একজন ব্যারিস্টার শেখ তাপস

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
| আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৬ | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ২০:১৪

জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে নিয়ে এখনই কোনো কিছু লিখব আগে ভাবিনি। কিন্তু তাঁর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসাবে নমিনেশন পাওয়ার পর থেকে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে আমার খুব সামান্য জানা বা না-বলা কিছু কথা, কিছু অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত।

তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনো কথা বলার সুযোগ কখনো হয় না, তবে তাঁর বিষয়ে বেশি করে শুনে আসছি শুধু ‘তাপস’ হিসাবে আশির দশক থেকে। তখন দুটি কারণে আমাদের পরিবারে বারবার তাঁর নাম উচ্চারিত হতে শুনেছি। আমার বিয়ের পর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আমরা ঢাকার ঝিগাতলায় বসবাস করতাম। ঢাকায় অবস্থানরত আমাদের গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া ও বর্ণীবাসী অনেক ছাত্রনেতা নিয়মিত আমাদের বাসায় যাতায়াত করতো সেসময়। মতিঝিলে দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ অফিসেও তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। তারা সেসময় মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব শেখ ফজলুল করিম সেলিমের অনুসারী ছিল। এসময় আমার স্বামী মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে ঢাকার সিএমএম আদালতে কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজেও একসময় ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং বাংলাদেশে প্রথম বিসিএস ( প্রসাশন ক্যাডার ) কর্মকর্তা হিসাবে ১৯৭৩ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন (যারা মুক্তিযোদ্ধা বিসিএস কর্মকর্তা হিসাবে চিহ্নিত )। ছাত্র অবস্থাতে তিনি জনাব শেখ ফজলুল হক মনির ভক্ত-শিষ্য ছিলেন। বিয়ের পর রাজনীতিতে অপরিপক্ব আমাকে তিনি রাজনীতির কথা শুনাতেন। আমাকে তিনি সবসময় তাঁর ছাত্রজীবনের গল্প করতেন, মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতেন। তাঁর গল্পে বারবার বঙ্গবন্ধুসহ জনাব শেখ ফজলুল হক মণি, জনাব শেখ কামালের নাম উচ্চারিত হতো।

গোপালগঞ্জের ওই ছাত্রনেতাদের সাথে কথা বলার সময় তিনি জনাব শেখ ফজলুল হক মনির সন্তানদের কথা জানতে চাইতেন, তাঁর সন্তানরা কেমন আছে, কত বড় হয়েছে, কী পড়াশোনা করছে– এ জাতীয় কথা জানতে চাইতেন। পরশ ও তাপস- এই নাম দুটি তখন তাদের মুখে বারবার উচ্চারিত হতে শুনেছি। মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব শেখ সেলিম যিনি জনাব শেখ মনির ছোট ভাই- পরশ ও তাপস সরাসরি তারই ছত্রছায়ায় বড় হচ্ছে এই অনুভূতি আমার স্বামীকে জনাব শেখ সেলিমের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতাবোধে আপ্লুত করত।

এসময় ১৯৮২ সালের কোনো একদিন গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়ার সেসব ছাত্রনেতা আমাদের ঝিগাতলার বাসায় আমার স্বামীর কাছে এক দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়। তাদের দাবি ছিল- জনাব শেখ সেলিমের ব্যক্তিগত বডিগার্ডকে নিয়ে- যাকে মিথ্যা অবৈধ অস্ত্র মামলায় তখন অ্যারেস্ট করা হয়েছিল (যতদূর মনে আছে তার নাম ছিল শাহজাদা)। তারা সবাই অনুরোধ করছিল তাকে যেন জামিন দেয়া হয়। সেই ব্যক্তিগত বডিগার্ড তার বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলা থেকে আমার স্বামীর কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিল।

আমার বড় বোনের কাছ থেকেও তাঁর মতো করে পরশ ও তাপসকে নিয়ে মন খারাপ করা গল্প শুনতাম, পিতৃ-মাতৃহীন সেই দুজনের জন্য আমার বোনের ছিল অগাধ ভালোবাসা। সে সময়কার পিজিতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) কর্মরত আমার বড় বোন জনাব শেখ সেলিমের মাতাকে দেখতে তাঁদের বাসায় মাঝে মাঝে যেতেন (যিনি জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের দাদি)। সম্ভবত ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি আমাদের গোপালগঞ্জের সবার মুখে শুনে শুনে তাঁদের দুই ভাইকে আমি পরশ ও তাপস হিসাবেই জেনেছি।

জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে আমি প্রথম খুব কাছ থেকে দেখি ২০০৮ সালে। তখন দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে সংসদ ভবনে আস্থায়ীভাবে গঠিত বিশেষ আদালতে প্রতিদিন আওয়ামী লীগ প্রধান, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্ট কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শুনানি চলছিল। আমি প্রায় প্রতিদিন সেখানে উপস্থিত থেকে সেসব মামলার শুনানি দেখেছি, শুনেছি। আমি প্রায় প্রতিদিনই গাড়ি থেকে নেমে অস্থায়ী কোর্ট ভবনে ঢোকার মুখে দেখেছি আওয়ামী লীগ পক্ষের আইনজীবী হিসাবে জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস নিঃশব্দ উৎকণ্ঠা নিয়ে অন্যান্য সিনিয়র আইনজীবীর অপেক্ষায় ভবনের করিডোরে অপেক্ষা করছেন বা পায়চারী করছেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর জন্ম হলে তখন তাঁর বয়স সম্ভবত ৩৫ বছর। এই ৩৫ বছর বয়সে অভিযুক্ত শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তা কামনায় সব আইনজীবীকে সুসংগঠিত সংঘবদ্ধ করাতে তাঁর দৃঢ়তা ছিল অভিভাবকতুল্য। সেই বয়সে তিনি আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের একত্র করে সুসংবদ্ধভাবে মামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

২০০৮ সালের ওই সময়ে আমরা কয়েকজন আইনজীবী আমাদের সিনিয়র নেতৃস্থানীয় আইনজীবীদের সিদ্ধান্তে, তাঁদের নমিনেশনের মাধ্যমে ঢাকা বার ইলেকশনে অংশ নেই। দেশে তখন জরুরি অবস্থা বিরাজমান। সেই অবস্থাতে ইলেকশন করা, ইলেকশনের প্রচার করা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। তবুও আমরা অবশেষে নমিনেশনপ্রাপ্ত হয়ে সব আইনজীবী একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা সংসদ ভবনের বিশেষ আদালতে উপস্থিত হয়ে আমাদের নেত্রীর (বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সাথে দেখা করে আমাদের জন্য তাঁর দোয়া চেয়ে আমাদের বিজয়ের বিষয়ে তাঁকে আশ্বস্ত ও নিশ্চয়তা দিব। কিন্তু বাস্তবে বিশেষ আদালতে উপস্থিত কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় আপার সাথে দেখা বা কথা বলার অনুমতি পাওয়া অসম্ভব ছিল। কিন্তু সেই অবস্থাতেই আমরা ব্যারিস্টার জনাব শেখ ফজলে নূর তাপসের সহায়তায় সবার পক্ষ হয়ে আমি অনুমতি পেয়েছিলাম কাছে যেয়ে সবার জন্য দোয়া চেয়ে কথা বলার। আমি দোয়া চেয়েছিলাম। নেত্রী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সবার জন্য দোয়া করেছিলেন। তখন থেকেই দেখেছি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সাংগঠনিক দক্ষতা আসাধারণ।

এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিনগুলোতে তাঁর নেতৃত্বে আমরা সাধারণ আইনজীবীরা হাইকোর্টের আপীল বিভাগে উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে একাত্ম হয়েছি। প্রতিদিন আমরা তাঁর নেতৃত্বে আপিল বিভাগে একত্র হয়ে মামলার রায় শুনেছি। তার নেতৃত্বে আমরা সাধারণ আইনজীবীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য গণভবনে একাধিকবার একত্র হয়েছি। তখনও দেখেছি তাঁর অসাধারণ অনুষ্ঠান সঞ্চালন দক্ষতা।

তাঁর অভূতপূর্ব কৃতিত্ব হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং হস্তক্ষেপে কোন্দলরত/ দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নামে সুপ্রতিষ্ঠিত দুটি সংগঠনকে একত্র করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠন এবং এর দায়িত্বভার গ্রহণ করা। আওয়ামী চিন্তাধারার আইনজীবীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই সংগঠনের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর ঢাকা বার ও সুপ্রীম কোর্ট বার ইলেকশনে বিজয়ের জন্য তাঁকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখি। সব আইনজীবীর দরজায় গিয়ে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর জন্য নিজে ভোট চেয়েছেন। দলীয় কিছু সদস্যের শঠতার জন্য হয়তো আমরা আশানুরূপ বিজয় এখনও অর্জন করতে পারছি না তবুও সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম বা প্রবল ইচ্ছাশক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং অনুকরণীয়।

একজন সাংসদ হিসাবে জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সম্পূর্ণ সফল। একজন আইনজীবী হিসাবেও তিনি পুরোদস্তুর সফল। একজন সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর শুনানি তিনি করে থাকেন তাঁর জ্ঞানগর্ভ তথ্যের সাবলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে।

১৯৮০ সাল থেকে আমরা ঢাকা-১০ আসনের আর ১৯৮৭ সাল থেকে ধানমণ্ডির বাসিন্দা। অনেক জাতীয় ইলেকশন আমরা নিজ চোখে দেখেছি, কিন্তু ২০০৮ সালের সময় থেকে জনাব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে ঘিরে সব শ্রেণির মানুষের ইলেকশনের প্রতি যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর গণজোয়ার দেখি, তা এর আগে অন্য কারো সময় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা সব সময় গগনচুম্বী। নিঃসন্দেহে তাঁর মধ্যে সাধারণ মানুষ বা জনগণকে আকর্ষণের এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে, যার ফলে ঢাকা-১০ আসনের তিনবারের অত্যন্ত সফল আর জনপ্রিয় সাংসদ তিনি।

যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার তাঁর ওপর অর্পিত হলেও হয়তো তিনি সুষ্ঠুভাবে তা পালন করতে পারতেন! কেন তিনি তাঁর নিজের কক্ষচ্যুত হয়ে অন্য পথে গিয়ে নগরপিতার দায়িত্ব পাওয়ার মাধ্যমে জনগণের সেবক হতে মাঠে নেমেছেন সেটি তাঁর এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত এবং সুবিবেচ্য বিষয়, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তার বিষয় হলো অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি সাধারণ আইনজীবীদের তাঁর সান্নিধ্যবঞ্চিত করেন কি না! তাঁর একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী অনেক নিঃশব্দ নিভৃতচারী, নিরীহ আইনজীবী তাঁর সুবিবেচনামূলক সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হবেন কি না! অনেক আইনজীবী তাঁদের নিশ্চিত মানবিক আশ্রয়টুকু হারিয়ে ফেলবেন কি না।

তবুও সবকিছু, সব আশঙ্কার বাইরে এসে তাঁর জন্য নিরন্তর আন্তরিক শুভকামনা- তিনি ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন এবং বিজয়ীর বেশে আইনজীবীদের মাঝে আগের মতো ফিরে আসুন।

লেখক: সরকারি আইন কর্মকর্তা, সুপ্রিম কোর্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :