শশীকাহন: পৌরাণিক উপাখ্যান: ফ্যান্টাসি থ্রিলার সিরিজ, পর্ব- চৌদ্দ

ড. রাজুব ভৌমিক
| আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ২৩:২৬ | প্রকাশিত : ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ২৩:২৪

মঞ্জট তার পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে উচ্চ এলাকাটিসহ পুরো চিনদাট এলাকাটি মুহূর্তের মধ্যে দখল করে ফেলে। মঞ্জট এত দ্রুত তার সেনা নিয়ে চিনদাট এলাকাটি দখল করে ফেলল যে মহারাজ রাসঙ্ক সীমান্তের ডান দিক থেকে বিন্দুমাত্র টের পায়নি। এরই মধ্যে মঞ্জটের সেনারা চিনদাট এলাকার বিভিন্ন জায়গা তে তাবু টেনে সেখানে পাঁচ লক্ষ লাগগিন্তা সেনাদের ঘাঁটি তৈরি করে। বাহিরে দাঁড়িয়ে সেনাদের বিপুল উদ্যম এবং কর্মদক্ষতা দেখে মঞ্জট খুব খুশি হয়।

কিছুক্ষণ পরমঞ্জট তার তাবুতে ফির যায়। মঞ্জট তার গুপ্তচরকে ডেকে পাঠায়। গুপ্তচর তার তাবুতে প্রবেশ করলে মঞ্জট তাকে আদেশ করে, ‘আপনি যত দ্রুত সম্ভব এই খবরটি লাগান্ত মরুভূমির অপর প্রান্তে অপেক্ষাকৃত পাঁচ লক্ষ সেনার কমান্ডারদের বলবেন যে এখন যেন তারা কিছুতেই দুর্গম লাগান্তার মরুভূমিটি পার না হয়। ওদের আসার সময় হলে আমি গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর দিব।” গুপ্তচর মহারাজ মঞ্জটের আদেশ নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। এদিকে মঞ্জট জানে যে তাকে যেভাবে হোক চলদাজ রাজ্যের উপর দেবতা কিতমুর আশির্বাদটি চূর্ণ করে দিতে হবে। এ বিষয়ে একটি সমাধানের জন্য মঞ্জট তার বিচক্ষণ সেনাপতি কৈন্তানিকে তার শিবিরে ডাকল। কৈন্তানি মঞ্জটের শিবিরে প্রবেশ করল। ‘আচ্ছা সেনাপতি, একটি সমস্যায় পড়লাম।’ মহারাজ মঞ্জট বলল। ‘মহারাজ, আদেশ করুন আপনার কোন সেবা করতে পারি।’ কৈন্তানি বলল। ‘আপনার সাথে একটি গুরুত্ব পূর্ণ গোপন তথ্য শেয়ার করছি। বহু বছর পূর্বে দেবতা কিতমু চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রাসঙ্ককে আশীর্বাদ করেছিলেন যে যতদিন চলদাজ রাজ্যে সব দেবতাদের মন্দির ও পূজা হবে ততদিন চলদাজ রাজ্যে আক্রমণ করে কেউ সফল হবে না। দেবতা কিতমু’র এই আশীর্বাদটি তুলে নিতে কি করা যায়, বলুন তো?’ মহারাজ মঞ্জট বলল।

সেনাপতি কৈন্তানি ভীষণ এক সমস্যা তে পড়ে যায়। কৈন্তানি জানে যে মঞ্জট তার কাছ থেকে এই বিষয়ে কিছু উত্তর আশা করছে—কিন্তু কৈন্তানি ভেবে পারছে না যে মঞ্জটকে সে কোন উপায় বলবে। সবাই জানে কৈন্তানি একজন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ সেনাপতি। কৈন্তানিকে কখনো এমন একটি কঠিন পরিস্থিতি তে পড়তে হয়নি। ‘আমরা যদি শীঘ্রই এর একটি ব্যবস্থা না করতে পারি তাহলে সব সেনা সহ আমাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি সেনাপতি, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’ মঞ্জট বলল। কৈন্তানির মাথায় ভাগ্যক্রমে একটি বুদ্ধি আসল। ‘মহারাজ, আপনার সমস্যাটির সমাধান তো সমস্যা-তেই বিদ্যমান। একটু ভেবে দেখুন মহারাজ। আপনার এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মন্দির। আমরা বর্তমানে আছি চিনদাট এলাকা তে যেখানে দেবী আজ্রিয়ার বহু মন্দির আছে। এদিকে আপনি দেবী আজ্রিয়ার নামও পছন্দ করেন না। তাই আমরা কোথাও আক্রমণ করার পূর্বে চিনদাট এলাকাতে দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দির একসাথে ধ্বংস করে দিতে পারি। তাহলে আপনার সমস্যাটির সমাধান হয়।’ সেনাপতি কৈন্তানি বলল। ‘কিন্তু শুধু দেবী আজ্রিয়ার মন্দির ধ্বংস করলেই কি হবে। দেবী আজ্রিয়ার পূজা তো এখানকার সাধকেরা তাদের নিজস্ব বাড়ি ও ঘরে করতে পারে।’ মহারাজ মঞ্জট বলল। ‘মহারাজ আপনি ঠিক বলছেন। কিন্তু উপায় একটি আছে। আমি যত দূর জানি চলদাজ রাজ্যে শুধু চিনদাট এলাকাতেই দেবী আজ্রিয়ার পূজা হয় এবং মন্দির আছে। আমরা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারি। চিনদাট এলাকাতে দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দির এবং সাধককে ধ্বংস করে দিতে পারি।’ কৈন্তানি বলল।

মহারাজ মঞ্জটের মাথায় তখন একটি বুদ্ধি আসল। পঞ্চযজ্ঞ শেষে মঞ্জট অস্ত্রের দেবতা আম্ভুর কাছে তার প্রিয় অস্ত্র ‘রম্ভাস্ত্র’ বর হিসেবে পেয়েছে। রম্ভাস্ত্রটি ইচ্ছাতে চলে এবং তার সামনে যা কিছু আছে সব ধ্বংস করে ফেলে। পাওয়া বর অনুযায়ী মঞ্জট রম্ভাস্ত্রটি শুধু মাত্র একবার আহ্বান করে আদেশ দিত পারবে। এরপর এই অস্ত্রটি দেবতা আম্ভুর কাছে ফিরে যাবে। ‘সেনাপতি আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এই সমস্যা সমাধানের উপায় একটি পেয়েছি।’ মহারাজ মঞ্জট বলল। এরপর সেনাপতি চলে যায়।

তখন প্রায় সূর্যাস্তের সময় হল। মঞ্জট ঠিক করল এখন সে দেবতা আম্ভুর রম্ভাস্ত্রটি ব্যবহার করবে। মঞ্জট রম্ভাস্ত্র আহ্বান করল—সাথে সাথে পুরো চন্দ্রগ্রহের আকাশ কাঁপতে লাগল। চন্দ্রগ্রহে পূর্বে কখনো রম্ভাস্ত্রের ব্যবহার হয়নি। বহুকাল আগে দেবতাদের রাজা কৃতনু রম্ভাস্ত্র ব্যবহার করে পুরো একটি গ্রহ ধ্বংস করে ফেলে। মঞ্জট জানত না যে রম্ভাস্ত্রটি কত শক্তিশালী। রম্ভাস্ত্র আহ্বান করে মঞ্জট জানতে পারে এই অস্ত্রের কতটুকু ক্ষমতা। একটু পর চন্দ্রগ্রহের মাটি কাঁপতে লাগল—ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। অঘটন হতে পারে বুঝতে পেরে মঞ্জট শীঘ্র রম্ভাস্ত্রকে আদেশ দেয় চিনদাট রাজ্যে একমাত্র লাগগিন্তা সেনা ব্যতীত সব বাড়ি-ঘর, মন্দির, শশী, এবং পশু-পাখি বিনাশ করে অস্ত্রের দেবতা আম্ভুর কাছে ফিরে যেতে। রম্ভাস্ত্র সাথে সাথে মঞ্জটের আদেশ পালন করতে দ্রুত চলে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রম্ভাস্ত্রটি চিনদাট এলাকা তে লাগগিন্তা সেনা ব্যতীত সব প্রাণী, শশী, বাড়ি-ঘর, এবং মন্দির ধ্বংস করে দেবতা আম্ভুর কাছে ফিরে যায়।

মঞ্জট বাহিরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দেখতে পায় তার পর্বত দেবতা কুন্ত্রার কাছে বর হিসেবে পাওয়া এক হাজার সিংহ মরে মাটির উপর পড়ে আছে। মঞ্জট কিছু বুঝতে পারে না। সেনাপতি কৈন্তানি বলল, ‘মহারাজ আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনার বর হিসেবে পাওয়া সব সিংহকে রম্ভাস্ত্রটি হত্যা করল?’ মহারাজ বলল, ‘আমিও বুঝতে পারছি না সেনাপতি। যদি অস্ত্রের দেবতা আম্ভুর সাথে দেখা হত তাহলে তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করতাম কেন রম্ভাস্ত্রটি আমার সিংহদেরও হত্যা করল।’ কৈন্তানি বুঝতে পারে যে নিশ্চয় মহারাজ কোন ভুল করেছে— তা না হলে এমনটি হত না। রম্ভাস্ত্র শুধু আদেশ পালন করে—এখানে কোন ভুল হবার কথা নয়। ‘মহারাজ, আপনি রম্ভাস্ত্রকে ঠিক কি আদেশ দিয়েছিলেন।’ কৈন্তানি বলল। মহারাজ মঞ্জট বলল, ‘আমি রম্ভাস্ত্রটি কে আদেশ দিয়েছি যে চিনদাট এলাকাতে লাগগিন্তা সেনা ব্যতীত সব প্রাণী, শশী, বাড়ি-ঘর, এবং মন্দির ধ্বংস করে যেন দেবতা আম্ভুর কাছে ফিরে যায়।’ সেনাপতি কৈন্তানি তখন বুঝতে পায় যে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে মহারাজ রম্ভাস্ত্রকে একটি ত্রুটি-পূর্ণ আদেশ দিয়েছে। ‘মহারাজ, রম্ভাস্ত্র আপনার আদেশ পালন করছে। পর্বত দেবতা কুন্ত্রার কাছে বর হিসেবে পাওয়া এক হাজার সিংহ তো আপনার না। সেগুলো আপনি বর হিসেবে পেয়েছেন। তাই রম্ভাস্ত্র সব সিংহ কে হত্যা করেছে।’ মঞ্জট তার ভুল বুঝতে পায়।

এদিকে সীমান্তের ডানদিকে অবস্থানরত মহারাজা রাসঙ্ক ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে যায়। রাসঙ্ক কিছুতেই বুঝতে পারে না যে হঠাৎ আকাশ ও মাটি কেন কম্পন করল। এদিকে মহারাজ রাসঙ্ক এখনো জানে না যে মঞ্জট ইতিমধ্যে চিনদাট এলাকাতে পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। রাসঙ্ক অনুমান করতে পারে যে কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলছে। তাই মহারাজ রাসঙ্ক খোঁজখবর নিতে চারিদিকে তার গুপ্তচরের কয়েকটা দল পাঠাল। তখন মাত্র সন্ধ্যা হল। ক্লান্ত মহারাজ রাসঙ্ক ঘুমিয়ে পড়ল। মধ্যরাতে চারিদিক থেকে তার পাঠানো গুপ্তচররা ফিরে এল। একজন গুপ্তচর এসে মহারাজ কে বলল, ‘মহারাজ, সর্বনাশ হয়ে গেছে। লাগগিন্তার মহারাজ মঞ্জট তার পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে বর্তমানে চিনদাট এলাকাতে অবস্থান করেছে। চিনদাট এলাকার সব চলদাজ রাজ্যের নাগরিক এবং পশু-পাখিদের নির্মমভাবে মঞ্জটের সেনারা হত্যা করেছে। মহারাজ, তার উপর মঞ্জটের সেনারা দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দিরও ধ্বংস করে ফেলল।’ মহারাজ রাসঙ্ক এ কথা শুনে খুব ব্যথিত হয়। রাসঙ্কের মনে পড়ে যায় চিনদাট এলাকার প্রধান রোনিতসহ সব সাধুদের কথা। হঠাৎ মহারাজ রাসঙ্ক ভাবল কেন লাগগিন্তা সৈন্যরা দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দির ধ্বংস করে দিল। ‘তাহলে কি কোনোভাবে মঞ্জট জেনে ফেলল যে চলদাজ রাজ্যের উপর দেবতা কিতমুর আশির্বাদের কথা?’ মহারাজ রাসঙ্ক ভাবল। আবার রাসঙ্ক ভাবল, ‘মঞ্জট দেবী আজ্রিয়া কে ঘৃনা করে তাই হয়তো সে দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দির ধ্বংস করে দিল।’ কিন্তু পরে মহারাজ রাসঙ্ক ভাবল, ‘দেবী আজ্রিয়ার প্রতি মহারাজ মঞ্জটের ঘৃনার কথা কারো অজানা নয় কিন্তু যুদ্ধের এই ক্রান্তি মুহূর্তে মঞ্জট এমনটি করার কথা নয়। সে ইচ্ছে করলে যুদ্ধ জয়ের পর দেবী আজ্রিয়ার মন্দির ধ্বংস করতে পারত।’ মহারাজ রাসঙ্কের মনে সন্দেহের জাগ্রত হয়। রাসঙ্ক বুঝতে পারে তার আশে-পাশে মঞ্জটের কোন গুপ্তচর সক্রিয় আছে।

রাসঙ্ক বুঝতে পারে এখন মঞ্জট ইচ্ছে করলেই তার সেনাদের উপর আক্রমণ করে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে—কারণ মঞ্জটের তুলনায় রাসঙ্কের সেনা সংখ্যা অনেক কম; উপরন্তু, মঞ্জট চলদাজ রাজ্যের উপর দেবতা কিতমুর আশীর্বাদ চূর্ণ করে দিল। দেবী আজ্রিয়ার সব মন্দির এবং সাধক চিনদাট এলাকাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে এখন চলদাজ রাজ্যের উপর দেবতা কিতমুর আশীর্বাদ নাই। মহারাজ রাসঙ্ক বুঝতে পারল যে তার আশে-পাশে মঞ্জটের গুপ্তচর আছে যারা প্রতিনিয়ত মঞ্জটকে চলদাজ রাজ্যের সব তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাসঙ্ক আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রাসঙ্ক হতাশ হয়ে পড়ে। রাত প্রায় শেষের দিকে—রাসঙ্কের সারারাত আর ঘুম হয়নি। বিছানায় কাত হয়ে মহারাজ রাসঙ্ক মঞ্জটের গুপ্তচরকে ধরতে একটি উপায় খুঁজতে থাকে। মহারাজ রাসঙ্কের মাথায় একটি বুদ্ধি আসল। সূর্যোদয়ের পূর্বে মহারাজ রাসঙ্ক তার সব সেনা কমান্ডার কে তার শিবিরে মিটিং করার জন্য ডাকল। লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর সুনেন্দ এত ভোরে মহারাজ রাসঙ্ক তার সব সেনা কমান্ডারের সাথে মিটিংয়ে ডাকছে শুনে বুঝতে পারে নিশ্চয় এটি কোন এক গুরুত্ব পূর্ণ মিটিং হবে। সুনেন্দ ঠিক করল তাকে জানতে হবে মহারাজ কেন এত ভোরে সেনা কমান্ডারদের সাথে এই মিটিং ডাকল।

খুব ভোরে মহারাজ রাসঙ্কের শিবিরে সব সেনা কমান্ডার আসল। মহারাজ তখন সব সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশে বলল, ‘আমি আমার গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেয়েছি যে লাগগিন্তা সেনারা মঞ্জট সহ চিনদাট এলাকাতে বর্তমানে অবস্থান করছে। আমাদের কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের উপর অতর্কিত একটি হামলা করতে হবে যাতে তারা কিছুতে বুঝতে না পারে। এই মুহূর্তে মঞ্জটের সেনারা দুর্বল। তাদের উপর হামলা করার এটি প্রকৃত সময়। যান আপনারা এখনি প্রস্তুত হয়ে আমার আদেশের জন্য অপেক্ষা করুন।’ লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর সুনেন্দ সব কথোপকথন দূর থেকে শুনতে পায় এবং সে ভাবল, ‘যেভাবে হোক আমাকে এই হামলার কথা এখুনি মহারাজ মঞ্জটের কাছে পৌঁছাতে হবে। না হলে বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ এই ভেবে সুনেন্দ দ্রুত চলদাজ সেনা শিবির ছেড়ে চিনদাট এলাকার দিকে যাত্রা শুরু করে। পথেই মহারাজ রাসঙ্কের আদেশে অপেক্ষমাণ সৈন্যদের হাতে সুনেন্দ ধরা পড়ে। চলদাজ সেনারা সুনেন্দকে মহারাজ রাসঙ্কের কাছে নিয়ে যায়। মহারাজ রাসঙ্ক বারবার সুনেন্দ কে তার অপরাধ স্বীকার করতে বলে কিন্তু প্রশিক্ষিত গুপ্তচর সুনেন্দ কিছুতেই তার অপরাধ স্বীকার করে না। অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর সুনেন্দ তার মুখ ফসকে বলল ‘লাগগিন্তা জয় হোক’। মহারাজ রাসঙ্কের তখন আর বুঝতে বাকী রইল না সুনেন্দ ই সেই গুপ্তচর যে বহু বছর ধরে চলদাজ রাজ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য গুলো মঞ্জটকে নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে। মহারাজ রাসঙ্ক ভোর হলেই গুপ্তচর সুনেন্দকে সবার সামনে ফাঁসি দিয়ে মৃতুদন্ড কার্যকর করতে সেনাদের আদেশ দেয়।

কিছুক্ষণ পর ভোর হয়। মহারাজের আদেশের অনুযায়ী গুপ্তচর সুনেন্দকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সুনেন্দ লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর বলে কেউ তার মরদেহ মাটির উপরে রাখতে রাজী হয়নি। চলদাজ রাজ্যের সৈন্যরা সুনেন্দের মরদেহটিকে চিনদাট এলাকা থেকে কিছু দূরে একটি বিশাল গাছে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখে।

এদিকে মহারাজ মঞ্জট অপেক্ষা করছে গুপ্তচর সুনেন্দ এর জন্য—সুনেন্দ চলদাজ শিবিরের তথ্য নিয়ে আসলে মঞ্জট পরবর্তী আক্রমণ করবে বলে সে ঠিক করেছে। এভাবে সারাদিন চলে যায়—সুনেন্দের কোন খোঁজ নাই। মঞ্জট চিন্তিত হয়ে পড়ল। আর অপেক্ষা না করে মঞ্জট তার সেনাপতি কৈন্তানিকে আদেশ দেয় ডান এবং বাম দিকের চলদাজ সেনা শিবিরের তথ্য তাকে যত শীঘ্রই সম্ভব এনে দিতে। সেনাপতি কৈন্তানি মহারাজার আদেশ অনুযায়ী চারিদিকে তার গুপ্তচর পাঠায় চলাদাজ রাজ্যের সেনাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য।

মধ্যরাতের পর গুপ্তচররা একে একে ফিরে আসতে লাগল। বাম দিক থেকে আসা এক গুপ্তচর মহারাজা মঞ্জট কে বলল, ‘মহারাজ, চিনদাট থেকে একটু দূরে বাম দিকে যুবরাজ শিহিল দুই লক্ষ চলদাজ সেনা নিয়ে আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। যুবরাজ শিহিল এখনো জানে যে সব লাগগিন্তা সেনারা লাগান্ত-এর অপরপ্রান্তে অপেক্ষা করছে, মহারাজ। যুবরাজ শিহিল জানে না আমরা চিনদাট এলাকাতে বর্তমানে অবস্থান করছি।’ চিনদাটের ডান দিক থেকে আসা এক গুপ্তচর মহারাজা মঞ্জটকে বলল, ‘মহারাজ, দু:সংবাদ আছে। চলদাজ রাজ্যের সেনারা আমাদের সুদক্ষ গুপ্তচর সুনেন্দ কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। এরপর তারা সুনেন্দ কে একটি বিশাল গাছে প্রদর্শনের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছে। ডানদিকে চলদাজ রাজ্যের প্রায় দুই লক্ষ সেনা মহারাজ রাসঙ্কের নেতৃত্বে আছে—এবং মহারাজ রাসঙ্ক জানে আমরা বর্তমানে চিনদাট এলাকাতে আছি। মহারাজ, আরো জানতে পারলাম মহারাজ রাসঙ্ক শীঘ্র আমাদের উপরে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ সুদক্ষ গুপ্তচর সুনেন্দের উপর নির্মম হত্যাকান্ডের খবর শুনে মহারাজ মঞ্জট খুব ক্রোধিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে তার সেনাপতিকে তার শিবিরে ডেকে পাঠায়।

সেনাপতি কৈন্তানি মহারাজ মঞ্জটের শিবিরে আসল। ‘সেনাপতি আজ ভোরেই আমরা মহারাজ রাসঙ্কের নেতৃত্বে চলদাজ সেনার উপর অতর্কিত আক্রমণ করব। আপনি সব সেনাদের প্রস্তুত করুন। আপনি লাগান্ত মরুভূমিতে অপেক্ষমাণ বাকী পাঁচ লক্ষ সেনাদের সংবাদ পাঠান যাতে তারা ভোরেই লাগান্ত মরুভূমি ত্যাগ করে আমাদের সাথে চলদাজ সীমান্তের ডান দিকে মিলিত হয়। আমরা যখন পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে মহারাজ রাসঙ্কের দুই লক্ষ সেনার উপর আক্রমণ চালাব তখন তারা আমাদের সেনাদের আক্রমনে এত ব্যস্ত থাকবে যে লাগান্ত থেকে উড়ে আসা পাঁচ লক্ষ সেনাদের দেখার ও সুযোগ পাবে না।’ মহারাজ মঞ্জট সেনাপতি কৈন্তানিকে বলল। মহারাজার আদেশ নিয়ে সেনাপতি চলে যায়। এরপর সেনাপতি তার সেনাদের শীঘ্রই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দেয়।

ভোর হতে এখনো কিছুক্ষণ বাকী। মহারাজ মঞ্জট এবং সেনাপতি কৈন্তানির নেতৃত্বে পাঁচ লক্ষ লাগগিন্তা সেনা চলদাজ সেনাদের উপরে আক্রমণ করতে প্রস্তুত। মঞ্জট তার তাবু থেকে বেরিয়ে লাগগিন্তা সেনাদের প্রস্তুতি স্বচক্ষে দেখল। এরপর মঞ্জট তার সেনাপতিকে সীমান্তের ডানদিকে সেনাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করার জন্য আদেশ দিল। এদিকে মহারাজ রাসঙ্ক ও ভোরে তার সেনাদের নিয়ে চিনদাট এলাকাতে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ একজন গুপ্তচর এসে মহারাজ রাসঙ্ককে বলল, ‘আমি মহারাজ মঞ্জটের নেতৃত্বে লাগগিন্তা সেনাদের আমাদের দিকে আসতে দেখছি।’ মহারাজ রাসঙ্ক তখন তার সেনাদের যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে বলল।

ভোর হতেই দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পুরো সকাল এবং দুপুর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। বিকেলের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ লাগগিন্তা সেনা এবং এক লক্ষের বেশি চলদাজ সেনা যুদ্ধে মারা যায়। বিকেলের প্রথম ভাগে মহারাজ মঞ্জটের সাথে মহারাজ রাসঙ্কের যুদ্ধ শুরু হয়। দুই জনের মধ্যে অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। সূর্যাস্তের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মঞ্জটের হাতে মহারাজ রাসঙ্কের মৃত্যু হয়। মঞ্জট তার ধারালো তলোয়াটি দিয়ে রাসঙ্কের বুকটি বারবার ক্ষত বিক্ষত করে। এরপর পর ক্রোধিত মঞ্জট মহারাজ রাসঙ্কের মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার ধারলো তলোয়ার দিয়ে একে একে তার দুটি হাত, দুটি পা, এবং মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে। মঞ্জট রাসঙ্কের ডান হাত টি উঁছিয়ে যুদ্ধের বিজয় উল্লাস করতে থাকে। মঞ্জটের সাথে সাথে লাগগিন্তার সব সেনারা ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। এদিকে মহারাজ রাসঙ্ক মারা যাওয়ার পর অবশিষ্ট বাকী প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়।

হঠাৎ মঞ্জটের উল্লাস থেমে যায়। মঞ্জট বারবার তার হাতে রাসঙ্কের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা ডান হাতটি দেখতে থাকে। রাসঙ্কের ডান হাতের বাহুতে একটি জন্ম দাগ ছিল যেটি মঞ্জটের পিতা শশাঙ্কের ডান হাতের বাহুতেও ছিল। মঞ্জট তার পিতা শশাঙ্কের মুখ থেকে চন্দ্রগ্রহে শশীদের জন্মের কথা বহুবার শুনেছে। একসময় চন্দ্রগ্রহে কোন শশী ছিল না। সবাই ছিল সূর্যগ্রহে দেবতাদের সাথে। চন্দ্রগ্রহে শশীদের সৃষ্টি হয় মহারাজ শশাঙ্ক ও মহারানী কুর্নষা থেকে। শশাঙ্ক ও কুর্নষা সূর্যগ্রহের শান্তিকুন্জের পুষ্পপুরী নামক এক বাগানে অন্যান্য পাখিদের সাথে থাকত। শশাঙ্ক তখন ছিল পাখিদের মহারাজা আর কুর্নষা মহারানী। একদিন ভালবাসা ও কামনার দেবী মুকি পুষ্পপুরীতে শন্তু গাছের তলায় ধ্যান করছে। গভীর ধ্যানে সে মগ্ন ছিল। হঠাৎ গাছের একটি বড় ডাল মুকির গায়ের উপর পড়ে। এতে মুকির গভীর ধ্যান ভঙ্গ হয়। মুকি চোখ খুলে দেখে তার মাথার উপরে মস্ত শন্তু গাছের ডালের উপরে শশাঙ্ক ও কুর্নষা গভীর মিলনে আবদ্ধ। এতই ঘোর মিলনে তারা আবদ্ধ ছিল যে দেবী মুকিকে তারা দেখে নি। দেবী মুকি তার গভীর ধ্যান ভঙ্গ হওয়াতে রেগে মেগে আগুন। সাথে সাথে দিব্যশক্তির বলে দেবী মুকি শশাঙ্ককে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়।

মহারাণী কুর্নষার অনেক কাকুতি-মিনতির পরে দেবী মুকি শশাঙ্ক ও কুর্নষাকে বলল, ‘যা আমি তোদের অভিশাপ দিলাম। আজ থেকে তোর কোন বংশধরের স্থান সূর্যগ্রহে হবে না। চন্দ্র গ্রহে হবে এখন থেকে তোদের বসবাস। সেখানেই তোরা কাম বাসনায় লিপ্ত থাকবি। বংশের পর বংশ এই কাম বাসনা ও ভোগ- ভালবাসার জন্য তোরা একে অপরকে ধ্বংস করবি।’

দেবী মুকি তাদের আরো বলেন, ‘তোদের শরীরেরও পরিবর্তন হবে। তোদের এমন শরীর হবে যা সবসময় তোদের ভোগ ও কামনা বাসনায় লিপ্ত করতে সাহায্য করবে।’ তখন শশাঙ্ক বলল, ‘মাতা, দয়া করুন। আমরা দুজন অনেক পাপ করেছি। দয়া করে আমাদের বংশের প্রতি এমন নির্দয় হবেন না। দয়া করে আমাদের মুক্তির উপায় বলুন।’ দেবী মুকি তখন বলস, ‘‘ঠিক আছে। তোদের মধ্যে যে ভোগ, কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ করে দেবতাদের কৃপা পাবে শুধু তারাই সূর্যগ্রহের শান্তিকুন্জে স্থান পাবে। আর বাকীদের নার্কের সাজা ভোগ করতে হবে।’

এর কিছুক্ষন পর মহারাজা শশাঙ্ক এবং মহারানী কুর্নষা আধা-পাখি ও আধা-মানুষ রূপে পরিবর্তন হল। অন্য সব পাখিদেরও দেহ সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। কিছুক্ষণ পরে সবাই চন্দ্র গ্রহে আবির্ভাব হয়। কিন্তু সূর্যগ্রহ থেকে চন্দ্রগ্রহে আবির্ভাবের সময় শশাঙ্ক তার একমাত্র ভাই রসাঙ্ক কে হারিয়ে ফেলল। শশাঙ্ক চন্দ্রগ্রহে পৌঁছার পর তার একমাত্র ভাই রসাঙ্ক কে বহু বার খোঁজার চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হয়নি। একদিন মহারাজা শশাঙ্ক বালক মঞ্জট কে বলল, ‘মঞ্জট আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দু:খ হচ্ছে আমার প্রিয় ছোট ভাই রসু’র সন্ধান না পাওয়া। এই যে আমার ডান হাতে বাহুতে জন্মদাগটি আছে, রসু’র হাতে ও একই রকম একটি দাগ আছে। যদি তুই কোনদিন আমার প্রিয় ছোট ভাইয়ের সন্ধান পাস তাহলে তাকে পিতৃ মর্যাদা দিবি।’

মঞ্জট তার পিতার কথা স্মরণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে কান্নায় ফেটে পড়ে। কেউ কিছু বুঝতে পারে না যে হঠাৎ কেন মহারাজা মঞ্জট তার শত্রুর ডান হাত উঁছিয়ে তুলে কান্না করছে। মঞ্জটের সেনাপতি কৈন্তানি মহারাজ মঞ্জটের কাছে যায়। ‘মহারাজ, ক্ষমা করুন। দয়া করে কি বলবেন আপনি কেন আমাদের শত্রুর হাত আপনার হাতে নিয়ে কাঁদছেন? আজকে আমাদের জয় হয়েছে। চলদাজ রাজ্যের বাকী সেনারা পলায়ন করেছে। আমাদের এখনো দুই লক্ষ সেনা বাকী আছে এবং বাকী পাঁচ লক্ষ সেনা লাগান্ত-এর মরুভূমি আকাশ পথে পাড়ি দিয়ে এইমাত্র পৌঁছল। আমাদের সব সেনারা এই জয় উল্লাস করছে। আপনার চোখে অশ্রু কেন মহারাজ?’ সেনাপতি কৈন্তানি বলল। তখন মঞ্জট বলল, ‘সেনাপতি, আমি যাকে হত্যা করেছি সে আমার শত্রু নয়। মহারাজ রাসঙ্ক আমার পিতার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ছোট ভাই।’ এই বলে মঞ্জট হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

চলবে...

লেখক: কবি ও লেখক, অধ্যাপক: অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগ, জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইর্য়ক, মনস্তাত্তিক বিভাগ, হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউইর্য়ক। কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা, নিউইর্য়ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :