গল্প- পৌনঃপুনিক বিজয় : মনদীপ ঘরাই
প্রকাশ | ০১ জানুয়ারি ২০২০, ১২:২৪
কমল হাত উঁচু করেছে। রিজভী স্যারের ক্লাসে তো কেউ এই ভুল করে না। তার ওপর আবার কমল! যে কিনা শেষ বেঞ্চে বসার জন্য রীতিমতো যুদ্ধই করে রোজ।
রিজভী স্যার নিজেও বেশ অবাকই হলেন। বেতের ডগাটা আঙুল দিয়ে শান দিতে দিতে হুংকার ছাড়লেন,
‘তুই বলবি বিজয়ের ইতিহাস? বল দেখি’
কমল হাত উঁচু করেছিল পড়া বলার জন্য নয়। ভয়ংকর এক ঘটনায়। ক্লাসের পাশেই মৌচাক। কোত্থেকে একটা মৌমাছি উড়ে এসে ওর কাঁধে কামড় দিয়ে উড়ে গেল। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে উফ করে শব্দ করে হাতটা উঁচু করেছিল। পেছনের বেঞ্চ থেকে সে আওয়াজ স্যারের কানে পৌঁছায়নি। তবে হাত তোলাটা চোখ এড়ায়নি স্যারের।
কমল উঠে দাঁড়াল। স্যার কাছে এসে শোনে কমল মুখ দিয়ে উফউফ শব্দ করছে।
স্যার অবাক হয়ে বললেন, ‘কিরে বদমাশ, এখনো তো মার শুরুই করিনি! এখনই নাটক করছিস!’
কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কমল। কে শোনে কার কথা! শপাং শপাং তিনটি বেতের বাড়ি পড়লো পিঠ বরাবর।
এবার চিৎকার আর উফউফ-এ সীমাবদ্ধ থাকলো না কমল। ‘ও মাগো’ বলে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ক্লাস থেকে দৌড়ে পালাল।
সেবার তিন দিন জ্বরে ভুগেছিল কমল। তারপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর। তবু ওই এক ঘটনায় বিজয় শব্দটাই কেমন জানি ভীতিকর হয়ে দেখা দিল তার কাছে।
বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতি বিজয় দিবসেই কেন জানি মৌমাছির কামড় আর বেতের বাড়ির ব্যথাটা ফিরে আসে। হোক না তা কমলের কল্পনাতেই!
ওর পেশাটা শুনলে আরও অবাক হবেন। মাস্টার্স পাস করে রিজভী স্যারের মতোই হাইস্কুলের শিক্ষক হয়েছে কমল।
রিজভী স্যারের কাছ থেকে মার খেয়ে এসে ছাত্রদের অন্তত বেত দিয়ে মারার কথা না তার। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল কে বদলাবে বলুন? শিষ্য একেবারে গুরুর কপি। তার মারের ভয়ে ছাত্ররা শব্দশলাকার মতো কাঁপতে থাকে।
পুনরাবৃত্তি শব্দটার একটা পোশাকি নাম আছে। দেজাভু। কেমন জানি তাই হচ্ছে। আজ বছর বছর পরের এক দুপুরে ফিরে এলো আবার সেই ক্ষণ,
কমল ক্লাসে ঢুকেই বেতটা হাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘বিজয়ের ইতিহাস কে বলতে পারবি রে?’
কেউ ভয়ে হাত তুলছিল না। হঠাৎ পেছনের সিটে বসা একটা ছেলে হাত তুললো।
কেমন যেন অজানা এক ভয়ে কেঁপে উঠলো কমল। এ যেন তার শৈশব ফিরে এসেছে সামনে। ভিন্ন রূপে। রিজভী স্যার ক্লাসের সবার নাম মনে রাখতে পারতেন। কমল পারে না। তাই এক প্রকার দৌড়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই, তোর নাম কী রে!’
ছেলেটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘রিজভী’
বেতটা হাত থেকে পড়ে গেল কমলের। এমন দেজাভুও হয় নাকি। তবে এ দৃশ্যপটটা ঠিক যেন উল্টো। রিজভী ছাত্র। কমল শিক্ষক। সে অনেকটা নিশ্চিত হয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর হাতে মৌমাছি কামড়েছে, তাই না?’
রিজভী অবাক হয়ে বললো, ‘না স্যার কামড়ায়নি তো। না কামড়ালে আমি কী করব স্যার? আমার কোনো দোষ নেই।’
কমল এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বেতটা তুলে স্বভাবসুলভ কাঠিন্য এনে বললো,
‘তবে হাত উঁচু করলি কেন, বদমাশ? পারবি বলতে বিজয়ের ইতিহাস?’
এবার কেঁদেই দিল রিজভী, ‘না স্যার। পারবো না স্যার। আমি-আমি হাত উঁচু করেছিলাম টয়লেটে যাব বলে। আপনি বললে যাবো না স্যার।’
বলেই চোখ বুজে মারের অপেক্ষা করতে থাকে পিঠ পেতে।
কমল বেতটা তুলেও নামিয়ে নেয়। এই রিজভীকে মেরে সে আরেকটা রিজভী স্যার বানাতে চায় না। গড়তে চায় না খানিকক্ষণ আগের আরেকটা কমল।
বেত সরিয়ে হাতটা রিজভীর পিঠে রাখে কমল। নিচু কিন্তু হালকা গম্ভীর স্বরে বলে,
‘তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু’
সেদিনের পর কমলের বিজয় দিবসের সেই ভয়টা আর নেই। কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। মৌমাছির ব্যথা আর বেতের বাড়ি কল্পনাতেও আর ফেরেনি কখনো।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। কমলের মন উজাড় করে উপভোগ করার এক বিজয় দিবস। সকাল সকাল কুচকাওয়াজের জন্য মাঠে যাবার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই ওর সাত বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটা লালপাড়ের সবুজ শাড়ি পরে এসে দাঁড়ালো। ছোট্ট মুখটাতে একটা প্রশ্নের আবেশ জড়িয়ে বললো,
‘বাবা, বিজয় এলো কোত্থেকে?’
আজ অনেকদিন পর শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে কমলের। অনিচ্ছায় তোলা হাতের ওপর ভর করেই রিজভী স্যারকে চিৎকার করে জবাবটা দিতে ইচ্ছে করছেÑ
‘আমি জানি স্যার। কোত্থেকে এলো বিজয়। হৃদয় থেকে স্যার। বাঙালির অন্তর থেকে।’
আয়েশে চাদরটা জড়িয়ে বুকের বাম পাশটা দেখিয়ে ছোট্ট সন্তানকে বলে উঠলো,
‘এখান থেকে মা’
এই তো বিজয়ের ইতিবৃত্ত। এই তো বিজয়ের গর্বের ইতিহাস। যেখানে ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, নেই কোনো ভেদাভেদ। আছে শুধু বাঙালি হৃদয়ের জাগরণ। কোটি কোটি হৃদয়ের একসুরে স্পন্দিত হওয়া একটি কম্পন:
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’