ঝালকাঠিতে ‘তদবির বাণিজ্যে’ কোটিপতি শিক্ষক

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ২২:৫৩ | আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:২৬

এস এম রেজাউল করিম, ঝালকাঠি:

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় মাত্র সাত বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এক শিক্ষক।  অবৈধ পন্থায় আয় করা টাকায় তিনি বরিশালের রুপাতলী এবং নলছিটি শহরে একাধিক ভবন নির্মাণ করেছেন। তিনি সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহতাব হোসেন টিটু। 

একটি গোয়েন্দা সংস্থার  প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর টিটুর দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বরিশাল দুর্নীতি দমন কমিশনেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। মাহতাব হোসেন টিটু নলছিটি উপজেলা ছাত্রলীগের সাইফুল-টিটু কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকায় সাধারণ শিক্ষকরা তার রিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। 

অভিযোগে জানা যায়, নলছিটি উপজেলার দেলদুয়ার গ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহতাব হোসেন টিটু ২০১২ সালের আগস্ট মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এর পরেই টিটু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নলছিটি উপজেলায় একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। 

ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ছাত্রনেতা টিটুর মাধ্যম ছাড়া শিক্ষকদের বদলি, ছুটি, ইনক্রিমেন্ট কিছুই হতে পারে না। শিক্ষা অফিস থেকে যেকোন ধরনের বরাদ্দের অর্থ ছাড় করাতে টিটুকে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়। আর এসব টাকা থেকে একটি অংশ চলে যায় নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেক নজরে থাকার কারণে টিটু বছরের বেশীরভাগ সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসের কাজ তদারকি করেন। 

জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নেক নজর থাকায় টিটু বিনা ছুটিতে ২০১৬ সালে ভারত এবং ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে কাগজে কলমে তিনি পিটিআই প্রশিক্ষণে থাকলেও তাকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় ঝালকাঠি টিইও অথবা ডিপিইও অফিসে। আবার কোনো দিন নলছিটি টিইও অফিসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। মাহতাব হোসেন টিটুর নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ও  প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে একাধিক। 

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে  অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অর্থ, রাজস্ব) নুরুল ইসলাম গত ১১ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি আসেন। তিনি নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সরেজমিন তদন্তের পর প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম অজ্ঞাত কারণে কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেননি। 

গত ২৭ জানুয়ারি নুরুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, আমার তদন্ত প্রতিবেদন প্রায় শেষ পর্যায়। মাহতাব হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সে বিষয়ে কিছু ভিডিও ফুটেজের সিডি ছিল অভিযোগের সঙ্গে। ওই ভিডিও ফুটেজ এখন আমার হাতে আসেনি। ওটা হাতে আসলেই আমি দেখে রিপোর্ট দিয়ে দেব।

টিটুর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:  
সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহতাব হোসেন টিটু আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ সিন্ডিকেট দিয়ে নলছিটি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের যাবতীয় বদলি, ছুটি, টেন্ডার প্রক্রিয়া, ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। টিটুর নেতৃত্বে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রী কেনার বরাদ্দ থেকে প্রতি বিদ্যালয় থেকে পাঁচশ’ টাকা হারে সর্বমোট ৯০ হাজার টাকা আদায় করেন। ২০১৭ সালে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত ৬২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ছয় থেকে দশ হাজার টাকা করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে শিক্ষকদের চাহিদামত বিদ্যালয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ওই সময়ের ডিপিইও ছায়াদুজ্জামানের সহযোগিতায়। 

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে নলছিটি উপজেলার ২৬টি পুরাতন বিদ্যালয়ের ভবন নিলামে বিক্রির আয়োজন করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। টিটু তার  সহযোগীদের নিয়ে তিন লাখ টাকায় ২৬টি পুরাতন ভবন কিনে ভবনগুলো ৫২ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। এই টাকার সিংহভাগ নিজে নিয়ে কিছু টাকা তার সহযোগীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেন টিটু।  নতুন শিক্ষক যোগদানের সময় জনপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে হয় মাহতাব হোসেন টিটুকে। নলছিটি উপজেলার ১৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট জনপ্রতি পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা, রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন শিক্ষকপ্রতি পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা, যেকোন ধরনের বদলি পাঁচ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা, মৌখিক ডেপুটেশন জনপ্রতি ২০ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আদায় করে থাকেন। 

এছাড়াও বিভিন্ন অনুদান বরাদ্দে বিদ্যালয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে স্কুল প্রতি দশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা, স্লিপ রুটিন মেইনটেনেস থেকে স্কুল প্রতি দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার, ওয়াস ব্লক এক হাজার টাকা করে আদায় করেন। এ ছাড়া কোনো শিক্ষক পেনশনে গেলে পেনশন প্রতি বিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। গত বছরের জুন মাসে নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসের ফ্লোরে ৯৫ হাজার টাকার টাইলস লাগিয়ে তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল উঠিয়ে নেন। 

সরকারি চাকরি করেও মাহতাব হোসেন টিটু বেনামে ঠিকাদারী কাজ করেন যাচ্ছেন। বর্তমানে নলছিটি থানার সামনে বড় গেট নির্মাণ করছেন টিটু। তার অবৈধ আয়ের নির্দিষ্ট কমিশন চলে যায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। যার কারণে টিটুর সব অবৈধ কাজে সহযোগিতা করেন ডিপিইও এবং টিইও। বিনা ছুটিতে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চাকরির সাত বছরে টিটু অবৈধভাবে আয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। আর এ অবৈধ টাকায় তিনি বরিশালের রুপাতলীতে সাত শতাংশ জমির উপর তৈরি করেছেন পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি যার তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  নলছিটি শহরে তৈরি করেছেন পাঁচতলা ফাউন্ডশেন দোতলা বাড়ি। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে মাহতাব হোসেন টিটু বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। সহকর্মীদের বিপদে আপদে সহযোগিতার জন্য মাঝে মধ্যে অফিসে যেতে হয়। আমি চাকরির আগে ঠিকাদারী করতাম। ঠিকাদারীর আয় থেকে আমি বরিশালের রুপাতলী ও নলছিটিতে বাড়ি করেছি। আমার বিরুদ্ধে দুদকে কোনো অভিযোগ রয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। 

ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। তবে শুনেছি মাহতাব হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে ঢাকা মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে একজন সহকারী পরিচালক এসেছিলেন। যেহেতু ঢাকার বড় কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন তাই এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। 

(ঢাকাটাইমস/২৮জানুয়ারি/কেএম)