শিয়া-সুন্নি মতভেদ আছে, তাই বলে সহাবস্থান অসম্ভব?

ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক
| আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১১:৩২ | প্রকাশিত : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১১:০১

আমাদের দেশে অনেক মুসলমান শিয়া ও সুন্নিদের ধর্মতাত্ত্বিক মতভেদ সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়। এতে দোষের কিছু নেই, বরং ভালো, নিজেদের বিভক্তি সম্পর্কে জানা না থাকলে অনেক সময় মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এই অজ্ঞতা মাঝে মাঝে বিপদ ডেকে আনে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভ্রান্ত করে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে আমরা দ্রুতই পৃথিবীর নানাপ্রান্তের খবরাখবর পাই এবং আবেগে প্রভাবিত হই। ফলে মানুষ হিসেবে নানাবিধ মতপ্রদান করি এবং পক্ষাবলম্বন করি। আমাদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের ভাইদের এহেন কড়া বিভক্তি মেনে নিতে পারে না।

তাদের এহেন মানসিকতা ইতিবাচক, প্রশংসার্হ। তবে যে অঞ্চলের ঘটনা, সেখানকার বাস্তবতা ভিন্ন। সেটি জানলে আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম যে, শিয়া-সুন্নি বিভেদ এমন এক বাস্তবতা, যা পরিহার করা যায় না। ওই বিভেদের আলোচনা কেবল তিক্ততাই বাড়ায়।

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, নানা মতভেদ সত্ত্বেও সহাবস্থান কি সম্ভব নয়? যারা খ্রিস্টবাদের ইতিহাস জানেন, তাদের কাছে এযুগে বিভেদের চাষাবাদ আরো অদ্ভত মনে হয়।

খ্রিস্টানদের উপদল সংখ্যা মুসলমানদের তুলনায় মোটেও কম ছিল না। নানা-উপদলের লড়াইও মুসলমানদের তুলনায় কম তিক্ত নয়। তবে খ্রিস্টান উপদলসমূহের যুদ্ধের শতাব্দিগুলো বহু আগে অতিবাহিত হয়েছে। সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত খ্রিস্টান উপদলগুলো নিজেদের মাঝে বহু মর্মন্তুদ লড়াই করেছে। ইউরোপে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যোন্টপ্রধান রাজ্যগুলোর মাঝে সংঘটিত হয়েছে। তারা যতটা নির্মম নিষ্ঠুর পন্থায় স্বধর্মী ভিন্নমতবিলম্বীকে হত্যা করেছে, সেটির চর্চা মুসলমানদের মাঝে ছিল না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আনাব্যাপ্টিস্ট নামে একটি ক্ষুদ্র ও নিরীহ খ্র্রিস্টান উপদলের সদস্যদেরকে বিরোধীরা হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করত। ইউরোপ সেই কাল পার হয়ে এসেছে। সেই মহাদেশে ধর্মীয় উপদলগুলোর রক্তাক্ত সংঘাতের অবসান হয়েছে প্রায় দুইশ’ বছর আগে। সেই হিসেবে আমরা খ্রিস্টানদের তুলনায় দুই শ’ বছর পিছিয়ে। কিন্তু খিস্টানরা কীভাবে উপদলগুলোর রক্তাক্ত হানাহানি বন্ধ করতে পারল?

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জার্মান পণ্ডিত Dietrich Werner আমাকে দু’টো কারণ জানিয়েছিলেন। প্রথমটি ধর্মবেত্তাদের সাথে জড়িত, দ্বিতীয় সাধারণ মানুষের সাথে। ধর্মবেত্তাগণ পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একে অপরকে স্বীকৃতি দেন। মতভেদ তো দূর করা সম্ভব নয়। তাই মতভিন্নতা বহাল রেখেও কীভাবে সহাবস্থান করা সম্ভব, তার কিছু উপায় চিহ্নিত করেন। সকলে মেনে চলার জন্য কিছু কমন টার্মস নির্ধারণ করেন এবং তিক্ত বিরোধ হলে তা নিরসনের জন্য অংশীদারিত্বমূলক কাউন্সিল গঠন করেন। অবশ্য ধর্মবেত্তাগণ এ পর্যায়ে আসতেন না, যদি না জনগণের চাপ থাকত। ধর্মযুদ্ধ ক্ষতি বৈ কল্যাণ বয়ে আনে না। এহেন উপলব্ধি হতে জনগণের মাঝে এক ধরনের ধর্মযুদ্ধবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়, এক পর্যায়ে পোপ ও প্যাট্রিয়ার্খগণ তা মেনে নিতে বাধ্য হন। কারণ তারা আচঁ করতে পেরেছিলেন, বিভেদচাষ অব্যাহত রাখলে সমাজ তাদেরকে ছুঁড়ে মারবে।

আমার আলো আছে, তাই অপরের আলোর প্রতি আমি মুখাপেক্ষী নই- এমন মনোভাব সবসময় লাভজনক নয়। আমাদের আলো আছে, তবুও আমরা খ্রিস্টবাদের ইতিহাস হতে উপকৃত হতে পারি। যদিও দুই ধর্মে বিভক্তির ইতিহাস সমান্তরালে প্রবাহিত হয়নি, তবুও ধর্মের বিকাশের কিছু গতিধারা অভিন্ন হয়ে থাকে। তাই পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সহাবস্থানের বিষয়ে আমরা খ্রিস্টবাদ ইতিহাস হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি।

পারস্পরিক স্বীকৃতির অর্থ এটা নয় যে, আপনাকে মানতে হবে শিয়ারা খাঁটি মুসলিম। অমুসলিমদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে, ব্যক্তি পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। সেটি যদি সম্ভব হয়, মুসলিম উপদলের সাথে কেন নিরাসক্ত সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হবে না? আমরা মনে করি, শিয়ারা একটি ফিরকা। এটি মাথায় রেখেই পারস্পরিক ক্ষতি পরিহার করার মত সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখা সম্ভব। এজন্য আলাপ-আলোচনার বিকল্প নেই। সবসময় গোলটেবিলে আলোচনা করতে হয়, এমন নয়। অনেক সময় অসরাসরিও আলোচনা করা যায়। নানা মাধ্যমে মনোভাব ও প্রতিমনোভাব প্রকাশ করা যায়। এভাবে প্রতিটি দল নিজেদের সম্মান ও ভক্তির বিষয়গুলো, নিজেদের রেড লাইন অপরকে জানাতে পারে এবং এসব বিষয়ে সম্মান প্রদর্শন না করুক, অন্তত উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহার করেও মতভেদ বহাল রেখেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।

আমরা তাত্ত্বিকভাবে যতটা সহজে শিয়া-সুন্নির সহাবস্থান সম্ভব বলে মনে করছি, বাস্তবে ততটা সহজ নয়। আমাদের দেশে শিয়াদের সংখ্যা খুবই কম হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে অবোধগম্য মনে হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা ভিন্ন; ওই অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি সহজ নয়। বিশেষত, কিছু শাসকগোষ্ঠী ও রেজিম তাদের ক্ষমতা সুসংহতকরণের শিয়া-সুন্নি বিভেদকে জিইয়ে রাখার কারণে।

প্রথমে ইরানের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা যাক-

গত শতাব্দির মাঝামাঝিতে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আধুনিক ও অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। রেজা শাহ পাহলভীর রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয় ১৯৭৯ সালে, যখন শিয়া ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে একটি বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিপ্লবের প্রাক্কালে শাহ-বিরোধী ডান-বাম বহু সংগঠন খোমেনির আন্দোলনের অংশীদার ছিল, কিন্তু বিপ্লবের পর তাদের প্রভাব সংকুচিত করে একচ্ছত্র খোমেনি-দাপট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রতিটি বিপ্লবের একটি দার্শনিক ভিত্তি থাকে। খোমেনি-বিপ্লবেরও আছে। তবে শুধু তত্ত্ব দিয়ে বিপ্লব হয় না। শাহ এর অত্যাচার, পশ্চিমা-প্রীতি ও জনঅসন্তোষকে পুঁজি করে বিপ্লব সাধন করা হয়। এক্ষেত্রে খোমেনির নেতৃত্ব ও তার অনুসারীদের ত্যাগ ও কুরবানি ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ক্যারিশম্যাটিক ধর্মনেতা ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ খোমেনি যোগ্য লিডারশিপ ও স্তরে স্তরে বিন্যস্ত জানবাজ কর্মীবাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। ডান-বাম সহযোগীরা বিপ্লবকালেই উপলব্ধি করেন, নতুন পরিবেশে তাদের কোন স্থান নেই। খোমেনি অচিরেই ‘বিলায়াত ফকিহ’ নামে একটি দার্শনিক ভিত্তি উপস্থাপন করেন, যার মর্মার্থ হল, ফকিহদের শাসন। অতি অবশ্যই খোমেনি ফকিহ-শাসন বলতে শিয়া ধর্মবেত্তাদের শাসন বুঝিয়েছেন।

বিপ্লবের একটি ধর্ম হলো, এটি সম্প্রসারণশীল। আবার অনেক মনে করেন, সম্প্রসারণশীল না হলে বিপ্লব সংকুচিত হতে বাধ্য। এমনটি হয়েছে রাশিয়ায়। বিপ্লব বাইরে ছড়িয়ে না দিলে রাশিয়ার বিপ্লবের মৃত্যু হবে, এ তত্ত্বের আলোকে স্ট্যালিন খুনে বিপ্লবকে বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হুবহু না হলেও কাছাকাছি মনোভাব রয়েছে ইরানিদের।

‘বিলায়াতে ফকিহ’ মানেই বিলায়াতে ফকিহ শিয়া। মধ্যপ্রাচ্য-পরিস্থিতি বিবেচনায় ইরানি বিপ্লবের শরীরী সম্প্রসারণ সম্ভবপর ছিল না। তাই ইরান বিপ্লবের কোমল সম্প্রসারণের এজেন্ডা গ্রহণ করে। যুব সমাজ সব সময় বিপ্লব, পরিবর্তন, বীরত্ব ও ত্যাগের মত ফেনোমেনায় উদ্দীপ্ত হয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের যুব সমাজকে ইরানি বিপ্লব মোহে আচ্ছন্ন করা সম্ভব হয়। আধুনিক যুগে ইসলামি বিশ্বের বহু জায়গায় ধর্মীয় চেতনায় ত্যাগের নজির আছে, কিন্তু পার্থিব সাফল্য অর্জন ও বিপ্লব সাধনের দৃষ্টান্ত নেই।

শরীরী সম্প্রসারণ অসম্ভব হওয়ায় ইরান সম্প্রসারণ নতুন মাত্রা গ্রহণ করে, তা হল আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ। শিয়াদের মাঝে ইমামতের ধারণা প্রবল হওয়ায় এবং ইমামের প্রতি নিরংকুশ আনুগত্যের সুবিধা গ্রহণ করে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরানি বিপ্লবের সমর্থক ও ভাবশিষ্য তৈরী করা হয়।

এটি উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজারা নিজেদের মসনদের স্থায়ীত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন এবং ইরানি প্রভাব ঠেকানোর জন্য ধর্মের আশ্রয় নেন। রাজাপন্থী আলিমগণ আকিদাগত পার্থক্যগুলো জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসেন। ফলে হাজার বছর ধরে স্থিত বিভেদের বহু বীজ ক্ষমতার সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের উপজীব্য হওয়ার জন্য উদ্গীরিত হল। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি সহাবস্থানের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রতিবন্ধক।

মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে সুন্নি তরফে সবচেয়ে বড় শক্তি সৌদি আরব। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ, নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের স্বার্থে দ্বন্দ্বমুখর রেজিমগুলোর নিজেদের স্বার্থে শিয়া-সুন্নি বিভেদ উস্কে দেয়া। এ বিষয়টি বুঝতে সবরের সাথে নিম্নের বিবরণ পাঠ করা যেতে পারে।

১. রাষ্ট্রের প্রকৃতি

আধুনিক যুগে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতির ওপর রাষ্ট্রগুলোর সুসম্পর্ক নির্ভর করে। যেমন, কমিউনিস্ট দেশের সাথে কমিউনিস্ট দেশের, রাজতন্ত্রের সাথে রাজতন্ত্রের সুসম্পর্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একদিকে ছিল রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলো, যেমন, জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ও তুরস্ক, অপরদিকে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক দেশগুলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একদিকে ছিল একনায়ক হিটলারের জার্মানি, ফ্যাসিবাদি মুসোলিনির ইতালি ও রাজতান্ত্রিক জাপান। অন্যদিকে ছিল, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মত গণতান্ত্রিক দেশগুলো। এ সত্যটা আংশিকভাবে হলেও মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে সত্য। সৌদি আরব সুন্নি-প্রধান দেশ, ইরান শিয়া-প্রধান দেশ। এক সময় দুটো দেশই রাজতান্ত্রিক ছিল। তখন দেশ দু’টির সম্পর্ক কখনও উষ্ণ ছিল, কখন শীতল। কিন্তু শত্রুতামূলক ছিল না।

ইরানের সাথে সৌদি আরবের প্রথম চুক্তি হয় ১৯২৯ সালে। তবে সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ ছিল না। ষাটের দশকে বাদশাহ ফায়সালের আমলে রেজা শাহ-এর ইরানের সাথে যথেষ্ট সম্পর্ক উষ্ণ হয়। দু’দেশ ওআইসিসহ অন্যান্য সংস্থা গঠনে সহযোগী হয়। এমনকি ইরানের শাহ একবার ‘প্রিয় ভাই’ বলে সম্বোধন করে বাদশাহ ফায়সালকে পত্র লিখেন: ‘আপনার দেশকে আধুনিক করুন, ছেলে-মেয়েদেরকে একসাথে পড়তে দিন। মেয়েদেরকে মিনি স্কার্ট পড়তে দিন, ডিসকো খুলুন’। ফায়সাল ভদ্রভাবে উত্তর দিয়ে লিখেন, ‘ম্যাজেস্টি! আপনি ইরানের প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের নন, আপনার দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম।’

যা হোক, শাহ-এর আমলে সৌদি-ইরান সম্পর্ক সহযোগিতাপূর্ণ ছিল। ইরানে বিপ্লবের পর সৌদির সাথে সম্পর্ক শীতল হয়। এজন্য প্রথম দায় কার, সেটি নির্ণয় করা দুঃস্কর। তবে প্রথমদিকে সৌদির পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়। বাদশাহ খালিদ খোমেনিকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্র লেখেন। কিন্তু ইরাক-ইরান যুদ্ধে সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে সহায়তা করার পর সম্পর্ক শীতল হয়। ১৯৮৭ সালে ইমাম খোমেনি সৌদি শাসকবর্গকে ওয়াহাবি বলে অভিহিত করে মুসলমানদের পিঠে ছুরি চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেন।

২. ‘ইসলামি’ প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্ম-দুশমন আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে আনয়ন

ইরাক-ইরান যুদ্ধ সমাপ্ত হয় ১৯৮৮ সালে। কিন্তু বেশিদিন যুদ্ধ না করে পারলেন না সাদ্দাম হোসেন। ১৯৯০ সালে তিনি কুয়েত দখল করে নেন। কুয়েতি আমির সৌদি আরবে পলায়ন করলে সাদ্দাম হোসেন সৌদি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেন। ইরাকের সাথে যুদ্ধের সামর্থ সৌদি আরবের ছিল না। সৌদির অস্ত্রশক্তি ছিল না। আবার রাজতান্ত্রিক সরকার জনগণের শক্তির বিকাশের ব্যবস্থা করেনি। ফলে আত্মরক্ষার জন্য দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিতে হয়। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে শারিরীক উপস্থিতির সুযোগ লাভ করে। যৌথ বাহিনী গঠন করে ইরাককে কুয়েত হতে বিতাড়িত করে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার শারিরীক উপস্থিতি ইরান শঙ্কিত করে তোলে।

তাহলে ‘ইসলামি’ বিপ্লবের পর দু’টো ঘটনা সৌদি-ইরান সম্পর্ককে শীতল করে। একটি হল, ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে সৌদি আরবের সমর্থন। অপরটি, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দেয়া।

ইরানি নেতৃবৃন্দ যখন বাকচাতুর্যে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ডুপাত করে তখন তার আঞ্চলিক দোসরদেরও বাদ দেয় না। সৌদি আরব ও বাইরাইনে শিয়াদের ওপর নিপীড়ন চালানো হলে ইরানি ধর্মীয় নেতারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে। শুধু তাই নয়, ওই দেশগুলোর নাগরিকদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার আহবান জানায়।

এমতাবস্থায় সৌদি আরব ও বাহরাইন এ ধরনের আহবান ভিনদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করে। বলাবাহুল্য, ইরানের প্রচার-প্রচারণা (শিয়া) ধর্মনির্ভর। সৌদি সরকারের একটি নীতি হলো, দেশটি সাধারণত প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় না। তারা ওই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ঠেকানোর জন্য ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। সৌদি সরকারের অনুগত ও আশ্রয়পুষ্ট আলিমগণ শিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করতে শুরু করলেন। এটি কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, বরং অন্যান্য মুসলিম দেশেও সৌদিফেরত কতিপয় সালফি আলিম শিয়াদের ধর্মবিশ্বাসের ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ইরান-প্রভাব হ্রাসকরণে সচেষ্ট হলেন। দুঃখজনক হল, বাংলাদেশের মত প্রায় শিয়াশূন্য দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ মুসলিম উম্মাহ-এর এ-দুঃখজনক বিভক্তি সম্পর্কে জানত না। কিন্তু শিয়া-আকিদা সম্পর্কে অগ্রিম আলোচনার কারণে মুসলিমরা নিজেদেরকে বিভক্তির উত্তরাধিকারের স্রোতে আবিষ্কার করলেন।

৩. এহেন অবস্থায় কীভাবে সহাবস্থান সম্ভব?

ইরান ও সৌদি আরব, দুই পক্ষের দুটি বড় দেশ। সৌদিরা ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে সাহায্য করেছে, ইরানের জন্ম-দুশমন আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে এনেছে। অতীত তিক্ততার স্মৃতিকাতরতার পাশাপাশি নতুন তিক্ততা। ইরান কীভাবে সৌদিকে বিশ্বাস করবে?

পক্ষান্তরে ষোড়শ শতকে শিয়া সাফাবি রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় সুন্নিদেরকে পাইকারি হারে হত্যা, বাগদাদে শিয়াদের ধ্বংসলীলা, ইমাম আবু হানিফা ও আবদুল কাদির জিলানীর কবরের সম্মানহানির মত শিয়াদের হিংসাত্মক তৎপরতার স্মৃতিকারতার পাশাপাশি আধুনিক যুগে সুন্নি দেশগুলোর শাসক পরিবর্তনের জন্য জনগণকে উস্কানি দেয়ার মত ঘটনার প্রেক্ষিতে সৌদি আরব কীভাবে ইরানের সাথে সুসম্পর্ক রাখবে?

ইরান-সৌদি মনস্তাত্বিক লড়াইয়ে কয়েকটি কারণে ইরান এগিয়ে। প্রথমত, সামরিক শক্তি। সৌদিরা কিছু অস্ত্রশস্ত্র কিনলেও সেগুলো চালানোর মত লোক আছে কিনা, সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়ত, জনগণের সমর্থন। বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইরান সরকার রাজপথে জনগণ নামিয়ে কীভাবে সমর্থন দেখাতে হয় তা জানে। রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব জনগণের রাস্তায় নামা পছন্দ করে না। ওখানে সরকারবিরোধীরা মাঝে মাঝে রাস্তায় নামে। সরকার কখনো আহবান করলে অনভ্যস্ততার কারণে তার সমর্থকরাও মাঠে নামতে পারবে না। দু’টো দেশেরই প্রতিরক্ষার অন্যতম উপায় হল ধর্মের ব্যবহার, প্রকাশ্যে বা গোপনে, সরাসরি বা অপরের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় সহাবস্থান সুদূর পরাহত।

ইরানিরা যদি প্রকৃত অর্থে সহাবস্থান চায়, প্রতিবেশি দেশগুলোর সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া বন্ধ করতে হবে। মেনে নিলাম, সৌদি-আমিরাতি সরকার জালেম। জুলুমের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ কিন্তু ইরানিদের বিরুদ্ধেও করা যায়। সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অনবরত উস্কানি দিয়ে এবং সেক্ষেত্রে শিয়া ধর্মমত ব্যবহার করে সহাবস্থান আশা করা যায় না। পক্ষান্তরে ইরানের রেজিম পরিবর্তনের গোপন এজেন্ডা থেকে সৌদি আরবকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলে উত্তেজনার অবসান হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষায় ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার বন্ধ হলে ধীরে ধীরে উপদলীয় উত্তেজনা কমে আসবে, সহযোগিতা না হোক, ক্ষতি এড়ানো যায়, এমন পর্যায়ের সহাবস্থান সম্ভব।

তবে আমরা জানি, এগুলোর কিছুই হবে না। সরকারগুলো নিজের স্বার্থে অপকর্ম করেই যাবে। পরিবর্তন কেবল সম্ভব জনগণের উদ্যোগে। জনমতের বিকাশে। জনমতের চাপ অবুঝ সরকারকে বুঝতে বাধ্য করতে পারে। একটা কথা মনে রাখা দরকার শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বয়স এক হাজার বছরের বেশি। কেউ কাউকে মিটিয়ে দিতে পারেনি। এখনও পারবে না। তাই নিজ নিজ সীমায় অবস্থান করে অপরের পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ না করলেই উত্তেজনা নিরসন সম্ভব। কোন এক দলকে মুছে দেয়ার চেষ্টা কখনো সফল হবে না।

সরকারগুলো যদি উত্তেজনা নিরসন ও সহাবস্থানের কোন পদক্ষেপ না নেয় যদি, ধর্মীয় উত্তেজনা ও হানাহানি যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলে হয়ত এমন কিছুর আমদানি হবে যা কারো জন্য সুখকর হবে না, যার নামও আমি উচ্চারণ করতে চাই না।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :