একান্ত সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম

নিজের জীবন থেকে শিশুদের নিয়ে কাজ করছি

প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৭ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ১২:২৫

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

নিজের সংগ্রামমুখর জীবন পার করেছেন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বার অ্যাট ল ডিগ্রি নেওয়া পর্যন্ত। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার এক অভাবের সংসারে জন্ম নিয়ে জীবনযুদ্ধে সফল ব্যারিস্টার হালিম ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে লালন করতেন শিশুদের শিক্ষা ও অধিকার নিয়ে কাজ করবেন তিনি। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি ভাইদের মানুষ করেছেন। বাবা-মার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। নানা কাজ করেছেন জনস্বার্থে। সংগ্রাম, দারিদ্র্য, জীবনযুদ্ধে বিজয় অর্জন, শিশুদের শিক্ষা ও আইনি সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন মঞ্চে কথা বলেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় উঠেছেন আদ্যোপান্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার আমিনুল ইসলাম মল্লিক।

ঢাকা টাইমস: শিশুদের অধিকার ও শিক্ষা নিয়ে আপনার কাজ করার অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা বলুন।

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: এটা হলো আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকেই। আমি তো আসলে শৈশবকাল থেকেই অনেকটা স্ট্রাগল করে মানুষ হয়েছি। ফলে আমার স্বপ্ন ছিল আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে শিশুদের অধিকার, উন্নয়ন ও শিক্ষার পেছনে শ্রম দেব। আরেকটা জিনিস হলো আমার জীবন থেকেই মনে করি শিক্ষা হলো মানুষের জীবনের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। একটা শিশু শিক্ষিত হলে তার পরিবারও শিক্ষিত হবে। একটা শিশুকে যদি শৈশব অবস্থায় থেকে তার পাশে দাঁড়ানো যায় তাহলে সে বিভ্রান্ত হবে না। সে তার নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারবে নিজেই। অন্যের ওপর তার নির্ভরতা কমে যাবে।

ঢাকা টাইসম: ছোটবেলায় স্ট্রাগল করেছেন বললেন। তার গল্প শুনতে চাই।

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: বাবা ছিলেন দরিদ্র কাঠুরে। খেয়ে না খেয়ে বড় অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হতে হয়েছে আমাকে। আব্বা আমাকে ফাইভ পাসের পর কাজে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে আমি পালিয়ে গিয়ে পড়ালেখা করেছি। কৃষিকাজে আব্বা আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তারপর আব্বা আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আমার মেজ বোনের সহায়তায় হাইস্কুলে ভর্তি হই। বিভিন্ন বাসায় গিয়ে শিশুদের পড়াতে গিয়েও দেখেছি অনেক মেধাবী শিশু ফাইভ পাসের পর আর আগাতে পারে না। হয়তো বাবা-মা তাদের কোনো কাজে ঢুকিয়ে দেন।

শিশুদের মেধা যেন হারিয়ে না যায় এ জন্য লন্ডন থেকে দেশে আসার পর ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করি সিসিবি ফাউন্ডেশন। এরপর ২০০৬ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি শিক্ষার দিকটা নিয়ে।

আর শিশুদের অধিকারের বিষয় নিয়ে আমি দেখলাম যে আইনজীবী হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। ১৯৯৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে বার অ্যাট ল পড়তে যাই। ওই স্কলারশিপে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসি ২০০৩ সালে। তারপর আমি স্কলাস্টিকায় ল পড়িয়েছি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ল পড়িয়েছি। ২০০৭-০৮ সেশনে আমি লিগ্যাল প্রোফেশনে একদম একটিভ হই। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আইনগত অধিকারের জন্য শিশুদের জন্য কাজ করতে আমার অনেক সুযোগ রয়েছে।

ঢাকা টাইমস: শিক্ষার্থীদের বৃত্তির বিষয়ে কিছু বলুন।

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: আমাদের চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা ও বৃত্তি প্রদান করে থাকি। প্রথম বছর পরীক্ষা নিয়ে থাকি পরের বার বৃত্তি দেই। গত ২৭ ডিসেম্বর এ বছরের বৃত্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং গত বছরের বৃত্তিপ্রাপ্তদের মাঝে অর্থ ও সনদ সরবরাহ করেছি। আমাদের বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় এটা করে থাকি। এবারের পরীক্ষায় অংশ নেয় শতাধিক শিক্ষার্থী। চতুর্থ শ্রেণিতে বৃত্তি পায় ২৫ জন। পঞ্চম শ্রেণিতে ২৮ জন এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৮ জন।

ঢাকা টাইমস: কতদিন ধরে এটি করে আসছেন?

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: ২০০৬ সাল থেকে করে আসছি। প্রতি বছরই আমরা বৃত্তি দিয়ে থাকি।

ঢাকা টাইমস: কী ধরনের পরীক্ষা আর বৃত্তি দিয়ে থাকেন।

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: এটা হলো বাংলা দ্বিতীয় পত্র ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র। আমরা গ্রামারটার উপরে নজর দেই বেশি। গ্রামারে যাতে বাচ্চাদের নলেজটা বাড়ে। প্রতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষা নেই ও বৃত্তি প্রদান করি। বছরের শেষ শুক্রবারে পরীক্ষা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কাজটা করি। আমি প্রতিবছর এই প্রোগ্রাম বাবদ তিন থেকে চার লাখ টাকা ব্যয় করে থাকি। আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন শরণখোলার তাফালবাড়ি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. বেলায়েত হোসেন।

ঢাকা টাইমস: কত সাল থেকে এই বৃত্তি দিয়ে আসছেন?

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: ২০০৬ সাল থেকে এই বৃত্তি দিয়ে আসছি। ১৫ বছর ধরে আমাদের এই গ্রোগ্রাম চলছে। ১৫ বছরে আড়াই হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছি। আমরা দেখি যদি কোনো শিক্ষার্থী গরিব কিন্তু মেধাবী, তাহলে পরীক্ষা নিই না। পরবর্তী সময় তাদের এমনিই বৃত্তি দিয়ে থাকি। এ পর্যন্ত আমাদের ফাউন্ডেশন থেকে চারজন গরিব ও মেয়ে অনার্স পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে এবং সাতজন ছেলে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছে।

ঢাকা টাইমস: সিসিবি ফাউন্ডেশন কত সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং জনস্বার্থে কতগুলো মামলার রায় পেয়েছেন?

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম: ২০০৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছি। এ যাবত মোট পাঁচটি মামলার রায় পেয়েছি। তার মধ্যে বড় মামলা হলো শাহজাহানপুরের নলকূপে পড়ে জিহাদ নামের যে ছেলেটি মারা গেছে তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দিতে পেরেছি ২০ লাখ টাকা। মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে খাদিজার মামলা। একটি ধর্ষণ মামলা, যেটি মানবাধিকার কমিশন সহযোগিতা করে নাই। আজিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রায়তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেই শিশুটির জন্য হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করে রায় পেয়েছি। রায়ে আদালত বলেছে, আজিমপুর স্কুলে পড়ালেখা করতে রায়তাকে তাকে কোনো ধরণের বাধা না দেয়া হয়। সেই মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলার রায় পেয়েছি।

[ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন পিরোজপুরের কে এম আব্দুল লতিফ ইনস্টিটিউশনে। অন্যের বাড়িতে জায়গির (লজিং) থেকে পড়ালেখা করেছেন। এসএসসিতে বোর্ডস্ট্যান্ড করেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে মেধাতালিকায় হন দ্বিতীয়। এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডে তৃতীয় স্থান অধিকার করে পত্রিকার শিরোনাম হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়ার পর লন্ডন থেকে অর্জন ককরেন বার অ্যাট ল।]