গল্প - শেষ কথা : আলী কবীর

প্রকাশ | ০১ জানুয়ারি ২০২০, ১১:৫৯ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০, ১৬:৩২

আলী কবীর

গল্পটি শুনেছিলাম আজ থেকে বহু বছর আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের পর জনাব নুরুল আলমের মুখ থেকে। আমরা উভয়েই ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়েটা ছিল পুলিশ সার্ভিসের সদস্য আমাদেরই এক সতীর্থ সহকর্মীর। জনাব নুরুল আলম তখনো চাকরিতে ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি পুলিশের উচ্চপদে চাকরিরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, দলকানা ও মুক্তিযুদ্ধবিদ্বেষী তৎকালীন কর্তৃপক্ষ পুলিশের সর্বোচ্চ পদে তাঁকে পদোন্নতির পথ রোধ করেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবলেন চাকরি-বাকরি করবেন না। রাজনীতিতেই থেকে যাবেন। কারণ ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতিতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ বা রাকসুর শীর্ষ কর্মকর্তা।

যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি রাজনীতিতে তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন ঠিক করলেন। সোজা কথা, ছাত্ররাজনীতির সমাপ্তি ঘটিয়ে মূল দলে একটি পদ লাভের ইচ্ছার কথা তিনি নেতাকে সরাসরি বলবেন মনস্থ করলেন।

ঢাকায় এসে তিনি গণভবনে (পুরোনো) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেলেন। তখন রমনা পার্ক সংলগ্ন ওই ভবনটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। বঙ্গবন্ধুর দেখা পেতে তাঁর তেমন বেগ পেতে হলো না। একে তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা, তার ওপর দেশের ভিভিআইপিদের প্রটোকল তখন এখনকার মতো কড়াকড়ি ছিল না। সুতরাং দু-তিনজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরই নেতার কক্ষ হতে তাঁর ডাক পড়লো। তিনি দুরুদুরু পায়ে রুমে ঢুকলেন এবং সালাম দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে কদমবুসি করতে উদ্যত হলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর স্বভাবসুলভ জলদ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস নূরুল আলম?

আপনার দোয়ায় ভালো আছি, ছোট করে জবাব দিলেন তিনি। ভেবেছিলেন অনেক কিছুই বলবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে আসলেই সব কথা যেন কোথায় চলে যায়। মানুষ নির্বাক হয়ে শুধু তাঁর কথাই শুনতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুই এক পর্যায়ে বললেন, কী রে, পড়াশোনা কি শেষ নাকি? এখন তাহলে কি করবি? এরপরও নুরুল আলম কিছু বলতে পারলেন না। আমতা আমতা করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু তার অপ্রস্তুত ভাবটা খেয়াল করলেন। আবারও তিনি বললেন, শোন। সরকারি বিভিন্ন সার্ভিসে লোক নেওয়া হচ্ছে। তুই অ্যাপ্লাই করে দে। আমি তোফায়েলকে বলে দিচ্ছি। বলেই তিনি টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিলেন।

জনাব তোফায়েল আহমেদ তখন এমপি এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব। তিনি সুপিরিয়র পদে লোক নিয়োগের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে পিএসসির সাথে সমন্বয় করতেন। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমেদকে বললেন নুরুল আলমের জন্য একটি ফর্ম পাঠিয়ে দিতে।

বিষয়গুলো এত দ্রুত ঘটে গেল যে, জনাব আলম নেতাকে আর কিছুই বলতে পারলেন না। যে সব কথা তিনি বলবেন ভেবেছিলেন তার মনের সেই সব কথা মনেই রয়ে গেল। তিনি সুপিরিয়র পদ পরীক্ষার ফরম পূরণ করে জমা দিলেন।

কিছুদিনের মধ্যেই সুপিরিয়র পদে নিয়োগের জন্য নির্বাচিতদের নাম প্রকাশিত হলো। সদ্য স্বাধীন দেশে সেই সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ শূন্য ছিল। তাই ১৯৭৩ সালে ওই ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব দ্রুত সমাধা করা হয়। সময়ের স্বল্পতা হেতু পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলেও একটি সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হয়েছিল।

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকায় দেখা গেল জনাব নূরুল আলম পুলিশ সার্ভিস পেয়েছেন। তালিকা দেখে তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারা জীবন ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত থেকে নানা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ওই সময় পুলিশই ছিল আন্দোলনরত ছাত্রদের প্রধান প্রতিপক্ষ। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রজীবনে লড়াই করে এখন তিনিই কি না পেলেন পুলিশ সার্ভিস। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলেই মনে হলো ঘটনাটা।

আবার নেতার কাছে ছুটে গেলেন তিনি। খুবই দুঃখ ভরা কণ্ঠে তাঁকে জানালেন পুলিশ সার্ভিস পাওয়ার কথা। কিন্তু হা হতাস্মি। বঙ্গবন্ধু এই খবর শুনে একটুও দুঃখিত তো হলেনই না, তাঁকে বরং উৎফুল্ল বলেই মনে হলো। তিনি বললেন ভালো, ভালো। তোদের মতো ভালো ভালো ছেলেরা আসলেই তো এই বাহিনীটার আধুনিকায়ন হবে, উন্নতি হবে। এবারে নুরুল আলম রীতিমতো মনঃক্ষুণ্ন হলেন। তিনি অনেকটা মুখ কালো করেই নেতার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে সারদা পুলিশ একাডেমির ট্রেনিং মনোযোগ দিয়ে করতে বললেন।

যথাসময়ে সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমির প্রশিক্ষণ সূচি শেষ হলো। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পোস্টিং। কারণ আগেই বলেছি সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার পদ শূন্য থাকায় কাজকর্মে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। জনাব নুরুল আলম গোপালগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও (ঝঁন উরারংরড়হধষ চড়ষরপব ঙভভরপবৎ) হিসেবে পোস্টিং পেলেন। এবারে তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই গণভবনে গেলেন। নেতার সাথে সাক্ষাৎ করে তার প্রথম পোস্টিংয়ের কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু এবারও হাসিমুখে বললেন, ভালো, বেশ ভালো। যা, তুই গিয়ে কাজে জয়েন কর।

এবারে জনাব আলম আর নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না। গোপালগঞ্জের যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে খানিকটা অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেললেন। শুনে বঙ্গবন্ধু একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর খানিকটা ধমকের সুরে বললেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের একটা মহকুমা। সেখানে কাউকে না কাউকে তো যেতেই হবে, হয় তুই, নয়তো তোর কোনো সহকর্মী বা বন্ধু। তা হলে তোর ওখানে যেতে আপত্তিটা কিসের?

নুরুল আলম এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বঙ্গবন্ধু ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। খানিকটা অনুচ্চ স্বরে বললেন তুই ওখানে যা। গিয়ে কাজে যোগদান কর। বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, শোন, আমার মনে হয় ওখানে তোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তিনি আবার বললেন। নুরুল আলম বঙ্গবন্ধুকে সালাম করে চলে গেলেন। কিন্তু অনেক ভেবেও তাঁর শেষ কথাটার অর্থ বুঝতে পারলেন না।

জনাব নুরুল আলম গোপালগঞ্জের এসডিপিও হিসেবে কাজে যোগদান করে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর তাকে বলা শেষ কথাটা তিনি প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন। মনে করিয়ে দিল ১৫ আগস্ট।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, সবচেয়ে শোকাবহ দিন। ওই দিন ভোরে তিনি ঢাকা থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলেন। টেলিগ্রামের প্রেরক খোন্দকার মোশতাক আহমদ, রাষ্ট্রপতি। আর প্রাপক হলেন জনাব নুরুল আলম, এসডিপিও, গোপালগঞ্জ। টেলিগ্রামটি ইংরেজিতে লেখা যার বাংলা ভাষান্তর এই রকম:

প্রেরক: খোন্দকার মোশতাক আহমদ

রাষ্ট্রপতি

প্রাপক: নুরুল আলম

এসডিপিও, গোপালগঞ্জ।

 

‘আজ প্রত্যূষে এক পট পরিবর্তনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। তাঁর মরদেহ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে গোপালগঞ্জে প্রেরণ করা হচ্ছে। এসডিপিও, গোপালগঞ্জ তার মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় তার পৈতৃক নিবাসে সমাহিত করার ব্যবস্থা করবেন।’

শেষ কথাগুলো বলার সময় জনাব নুরুল আলমের দু’গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন, স্বপ্নেও ভাবিনি যে, বঙ্গবন্ধু আমাকে যে বিশেষ দায়িত্ব পালনের কথা বলেছিলেন তা এমন মর্মান্তিক হতে পারে। জনাব আলমের কথা শুনে উপস্থিত সবার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠেছিল।

আরো একটি কথা এখানে না বললেই নয়। খোন্দকার মোশতাকের টেলিগ্রাম পাওয়ার পর ওই তারবার্তার নির্দেশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ার পৈতৃক ভিটায় তাঁর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। এই দুরূহ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাকে। তিনি কয়েক বছর আগে উত্তরবঙ্গের একটি থানার ওসি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং ভীতিকর অবস্থায় এবং বঙ্গবন্ধুর মরদেহবাহী হেলিকপ্টারে আগত সেনাসদস্যদের দ্রুত বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করার জন্য মুহুর্মুহু তাগিদের প্রেক্ষিতে খুব তাড়াহুড়া করেই কাজ শেষ করেন। টুঙ্গিপাড়ার একটি বন্ধ দোকানের তালা ভেঙে ৫৭০ সাবান এনে তা দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মরদেহের গোসল করানো হয়েছিল। সেই থেকে ওই ভদ্রলোক (জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা; দুঃখিত আমি তার নামটি মনে করতে পারছি না) এখন পর্যন্ত রোজ নিজের গোসলে ৫৭০ সাবান ব্যবহার করে আসছেন। অন্য কোনো সাবান তিনি ব্যবহার করেন না। ভদ্রলোক একবার ঢাকায় এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আমাকে এসব কথা বলেন।