলররা জড়িয়ে পড়েছেন বেআইনি কর্মকাণ্ডে। অপরাধের কারণে কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ বিতর্কিতই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নাগরিকদের চাপা ক্ষোভ।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিএনসিসির এই ৯ কাউন্সিলরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। অন্য ৭ জনের বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোকাণ্ডের জড়িত থাকা, ক্যাডারবাহিনী লালনসহ গুরুতর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।

পাগলা মিজান

গত ১১ অক্টোবর ভোরে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গুহ রোডের হামিদা আবাসিক গেস্ট হাউস থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন মিজান। স্থানীয়রা তাকে ‘পাগলা মিজান’ বলেই চেনে। সম্প্রতি আলোচনায় থাকা ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত ও আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে চার রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৩০ কোটি ১৬ লাখ টাকা অর্জনে দুদকের মামলাও রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে বন্দি তিনি।

তারেকুজ্জামান রাজীব

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালীন গ্রেপ্তার হন আলোচিত কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। তার বিরুদ্ধে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জমি দখল, নদী ভরাট করে বিক্রি করা, নামমাত্র দামে জোরপূর্বক জমি কিনে নেয়া, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

গত ২০ অক্টোবর তার বন্ধুর বাসা থেকে রাজীবকে আটক করে র‌্যাব। তার সঙ্গে অস্ত্র ও মদ পাওয়া যায়। অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা দায়ের করে রাজীবকে দুইবারে ১৭ দিনে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ও র‌্যাব। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। বর্তমানে রাজীব কারাগারে রয়েছেন।

জামাল মোস্তফা

ডিএনসিসি প্যানেল মেয়র ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা যতটা না নিজের কারণে তার চেয়েও বেশি বিতর্কিত হয়েছেন ছেলে এবং ছেলে বউর কারণে। জামাল মোস্তফার ছেলে রফিকুল ইসলাম রুবেল ও তার স্ত্রী তানজিলা ঢাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের ভাষ্য, রুবেল ঢাকার সেরা ৪৫ জনের একজন শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ১১৫ পিছ ইয়াবাসহ পল্লবী থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন রুবেল ও তার স্ত্রী।

রজ্জব হোসেন

৬ নম্বর ওয়ার্ডের রজ্জব হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে স্থানীয়দের চাপা ক্ষোভ। জমি দখল, সরকারি জায়গায় বস্তি গড়ে সেখান বস্তি গড়ে তুলে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়ভাবে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছেন এই কাউন্সিলর। এছাড়া স্থানীয় পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় ও মাদক কারবারিদের সহায়তার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মোবাশ্বের চৌধুরী

৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোবাশ্বের চৌধুরীর নাম আসে শুদ্ধি অভিযান চলাকালীন। তিনি ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ‘অঘোষিত নিয়ন্ত্রক’ মোল্লা মো. আবু কাওছারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ক্লাবের ক্যাসিনোবাণিজ্যে নিয়মিত যাতায়াতের অভিযোগ ওঠে। যদিও তিনি দাবি করেছেন, কোনো ধরনের ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত নন।

ফরিদুর রহমান ইরান

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ফার্মগেট-তেজগাঁও এলাকায় আলোচিত ব্যক্তি ফরিদুর রহমান ইরান। তিনি ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকা, ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখলের অভিযোগ। এছাড়া মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনোর আসর বসিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

আবুল হাসেম হাসু

কাউন্সিলরদের মধ্যে নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছাড়িয়েছেন আবুল হাসেম হাসু। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলরকে ‘বড় দখলদার’ হিসেবেই চেনে শ্যামলী-আদাবর এলাকার লোকজন। ভাই কাসুকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন রীতিমতো একটি দখলদার বাহিনী। ‘হাসু-কাসু’ বাহিনী নামে পরিচিত এই বাহিনীর মাধ্যমে স্থানীয় বিপুল পরিমাণ জমি দখল করেছেন তারা দুই ভাই।

অপকর্মের দায়ে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ বহিষ্কৃত হাসুর বিরুদ্ধে আদাবর থানা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি রিয়াজ মাহমুদকে কুপিয়ে মারাত্বক জখম করার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলাও হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো হাসুকে কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণের জোর দাবি থাকলেও তিনি যথারীতি বহাল রয়েছেন। উল্টো ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাহের খানের মৃত্যুতে ওই ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলরের দায়িত্বও পালন করছেন হাসু।

শফিকুল ইসলাম সেন্টু

শফিকুল ইসলাম সেন্টুর পরিচয় নিয়ে জনশ্রুতি আছে ঢাকার ক্লাব পাড়ায় ক্যাসিনোর জন্মদাতাদের একজন তিনি। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলরের নাম উঠে আসে শুদ্ধি অভিযানের সময়। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে জড়িত সেন্টু শুদ্ধি অভিযানের সময় লোকান্তরে যান। সম্প্রতি আবার প্রকাশ্যে আসেন তিনি।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে তিনি সিটি করপোরেশনের ১২ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। এজন্য তাকে শোকজও করা হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ডে তেমন কোনো উন্নয়নমূলক কাজও করেননি বলে নাগরিকদরে অভিযোগ।

আনিসুর রহমান নাঈম

উত্তরের আরেক বিতর্কিত কাউন্সিলর ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান নাঈম। তাকে স্থানীয়রা ‘ত্রাস নাঈম’ নামেও চেনে। বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকায় এই পরিচয়ে তাকে সবাই চেনে। তার বিরুদ্ধে জমিদখল, চোরাকারবার, চাঁদাবাজি, আটকে রেখে অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। বাহিনীটি ‘নাঈম খলিফা’ হিসেবেও পরিচিত।

(ঢাকাটাইমস/২৯ডিসেম্বর/ডিএম)