তাড়াশের ২৪ শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখেনি কেউ

প্রকাশ | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:২৩

শায়লা পারভীন, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল দেশ। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় মুক্তিপাগল বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে। ঠিক সেই সময় সারাদেশের মতো সিরাজগঞ্জের তাড়াশেও পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় একের পর এক চালায় হত্যা, গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। লুটে নেয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের ঘরবাড়ি। শহীদ হন ২৪ জন মুক্তিকামী বীর সেনানী। অথচ এসব শহীদ পরিবারের খোঁজ স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও কেউ নেয়নি, এমনটাই দাবি শহীদ পরিবারের লোকজনের।

তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের এক নথি থেকে জানা যায়,  মুক্তিযুদ্ধে ৭নং সেক্টরের অধীনে ছিল চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ উপজেলা (তৎকালীন থানা)।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পরপরই ম.ম.আমজাদ হোসেন মিলন, আতাউর রহমান, এম. মোবারক হোসেন মিয়া ও আনসার প্রশিক্ষক আব্দুর রহমান মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয়ভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তারা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

রাজাকাররা শুরু করে গ্রামের পর গ্রাম হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি লুট। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়। এ সময় এই স্বাধীনতাবিরোধীরা পাক সেনাদের পথ ছিনিয়ে নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

এরা একের পর এক হত্যা করে তাড়াশের জমিদার পরিবারের সন্তান প্রতুল চন্দ্র গোস্বামী (হীরা লাল গোস্বামী), অতুল চন্দ্র গোস্বামী (চুনিলাল গোস্বামী), সাংবাদিক ইয়ার মোহাম্মদ ও শিক্ষক মহাদেব চন্দ্র সাহাসহ ২৪ জন মুক্তিকামী মানুষকে।

ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দেন ৭নং সেক্টরের অধীনে আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাব সেক্টর পলাশডাঙা যুব শিবিরে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক সফল অপারেশান চালালে স্থানীয় রাজাকাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর পলাশডাঙা যুবশিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় তাড়াশে নওগাঁ বাজারে। এ সময় রাজাকাররা পাকসেনাদের  নিয়ে  এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে অবিরাম গোলাবর্ষণ। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করেন। জীবন্ত ধরা পড়ে ক্যাপ্টেন সেলিমসহ বেশ কয়েক জন পাক সেনা। পরে তাদেরকে হত্যা করা হয়। পরে বিমান হামলা জোরদার করা হলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে এর একদিন পর অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা তাড়াশের আমবাড়িয়া গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গণহত্যা চালায়। এ সময় সাংবাদিক ইয়ার মোহাম্মদসহ ১৫ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

প্রতুল গোস্বামী ওরফে হীরা লাল গোস্বামীর একমাত্র কন্যা ফরিদপুর থেকে মুঠোফোনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘খোঁজ তো দূরের কথা আমার বাবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতেও ৪৮ বছর পেরিয়ে গেল।’

হীরা লাল গোস্বামীর ভাতিজা তপন গোস্বামী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শহীদ হীরা লাল গোস্বামীর নামে একটি রাস্তার নামকরণের প্রস্তাব উপজেলা প্রশাসন পাস করলেও অজ্ঞাত কারণে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।’

শহীদ সাংবাদিক ইয়ার মোহাম্মদের ছেলে দোবিলা ইসলামপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ লুৎফর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সে এক দুঃসহ স্মৃতি। যারা পাকসেনাদের সহযোগিতা করে এতো বড় গণহত্যা চালালো তাদের বিচার স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও হয়নি এটা সত্যিই দুঃখজনক। তবে আশার কথা সরকার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফাঁসি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে বিচারের জন্য আমরা আশায় বুক বাঁধতেই পারি।’

তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার গাজী মো. আরশেদুল ইসলাম জানান,  মহান মুক্তিযুদ্ধে তাড়াশ উপজেলার ২৪ জন মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের  নামের তালিকা আমরা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে নথিভুক্ত করেছি। এখন অপেক্ষা সরকারি সিদ্ধান্তের।

ঢাকাটাইমস/৩০ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/এমআর