বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে আগামী দিনের বাংলাদেশ

ব্যারিস্টার এম এম জি সারোয়ার (পায়েল)
| আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ১০:০৮ | প্রকাশিত : ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ০৮:০৫
ব্যারিস্টার এম এম জি সারোয়ার (পায়েল)

প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক নির্মাতা এবং স্বাধীন বাংলার সফল রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন। সে হিসাবে ১৭ মার্চ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মের শত বছর পূর্ণ হবে। আর ঠিক পরের বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ উপলক্ষে ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে সরকার।

সংগত কারণেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিরাট আকারে কর্মযজ্ঞ চলছে জাঁকজমক-পূর্ণভাবে মুজিববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে তা ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে ও তাঁর আদর্শ সামনে রেখে যদি আমরা আগামী দিনের বাংলাদেশ নির্মাণে আজকের ন্যায় দৃঢ়প্রত্যয়ী ও কর্মনির্ভর থাকি, তবে তাই হবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও স্মরণে রাখার শ্রেষ্ঠ উপায়।

১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রতিহত করতে কলকাতার বেকার হোস্টেলে ২৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র শেখ মুজিবর রহমানকে কলেজের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রতিহত করতে তিনি অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ১৯৬৬-এর ছয় দফা দাবিতে সারা বাংলা সফর ও জনমত গঠনের কাজে সক্রিয় থাকায় একই বছরে তিনি কেবল ৩ মাসে ৮ বার গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৮ সালে আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার ও বিচারকার্য্যরে সম্মুখীন হন। এর ফলশ্রতিতে ১৯৬৯ সালে হয়ে ওঠেন মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এই আন্দোলন পরিণত হয় গণ-আন্দোলনে। ফলশ্রুতিতে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে দিয়েছিলেন অগ্নিঝরা ভাষণ, যার মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দাবানল। ফলশ্রুতিতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নতিস্বীকার করতে হয়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে। বাঙালি জাতি পেয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, একটি সম্পূর্ণ মানচিত্র।

বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণকে উদ্দেশে করে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতাং লিখেছেন:

“কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণ সূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতা খানি,

“এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তীর সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

গত ৫০ বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষনকে ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার জন্য খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন। তার মধ্যে তিনি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য কর্মসূচির। কেননা দেশ স্বাধীন হবার প্রায় ৫০ (পঞ্চাশ) দিনের মধ্যেই সব ভারতীয় সৈন্যকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করানো ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, যা তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে মোকাবেলা করেন। সরকারপ্রধান হিসাবে বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য দিক হলো মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান এবং সেই সাথে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পনের আহ্বান জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত অস্ত্র রাষ্ট্রের নিকট গচ্ছিত রাখা।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রায় ১ (এক) বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেন। দেশের মানুষের দারিদ্র্যতা দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতির জনক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার সময়কালে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ ও পাঁচ হাজার টাকার ওপরে কৃষিঋণ মওকুফ ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরী মনোভাব নয়’। এর ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা পরবর্তীতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ১৪২টি দেশ এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ এবং বিশ^শান্তি আনয়নের প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। এক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে বিশ^শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করেন ‘জুলিওকুরি’ শান্তি পদক। বঙ্গবন্ধু দেশকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সেই সাথে ভালোবাসতেন ও বিশ^াস করতেন দেশের প্রতিটি মানুষকে।

এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঘাতকচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সব স্বপ্ন ও ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে ফেলেছিল। অতঃপর, তাঁর সুযোগ্য কন্যা টানা তৃতীয়বারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বাঙালি জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর প্রগতিশীল নেতৃত্বের অধীনে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি নিয়ে এখন উন্নতির পথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বর্তমান কাজের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপনীত হবে মধ্যম আয়ের দেশে। সেই সাথে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ পরিণত হবে উন্নত দেশে। ইতিমধ্যে গত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১০৬ ভাগ, প্রবৃদ্ধি গড় ৬.৮৮%, দারিদ্র্য হৃাস পেয়েছে ১১%। সেই সাথে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পেয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। শিক্ষা ক্ষেত্রে এসেছে বিপুল আলোড়ন। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান ডিজিটাল বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অত্যন্ত ১০টি মেঘা প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘিরে।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। সেহেতু, একটি সুখী-সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মুজিব আদর্শে অনুপ্রাণিত জনতা আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মিছিলে আলোর মশাল নিয়ে দৃঢ় পায়ে সমবেত এবং তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে লক্ষ্য মুজিবের কণ্ঠধ্বনি, প্রতিধ্বনি।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :