প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সমস্যা ও সমাধান

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:৫৬ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:১৭

মো. আরিফুল ইসলাম সরদার
মো. আরিফুল ইসলাম সরদার

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত ব্যক্তি এবং জাতি সবসময় উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে অবস্থান করে| সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হলো শিক্ষা। সেই শিক্ষার ভিত রচনা হয় প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে। একটি জাতি কীভাবে তৈরি হবে তা নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। সেই প্রাথমিক শিক্ষা নড়বড়ে হলে শিক্ষার্থীরা হোঁচট খেয়ে পড়ে, সামনে এগোতে পারে না। তাই শিক্ষা অর্জনের মৌলিক ভিত্তি তৈরির স্থান হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়| একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায় নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তার প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার ওপর তথা প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে। তাই প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে আমাদের কী করা উচিত, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কতিপয় প্রতিবন্ধকতা এবং তা উত্তরণে আমাদের করণীয় যেমন হওয়া উচিত বলে আমার ধারণা তা নিয়ে আমার আজকের লেখা।

শিক্ষা সবার মৌলিক চাহিদা। আর এই মৌলিক শিক্ষা অর্জনের মৌলিক ভিত্তি তৈরির স্থান হলো প্রাথমিক শিক্ষা। যা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকেই হাতেখড়ি হয়ে থাকে। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত।  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের এই ভঙ্গুর দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাইতো শিক্ষার শিকড়ে হাত দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন যা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা হাঁটিহাঁটি পা পা করে বর্তমান অগ্রগতির অবস্থানে রয়েছি। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে একই সঙ্গে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুব কম। মেয়েদের হার ছিল আরও কম। বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে যেমন শতভাগ উপস্থিতি, অভিভাবকদের সচেতনতা, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা, সময়মত বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্য বিবাহ রোধ, পোশাকের জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার এত গুরুত্ব প্রদান করার পরেও নিম্নোক্ত সমস্যাসমূহ এখনো বিদ্যমান রয়েছে বলে আমি মনে করি।

উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে দক্ষ শিক্ষকের অভাব প্রকট। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ শিক্ষার মান উন্নয়নকে চরমভাবে ব্যাহত করে। হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।

শিক্ষা খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি খাত। দুর্নীতি এই খাতের উন্নতির বড় অন্তরায়। অবকাঠামোগত সমস্যা শিক্ষার পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় প্রকার উন্নয়নকে ব্যাহত করে। শিক্ষার উন্নয়নে দরকার সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন পরিকল্পনা। বাংলাদেশে এর যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়।

প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র সমাপনী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস এবং এ প্লাস প্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়লেও মান বাড়ছে না। সার্বিক বিচারে শিক্ষা সময়ের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

অভিভাবকদের  ব্যাপক অসচেতনতা রয়েছে। অনেকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরিব মানুষের সন্তানদের চাকরি পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মতো কল্পনাশক্তিও তাদের নেই। একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য যে জনবল প্রয়োজন সেই তুলনায় সংখ্যাটা অপ্রতুল।

শিশুদের নৈতিকতা শিক্ষা না দেয়া। শিক্ষকের অপ্রতুলতা /অপর্যাপ্ততা। আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষে সুস্থ মেধা বিকাশ উপযোগী যে ধরনের শ্রেণি কক্ষ দরকার তা অনেক বিদ্যালয়েই অনুপস্থিত। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ে বসার বেঞ্চ নেই, খেলার সামগ্রী নেই।  বাংলাদেশে এখনো অনেক পরিবার দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। ফলে তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ের চেয়ে জীবন জীবিকার কাজে নিয়োজিত করতেই বেশি পছন্দ করে।

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে যে বিষয়ে  যে যে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি:

-শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে।

- শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশোনা না করিয়ে আদর্শভিত্তিক নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।
-চার বছর বয়সে স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক করে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ছয় বছর প্লাস হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান শুরু করতে হবে।
- শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো করে তাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।
-ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে।
-শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন করতে হবে।
-প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসে অন্তত একদিন একজন সফল ব্যক্তিত্বকে দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য স্বপ্ন  দেখাতে হবে এবং জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।

- সর্বোপরি সুস্থ মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে।

- শুধু মুখস্থবিদ্যার দিকে মনোনিবেশ করার জন্য কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ না করা।

-পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলাধুলা ও বিদ্যালয়ে শিশুদের মনের মতো বিনোদনের ব্যবস্থা করা।

-মাতৃপিতৃ মমতায় শিশুদের লালন করা।

-বিদ্যালয়কে পরিপাটি ও পারিবারিক বাসস্থানের মতো শিশুবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা।

- পাঠ্যপুস্তকের পাঠাপাশি নিয়ানুবর্তিতা শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা।

-শিক্ষক হিসেবে নিজেকে যোগ্যতম হিসেবে গড়ে তুলে শিক্ষা দান করা।

-শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন করার লক্ষ্যে নিয়মিত পিটিএ সভার আয়োজন করা।

-মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা।

-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা

-মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেমযুক্ত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা  প্রয়োজন।

পরিশেষে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং জাতির পিতার যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে বলে আমি আশা রাখি। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি হিসেবে  সবাই একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করব-এই প্রত্যাশা রইল সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নোয়াখালী সদর, নোয়াখালী