পোস্টারের দেয়ালে ঘিরেছে গোটা রাজধানী

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৫৪ | প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০২০, ১০:২৯

ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে নীলক্ষেত মোড়ে বিশাল ফটক তৈরি করেছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ নামের ওই ফটক খুলে দেয়ার পরই ছেয়ে যায় নানা পোস্টারে। এমনকি ২০ ফুট উঁচুতে তোরণের ওপরের অংশও ঢাকা পড়েছে। ফলে কারুকার্য শোভিত এই তোরণটির সৌন্দর্যই ঢাকা পড়ে গেছে।

এমন চিত্র শুধু এখানেই নয়, গোটা রাজধানীর এমন কোনো অলিগলি নেই যেখানে যত্রতত্র চোখে পড়বে না পোস্টার। রাতের বেলা লাগিয়ে যাওয়া এক পোস্টারের ওপরে পরের রাতে সাঁটানো হয় আরেকটি পোস্টার। এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের দেয়ালও ঢাকা পড়ছে পোস্টারের পর পোস্টারে।

রাজনৈতিক দলে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে স্কুল কমিটির নির্বাচন; বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে শুরু করে ধর্মীয় উৎসব ঘিরে শুভেচ্ছা জানানো সবেরই দেখা মিলবে এসব পোস্টারে। এ ছাড়া চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বাসাভাড়া, সিনেমার বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি রয়েছে দেয়াল লিখনও। পোস্টারের আঘাত থেকে বাদ যাচ্ছে না পদচারী সেতু, ট্রাফিক পুলিশের বক্স, যাত্রী ছাউনি, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গাছপালা। বিপজ্জনকভাবে বৈদ্যুতিক তারেও ঝোলানো হচ্ছে পোস্টার ও ব্যানার।

নগরের সৌন্দর্য বর্ধনে কর্তৃপক্ষ বারংবার হুঁশিয়ারি দিয়েও কমাতে পারেনি যত্রতত্র পোস্টার সাঁটানোর প্রবণতা। উল্টো কারণে-অকারণে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পোস্টার সাঁটানোর মাত্রা বেড়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কোথাও কোথাও দীর্ঘ সময় নিয়ে পোস্টার ছিঁড়ে নিয়ে গেলেও রাতের বেলা আবার লাগানো হয়। এভাবে পোস্টারে নগর ছেয়ে ফেলাকে ‘দৃশ্যদূষণ’ বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। আইনের প্রয়োগ করে হলেও এবিষয়ে যথার্থ উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবি বলে তাদের ভাষ্য।

সরেজমিনে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ, ফার্মগেট, মগবাজার, বাংলামোটর, খিলগাঁও, মৌচাক, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় পোস্টার লাগেনি এমন দেয়াল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রায় সব দেয়ালে ‘এখানে পোস্টার লাগানো নিষেধ’ উল্লেখও রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে নিষেধ মানা হয়নি। নিষেধের লেখাটিও চাপা পড়েছে পোস্টারের গায়ে।

ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা মারুফ হাসান হিমেল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পোস্টারের একটা মাত্রা থাকে। তারা নিজেদের প্রচারণার জন্য পরিবেশ নষ্ট করে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’

ধানমন্ডি ও এর আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে রেস্তোরাঁ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। ব্যানার, ফেস্টুনের মাধ্যমে ছেয়ে ফেলা হয়েছে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড। পরিবেশ বন্ধু গাছগুলোকেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচার মাধ্যম হিসেবে।

বাদ যাচ্ছে না স্মৃতিস্তম্ভ-গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ভবনের দেয়াল, প্রাচীর, বৈদ্যুতিক তারে বিজ্ঞান সেঁটে দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন বুথ বানিয়েছেন বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভকে। মোহাম্মদপুর আসাদ গেটে রয়েছে শহীদ আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিবিজড়িত স্তম্ভটির গায়ে পোস্টার লাগাতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ সেখানে রাজনৈতিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোস্টারের কমতি নেই। একই অবস্থা ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের ‘ইস্পাতের কান্না’ স্তম্ভে।

এ ছাড়া মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের দেয়াল, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, লালবাগ কেল্লা, শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর, সার্ক ফোয়ারা সহ সড়কের মোড়ে মোড়ে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যতগুলো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তার সিংহভাগই এখন বিজ্ঞাপনের দখলে।

আপত্তিকর বিজ্ঞাপন

আপত্তিকর বিজ্ঞাপনের আধিক্য দেখা যায় বাস টার্মিনালগুলোতে। গাবতলি এলাকার দেয়ালগুলোতে দেয়ার লিখনির নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই এলাকায় নারী-পুরুষের গোপন সমস্যার সমাধান, যৌনতার ওষুধ, জাদুটোনার বিজ্ঞাপনের হিড়িক দেখা গেছে। একই চিত্র সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায়। একই সঙ্গে দেখা মেলে বাংলা সিনেমার আপত্তিকর পোস্টারের।

সায়েদাবাদের স্থানীয় বাসিন্দা সজিব সরকার বলেন, ‘যেসব জিনিস প্রকাশ্যে বিক্রি করা যায় না। সেসব জিনিসের প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন কেন দেয়া হয়? আবার জাদু করা, কাউকে বশ করা এসব কথা বলে মানুষ ঠকানোর বিজ্ঞাপনের অভাব নেই। এসব বন্ধ করার দাবি জানাই।’

শ্যামলি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র নাঈম হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিজ্ঞাপন প্রচারের একটি আইন থাকা উচিত। যে সকল সিনেমা পরিবার পরিজন নিয়ে দেয়া যায় না, সে ধরনের সিনেমা টেলিভিশনে প্রচার করা হয় না। এমনকি বিজ্ঞাপনও দেয়া হয় না। তাহলে এ ধরনের বি-গ্রেড সিনেমার বিজ্ঞাপন দেয়ালে দেয়ালে প্রকাশ করা হয় কেন? আমরা কি শিখব, আমাদের ভাই-বোনরা কি শিখবে?’

বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন

আসাদগেট, কলেজগেট, শুক্রাবাদ, সোহবানবাগ এলাকার শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেশি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাস বেশি এসব এলাকায়। ফলে এখানে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপনের সংখ্যারও বেশি। বিজ্ঞাপন সাঁটানোর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় দেয়াল ও বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো সয়লাব হয়ে আছে। বিজ্ঞাপন রয়েছে পদচারী সেতুগুলিতেও। এলোপাথাড়ি সাঁটানো এই বিজ্ঞাপনগুলো জনগনের কি কাজে আসে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারও কারও মতে, শত শত বিজ্ঞাপনের মাঝ থেকে নিজের প্রয়োজনেরটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বছরের শেষ এবং শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায় রাজধানীসহ সারাদেশ। বিভিন্ন অঙ্গীকার ও মানসম্মত শিক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিক্ষার্থী বাগিয়ে নিতে চায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানোর পাশাপাশি সড়কের মোড়ে মোড়ে দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যানার। প্রচারণার এই পদ্ধতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও নগরবাসীর কাছে এটি দৃষ্টিকটু।

এ ছাড়া পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারের প্রচারণার আধিক্য দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা, বিসিএস পরীক্ষার নামেও প্রচার করা হয় বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপন। আর সারা বছর দেখা মেলে চাকরির কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন। ফার্মগেট ও ইন্দিরারোড, গ্রীনরোড, খিলগাঁও, বাসাবো, তেজগাঁও, মিরপুর, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, আগারগাঁও এলাকায় এ ধরনের বিজ্ঞাপন বেশি দেখা যায়।

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সম্মেলনকে ঘিরে নগর ছেয়ে যায় পোস্টার-ব্যানারে। এক দলকে টেক্কা দিতে অপর দল পোস্টারের ওপর পোস্টার সেঁটে যায়। সড়কের মোড়ে মোড়ে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে ব্যানার ঝুলিয়ে নগরের পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। রাজনৈতিক পদধারী নেতা না হলেও কেবল নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে বছরের যে কোনো সময় উপলক্ষ্য পেলেই পোস্টার-ব্যানার এবং ফেস্টুন সাঁটাচ্ছেন অনেকেই।

অলিগলিতে বিজ্ঞাপনের প্রভাব বেড়েছে

গত কয়েক বছরের তুলনায় নগরির অলিগতিতে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বেড়েছে। ব্যানার- পোস্টার সাঁটানো যেন এক প্রতিযোগিতা। তার প্রমাণ দিচ্ছে মহল্লার অলিগলির বৈদ্যুতিক তারে ঝুলন্ত ইন্টারনেট, ক্যাবল অপারেটর প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। এছাড়া সাঁটার মিস্ত্রী, বাসা-অফিস বদল, গৃহ শিক্ষক দিচ্ছি/নিচ্ছি সহ নানা বিজ্ঞাপনে সয়লাব ভরনের দেয়াল, জানালা এমনকি মূল ফটক।

ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন

সাধারণত প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলেও এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করে চলেছে একটি চক্র। নগরে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস ও লেগুনায় দেখা যায় নানা ধরনের বিজ্ঞাপন। যানবাহনের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিপদে পরছেন চাকরি প্রত্যাশী অনেকেই। চমকপ্রদ চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই সেখানে যোগাযোগ করেন। পরে দেখা যায় এগুলো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান বা ভুয়া প্রতিষ্ঠান। চাকরির নামে প্রতারণার পাশাপাশি অনেকের থেকে এ প্রতিষ্ঠানগুলো হাতিয়ে নেয় বিভিন্ন অংকের টাকা।

ঢাকাবাসী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শুকুর সালেক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ ধরনের বিজ্ঞাপন নগরির সৌন্দর্য নষ্ট করছে। বিভিন্ন আপত্তিকর বিজ্ঞাপনও প্রায়ই চোখে পরে। ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায় বের হলে সেগুলো দেখলে বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয়।’

সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং নগরবাসী উভয়ের এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন এই সংগঠক। বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে আমরা যারা নাগরিক আছি, তাদেরও সতর্ক হতে হবে। কারণ যারা এই ব্যানার-পোস্টার লাগান তারাও এই দেশেরই নাগরিক।’

শহরের এই চিত্রকে এক কথায় দৃশ্যদূষণ হিসেবে চিহ্নিত করে নগরবিদ ইকবাল হাবীব ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দৃষ্টিদূষণের একটি মাত্রাজ্ঞান থাকা বাঞ্চনীয়। বিজ্ঞাপন কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে, এর কনটেন্ট কি হবে এমন একটা নীতিমালা থাকবে। কিন্তু সেই নীতিমালাটি নেই। মেয়র আনিসুল হক যখন ছিলেন, তিনি একটি নীতিমালা করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কেউ এটি অনুসরণ করলেন না। নীতিলামাহীনভাবে যার যেখানে খুশি এই দৃষ্টিদূষণের ক্ষেত্রটিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে অনাচার, জোর যার এমন কার্যক্রম চলছে।’

নগর দর্শনে নিজ জাতি, সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নগর দর্শন কি হবে সেটা এই দৃষ্টিদূষণের জায়গাটিতে মাত্রাজ্ঞান নির্ধারিত হওয়া উচিত। একটা শহরের নগর দর্শন হবে তার জাতি, সংস্কৃতি, বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১০জানুয়ারি/কারই/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :