বাফুফেতে দরকার সাবের চৌধুরীর মতো যোগ্য সংগঠকের

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৬ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ১১:২৩

মামুন জোয়াদ্দার

ফুটবল আমার রক্তে মাংশের সঙ্গে আজও মিশে আছে। কানাডায় শত ব্যস্ততার মাঝেও সর্বদা দেশের ফুটবলের খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করি এবং রাখি। দেশে গেলে মাঠে গিয়ে ‍খেলা দেখতে ভুল করি না। প্রায় দুই বছর পর এক মাসের জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে গিয়েছিলাম। এবারও মাঠে বসে কয়েকটি ম্যাচ দেখলাম। কিন্তু কি দেখলাম! এ কোন ফুটবল? দারুণ হতাশা নিয়ে কানাডায় ফিরতে হয়েছে।

গত  ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের ফুটবল কেবলই পেছনের দিকে গিয়েছে, সেটা আমার জানা। কিন্তু তাই বলে এতটা? মাঠে বসে যে খেলা দেখলাম, সেটা যেন জীবন্ত কোনো ফুটবল নয়, মৃত ফুটবল। হ্যাঁ, বাংলাদেশের ফুটবলের মৃত্যু হয়ে গেছে। সাবেক ফুটবলার হিসেবে আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে। দেশে একটা মাস অনেক আনন্দে কেটেছে, ওই ১৮০ মিনিট ছাড়া। খেলার কোনো মান নেই, খেলোয়াড়দের কমিটমেন্ট নেই, মাঠে দর্শক নেই, ফুটবল কর্মকর্তাদের মধ্যে উন্নত ভাবনা নেই, সঠিক পরিকল্পনা নেই। সব মিলে বাংলাদেশ ফুটবলের কফিনে অসংখ্য পেরেক সেঁটে আছে। এই পেরেক তুলে কফিনকে জীবন্ত করবে কে? আমি কিন্তু চরম হতাশ।

বিদেশের বেশ কয়েকটি দুর্বল দল নিয়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ আয়োজন করেছিল ফুটবল ফেডারেশন। অথচ সেখানে ছিল বাংলাদেশ ছিল পূর্ণ শক্তির দল। কিন্তু এই দল নিয়েও বাংলাদেশ কোনো কিছু দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশ ফুটবল যে আসলে শেষ হয়ে গেছে তা গত দুটি টুর্নামেন্ট- সাফ গেমস ফুটবল ও বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

বাংলাদেশ ফুটবল যে রকম ধ্বংস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে, তাতে আমি সহসা আশার আলো দেখতে পারছি না। বরং আমি খুবই শঙ্কিত। ঢাকার ক্লাবগুলোকে কিন্তু  আমি বাহাবা দিতে চাই। এমন মৃত ফুটবলের পেছনে তারা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো দিক। কিন্তু কতদিন তারা এটা করবে সেটা নিয়েই আমার চিন্তা।

আমি ঢাকার ক্লাবগুলোকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। খেলোয়াড়দের তারা অনেক কিছুই দিচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো খেলোয়াড়রা প্রতিদানে কি দিচ্ছে? কি দিচ্ছে তাদের নিজ নিজ ক্লাবকে? কি দিচ্ছে দেশের ফুটবলকে? খেলোয়াড়দের মধ্যে আমি এতটুকু কমিটমেন্ট দেখিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের ফুটবল খেলার উদ্দেশ্য একটাই এবং সেটা হলো অর্থ। আমাদের সময় আমরা খেলতাম দেশের জন্য, দলের জন্য। খেলতাম জীবন দিয়ে। এখনকার খেলোয়াড়দের মধ্যে সেই আত্মত্যাগী মনোভাব, সেই দেশপ্রেম, সেই কমিটমেন্টের বড্ড অভাব দেখেছি।

দোষ শুধু ফুটবলারদের নয়। যারা ফুটবল প্রশাসনে আছেন সবচেয়ে বড় দায় তাদের। ফুটবল নিয়ে বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা তারা গ্রহণ করেছেন কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। ফুটবল একাডেমি নিয়ে বহু বছর ধরে কথা শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো কিছু দেখতে পারছি না। অনেক টুর্নামেন্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু তৃণমূল থেকে প্রতিভা বাছাই করে তাদের সঠিক ভাবে ট্রেইন আপ করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না আমার।

অনেকেই কাজী সালাউদ্দিনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। ফুটবলের এ দুর্দশার জন্য তিনিই নাকি দায়ী। আমি অবশ্য তাকে একাকে দায়ী করছি না। তিনি গ্রেট ফুটবলার ছিলেন। ফুটবলের আইকন। আমাদের বড় ভাই। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধার কমতি নেই। কিন্তু ফুটবল প্রশাসক হিসেবে তার প্রজ্ঞা নিয়ে আমার প্রশ্ন ক আছে। গত ১২টা বছরে ফুটবলের জন্য তিনি কি করলেন?

তারপরেও আমার সমালোচনার তীর শুধু তার একার দিকে নয়। আমার যেটা মনে হয় সেটা হলো- তিনি ভালো একটা টিম পাননি। তিনি যাকে বা যাদের দায়িত্ব দিচ্ছেন তারা সঠিকভাবে তা পালন করতে পারছেন না বা করছেন না।

যেমন জাতীয় দলের ম্যানেজারের পদটার কথাই ধরা যাক। একজন ব্যক্তি টানা ওই পদে রয়েছেন। অথচ ম্যানেজার হিসেবে তার কোনো সাফল্য নেই। বরং আছে অসংখ্য প্রশ্ন। বিতর্ক। তিনি নাকি কোচের কাজে খবরদারি করেন। নিজ ক্লাবের খেলোয়াড়দের নিয়ে জাতীয় দল গড়ার মতো ক্রমাগত ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নেন। ইত্যাদি অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে শুনেছি। আমার প্রশ্ন হলো-এতকিছুর পরেও কেন তাকে টানা ম্যানেজারের দায়িত্ব রাখা হচ্ছে? ফুটবল ম্যানেজমেন্ট বুঝেন আর কি যোগ্য লোক বাংলাদেশে নেই? দেশের ফুটবলে অব্যবস্থাপনা আরও অনেক অভিযোগই এবার শুনে এসেছি আমি।

সামনে ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন। এবারও প্রেসিডেন্ট পদে কাজী সালাউদ্দিন লড়বেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাকে হঠানোর জন্য বিরুদ্ধবাদীরা অনেক আগে থেকেই গলা ফাটাচ্ছেন। এপ্রিলের ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের ফুটবল বেশ সরগরম দেখে এসেছি। সালাউদ্দিনকে নিয়ে যেমন অনেকে অনেক নেতিবাচক কথা বলছেন। তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তরফদার রুহুল আমিনকে নিয়েও অনেকে অনেক কথা বলছেন।  

সালাউদ্দিন গত ১২ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট। অনেক ব্যর্থতার মাঝে তার কিছু অর্জন আছে বটে। যেমন মহিলা ফুটবল তার সময়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহিলা ফুটবল নয়, পুরুষ ফুটবলই মেইন ইভেন্ট। পুরুষ ফুটবলকে ধ্বংস্তুপের মধ্যে রেখে মহিলা ফুটবলে যতই উন্নতি হোক, সেটা চোখে পড়বে না। সালাউদ্দিনকে এই বিষয়টা ভাবতে হবে।

আমার মনে হয় দেশের ফুটবল প্রশাসনে একটা বড় পরিবর্তন দরকার। তরফদার  বা সালাউদ্দিন- কাউকে দিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল বাঁচবে বলে মনে হয় না আমার। দরকার সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো যোগ্য ও দক্ষ সংগঠকের। আমি মনে করি, ফুটবল বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। একমাত্র তিনিই পারেন বাফুফেতে যোগ্য কাউকে এনে দেশের ফুটবলকে বাঁচাতে।

মামুন জোয়াদ্দার: কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশের সাবেক তারকা ফুটবলার।