গরু চুরি ঠেকাতে সমাবেশ

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী
 | প্রকাশিত : ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ২১:৪৯

মোস্তাক হোসেনের সম্বল ছিল দুটি বলদ। কিন্তু ছেলে অসুস্থ বলে তিনি এই বলদ দুটিই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দরদাম চলছিল। একজন ক্রেতা দুটি বলদের দাম ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু মোস্তাক বিক্রি করতে পারেননি। তার আগেই চোরে নিয়ে গেছে বলদ দুটি।

মোস্তাকের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমতলা গ্রামে। গত ১২ জানুয়ারি রাতে তার বলদ দুটি গোয়াল থেকে চুরি হয়েছে।

মোস্তাক বলেন, হাল চাষ করেই তার সংসার চলে। কিন্তু হালের বলদ বিক্রি করেই চিকিৎসার জন্য ছেলেকে ভারতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই চোর গোয়াল ফাঁকা করে দিয়েছে। এখন তিনি নিঃস্ব। ছেলের জীবন নিয়েই তিনি এখন শঙ্কায়।

শুধু মোস্তাক একা নন। গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ও গোগ্রাম ইউনিয়নের অনেকেরই গরু চুরি হয়েছে সম্প্রতি। এতে কৃষকরা আতঙ্কিত। তাই চুরি ঠেকাতে অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ রাত জেগে নিজেদের গরু পাহারা দিচ্ছেন। দুটি গ্রামের মানুষ তো টর্চ লাইট আর লাঠি নিয়ে সারারাত গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গ্রাম দুটি হলো- খারিজাগাতি মোল্লাপাড়া ও নিমতলা। আর বিয়ানাবোনা, কানাইডাঙ্গা, নীলবোনা, ছয়ঘাঁটি, চাঁপাল, পালপুর, বিড়ইল, দমদমা, আগলপুর, শ্রীরামপুর, মালিগাছা, ধরমপুর ও কমলাপুরসহ আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের মানুষ রাতে বাড়িতেই জেগে থাকছেন।

এদিকে গরু চুরি ঠেকাতে শনিবার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকালে খারিজাগাতি মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর এই সমাবেশের আয়োজন করে দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)।

এতে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের গোদাগাড়ী সার্কেলের পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক ও গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম। তাদের কাছে এলাকাবাসী নিজেদের গরুর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।

সমাবেশে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন- ওয়ার্কার্স পার্টির জেলার সভাপতি রফিকুল ইসলাম পিয়ারুল। সভাপতিত্ব করেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. আক্তারুজ্জামান। সমাবেশে গ্রামবাসী দাবি করেছেন, চোর আসছে পুলিশের পোশাক পরে।

এলাকাবাসী জানান, শীতের শুরু থেকে এলাকায় গরু চোরের উপদ্রব বেড়ে গেছে। তারা একজন চোরকেও ধরতে পারেননি। থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গরুও উদ্ধার হয়নি। ফলে তারা নিজেরাই এখন রাত জাগতে শুরু করেছেন। নিমতলা ও খারিজাগাতি মোল্লাপাড়া গ্রামের মানুষ পালা করে দল বেঁধে লাঠি ও টর্চলাইট নিয়ে গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন। চোর ধরা পড়লে তার প্রাণ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হবে, এমন আশঙ্কার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান এই সমাবেশের আয়োজন করেন।

গ্রামবাসী জানান, গত ১০ জানুয়ারি রাতে নাজিরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লাল মোহাম্মদের বাড়ি থেকে তিনটি গরু চুরি হয়েছে। এর আগে ৩ জানুয়ারি একই গ্রামের বাসিন্দা দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য রওশন আরা বেগমের বাড়ি থেকে একটি গাভী চুরি হয়েছে। এছাড়া ১ জানুয়ারি দমদমা গ্রামের নাজিম উদ্দিনের চারটি, ২৬ ডিসেম্বর কামিরপাড়া গ্রামের শাহজাহান আলীর দুটি, ১৫ ডিসেম্বর ছয়ঘাঁটি গ্রামের রায়হান আলীর একটি, ৫ সেপ্টেম্বর কানাইডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিনের দুটি, একই রাতে ওই গ্রামের মোস্তাক আলীর দুটি এবং ২৮ আগস্ট মানিক মিয়ার একটি গরু চুরি হয়েছে। একের পর এক গরু চুরিতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন গ্রামের মানুষ। গত এক সপ্তাহ ধরে চোর ধরতে রাত জেগে তারা পাহারা দিতে শুরু করেছেন।

পুলিশের সঙ্গে সমাবেশে ইউপি সদস্য আক্তার উদ্দিন বলেন, এলাকার মানুষ দাবি করছেন, পুলিশের পোশাক পরেই গ্রামে গরু চোর ঢুকছে। এমনকি পুলিশের গাড়ি যাওয়ার পরেই চোর ঢুকছে। এ কথা বলার সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকশো জনতা করতালি দিয়ে বক্তাকে অভিনন্দন জানান।

ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রফিকুল ইসলাম পিয়ারুল বলেন, পুলিশের সঙ্গে তাদের শত্রুতা নেই। আবার সব পুলিশই খারাপ নয়, কোনো কোনো পুলিশ খারাপ হতে পারে। আমাদের মধ্যেও খারাপ লোক আছে। তারাও চোরকে সহযোগিতা করছে। আমাদের দাবি, পুলিশের স্বচ্ছতা থাকতে হবে যাতে জনগণ পুলিশের ওপরে আস্থা রাখতে পারে। আমরা সবাই মিলেই সমস্যার সমাধান করব।

খারিজাগাঁতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিহাব উদ্দিন বলেন, পুলিশকে নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অস্বস্তি আছে- তা পুলিশকেই দূর করতে হবে। তিনি মনে করেন, পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেই তাদের কাজ করতে হবে। তাছাড়া তারা গ্রামের এই গরু চুরি রোধ করতে পারবেন না।

সমাবেশে ওসি খাইরুল ইসলাম বলেন, গোদাগাড়ী রাজশাহী জেলার একটি বড় থানা। এখানে চার লাখ মানুষের বাস। চার লাখ মানুষের জন্য পুলিশ আছে ১২০ জন।

তিনি বলেন, শুধু পুলিশের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুললেই হবে না। দেখতে হবে একজন মানুষের জন্য ভাগে কয়জন করে পুলিশ পড়ে। আমাদের যদি কোনো ব্যর্থতা থাকে আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। তবে নাগরিক হিসেবে আপনারও রাষ্ট্রের প্রতি অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সব দায়িত্ব কি পুলিশের? প্রশ্ন করেন তিনি।

ওসি বলেন, আমরা গরু চোরের সন্তান নয়। আমাদের মধ্যে কোনো গরু চোর নেই। আপনারা পেলে ধরে বেঁধে রেখে থানায় খবর দেন। আমি মনে করি, আপনাদের মধ্যেও চোর আছে। ধাওয়া দিলে সে আপনাদের মধ্যেই মিশে যাবে। এখানে যারা বসে আছেন, তাদের মধ্যেই হয়তো চোর বসে আছেন। তিনিও এ কথা শুনছেন। আমি অভিযোগ পাওয়ার পরেই ছুটে এসেছি। আমিও কৃষকের সন্তান। যার একটি গরু চুরি হয়ে যাচ্ছে তার ব্যথা আমি বুঝি। তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।

তিনি বলেন, আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেন গরু চুরি ঠেকাতে পারি সেই চেষ্টা করব। আমরা চাই আগের মতো আপনারা বাইরে গরু রেখে নিশ্চিন্তে ঘরে ঘুমাতে পারেন। আমি কথা দিচ্ছি, অধিক রাতে আর কোনো পুলিশ সাদা পোশাকে এই এলাকায় আসবে না।

তিনি বলেন, গ্রামবাসীর রাতের পাহারা চলবে। আপনি গরু চোর ধরে আমাকে ফোন করবেন। আমি নিজে এখানে চলে আসব। তিনি তার ফোন নম্বর দিয়ে দেন। বলেন, সবাই মিলেই গরু চুরি ঠেকাব।

(ঢাকাটাইমস/১৮জানুয়ারি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :