প্রকৃত সুন্দর তো শিশুরাই

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:২৩ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৩৬

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ,ঢাকাটাইমস

বুধবার বইমেলার দুয়ার বন্ধ হওয়ার পর বেরিয়ে এলাম। অগ্রজ লেখকদের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে আলাপ চলছিল তখনো। একে একে সবাই বিদায় নিলে আমিও হাঁটতে থাকলাম টিএসসির দিকে। ফুটপাত ধরে। একা। বইমেলায় এসেছিলেন এমন অনেকেই বাড়ি ফিরছেন। কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে মেলার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছেন। ভালোমন্দ দুটোই। এখনকার সময়ের তরুণ লেখকদের নিয়েও কথা হচ্ছে। কে কী ভাবছে এখনকার লেখকদের নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে পাঠকদের ভাবনা কী, বিচ্ছিন্ন মন্তব্যে অনেক কিছু আঁচ করা যায়। তাই ধীরে চলছি।
টিএসসির কাছাকাছি হলে মনে হলো, পেটে কিছু চালান করা দরকার। শরীরে কেমন দুর্বল লাগছে। উঠলাম সড়ক দ্বীপে ডাস ক্যাফেটেরিয়ার সামনে। ওখানে নিয়ম হচ্ছে, খাবার আগে দাম পরিশোধ করতে হবে। তারপর টোকেন দেখিয়ে খাবার নেওয়া। তা-ই করলাম।
খাবার শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা। হাটছি পথ ধরে। একটু এগোতেই ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্য লোগোয়া উদ্যানের মুখে একটি শিশুর কান্না নজর কাড়লো। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শিশুটির বয়স দু-আড়াই বছর হবে হয়তো। লিকলিকে শরীর। গায়ে হুডি জ্যাকেট। মাথা ঢাকা। জ্যাকেটার গায়ে এক চাবলা ময়লা-ধুলো। মায়লায় কুটকুটে কালো হয়ে আছে পাজামাটা। পায়ের জুতোটাও ধুলোয় মলিন। ছেলেটির গাল বেয়ে জল নামছে। চোখ ডলছে হাতের পিঠে।
কাছে গিয়ে বললাম, কাঁদছো কেনো তুমি?
সে খানিকের জন্য কান্না থামিয়ে মুখ তুলে তাকালো। কিছু বললো না। সামনে পথের দিকে আঙুল ইশারা করলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম, সদ্য কৈশোর পেরোনো এক মেয়ে পথ পার হচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো ফুসকা বিক্রেতা বললেন, ‘ওর মা। মার জন্য কান্দে।’
‘ওকে এখানে রেখে গেলো?’
‘এইখানেই থাকে। হারাইবো না।’ ফুসকা বিক্রেতা বললেন, ‘ওর মায় দোকানে দোকানে টাকা তোলে। ও মনা, ফুসকা খাবি?’
শিশুটি তখনো কাঁদছে। কাঁপছেও। সে মাথাটা ডানেবায়ে নাড়ালো। ফুসকা খাবে না।
গোলাপি একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ‘নাও, এটা তোমার জন্য।’
শিশুটি আমার দিকে তাকালো। কিন্তু হাওয়াই মিঠাইটি নিলো না। মাথা নাড়লো। নেবে না। খানিক অবাক হলাম। প্রায়ই পথে শিশুদের দেখলে কিছু কিনে দেওয়ার চেষ্টা করি। কখনো চকলেট, চিপস, বিস্কুট-যখন যেটা হাতের কাছে পাই। সবাই নেয়। এমন অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম।
ওর দিকে তাকাতে বারবারই আমার ছেলেটির কথা মনে পড়ছিল। গত ১৬ ডিসেম্বর এক বছর পূর্ণ করেছে। শিশুদের চেহারায় কেমন অভিন্ন একটা ব্যাপার থাকে। প্রায়ই আমি তা খেয়াল করি। নিষ্পাপ ফুলের মতো দেখতে। স্নিগ্ধ এক মায়া খেলা করে ওদের চোখেমুখে। আমি তাকিয়ে থাকি। চোখ ফেরাতে পারি না। রাতে বাসায় ফিরেই ছেলের কাছে ছুটে যাই। প্রায় সময়ই ছেলে আমার ঘুমিয়ে থাকে। আমি তাকিয়ে থাকি স্বর্গের ফুলের দিকে। নাম অজানা এক ফুল। কখনো মনে হয়, একটা পাখি। কী মিষ্টি তার চোখ! শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা ঠোঁট। তুলোর মতো গাল। কাশফুলের মতো শুভ্রতার মায়ানদীতে আমি তলিয়ে যাই। শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কখন যে সময় পেরিয়ে যায়, বুঝে উঠতে পারি না। পাশ থেকে যখন কেউ একজন তাড়া দিয়ে বলে, ‘বাইরে থেকে এসেছো, ফ্রেশ হয়ে নাও আগে।’
ঘুমোতে গেলেও আমার এমনটা হয়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে পাশে শুয়ে থাকা আমার আত্মজের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা সময় তার মায়া আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি চুমু খাই তার কপালে।

পথের ধারে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য কাঁদতে থাকা এই শিশুটির মাঝে আমি যেন আমার সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছে, আমার ছেলেটিই দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কী ফুটফুটে সুন্দর দেখতে!
‘মায়ের জন্য কাঁদছো? আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম। ‘কেঁদো না, মা ঠিক চলে আসবে। নাও এটা তোমার জন্য।’
না, ছেলেটি এবারও নিলো না। মাথা নেড়ে না করলো। আমার পাশে দাঁড়ানো এক তরুণীও তাকে একটা চকলেট দিতে চাইলেন। ছেলেটি সেটিও নিলো না। সে কেবল মানুষের ভিড় গলে পথের ওপাশে চোখ মেলে দিচ্ছে। চোখে চোখে রাখছে মাকে। ছোটখাটো গড়নের মেয়েটি তখনো ব্যস্ত আপন কাজে। কী অদ্ভুত সম্বোহন! মা যেদিকেই যাচ্ছে ছেলেটি সেদিকেই তাকাচ্ছে। একটুও আড়াল হতে দিচ্ছে না। তার চোখ ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে। অথচ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজেই হারিয়ে ফেলছিলাম তাকে।
আশেপাশে জড়ো হয়েছিল কিছু পথশিশু। তাদের বললাম, ‘তোমরা ওকে চেনো?’ পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে বলল, ‘হ, হেয় হের মায়ের লগে এইহানেই থাকে।’
‘এখানে কোথায় থাকে? বাসায় যায় না? বাসা নেই ওদের?’
‘আছে। দূরে তো, তাই রাইতে এইখানেই থাকে।’
আচমকাই ছেলেটির চেহারা থেকে মেঘ কেটে যেতে থাকলো। খুশি খুশি ভাব ফুঁটে উঠলো চোখেমুখে। যেন বর্ষার আকাশে বিজলির চমক। আমি তার দৃষ্টির অদৃশ্য রেখা ধরে পথের ওপারে তাকালাম। দেখলাম, তার মা পথের ওপারে দাঁড়িয়ে। পারাপারের অপেক্ষায়। মা ফিরে আসছে, দেখে মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উবে গেল সব কান্না। এবার ছেলেটির হাতে হাওয়াই মিঠাইটি দিয়ে বললাম, ‘ওই তো মা আসছে। নাও, এবার এটা নাও।’
সে অমত করলো না। আমি দেখলাম, আমার চোখ কেমল ঝাপসা হয়ে আসছে। কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে চারপাশ। কিন্তু কুয়াশার অতটা দাপট তো নেই! শীত কমে আসছে। ভাবলাম, মেলায় ঘুরে বেড়ানোর সময় উড়ে এসে ধুলো পড়েছে চশমার কাঁচে। রুমালে মুছে নিলাম। তবুও ঝাপসা ভাবটা কাটলো না।
ছেলেটি তার মায়ের কোলে হাসছে। রাত প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই। বাসায় ফিরতে হবে। আমি ফুটপাত ধরে শাহবাগের দিকে হাঁটতে থাকলাম। মুঠোফোনটি পকেট থেকে বের করে ফোন করলাম আমার সন্তানের মায়ের কাছে।
‘হ্যালো, কোথায় আছো এখন?’
আমি শুনছিলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না। গলাটা হঠাৎ কেমন জমে পাথর হয়ে গেলো।
‘হ্যালো, কী ব্যাপার কথা শুনছো না? কোথায় আছো? এখনো বাসায় আসছো না কেনো? হ্যালো’।
আমার পাথরগলা কিছুটা নরম করার ভঙ্গিতে বললাম, ‘সৃষ্টিকর্তা কেনো শিশুদের কষ্ট দেন বলতে পারো? ওদের তো কোনো দোষ নেই।’
ওপাশ থেকে তানিয়া বলল, ‘কীসের কষ্ট? কী বলছো তুমি? তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেনো?’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। ফোনটা তখনো কানে ধরা আছে। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে, ‘কে কষ্ট পেলো? কথা বলছো না কেনো?’
ফোনটা রেখে দিলাম। মনের মধ্যে তখনো কেউ একজন ঘুরে ফিরে বলে বেড়াচ্ছে, ‘সব শিশুর জন্য পৃথিবীটা কেনো সুন্দর হয় না? প্রকৃত সুন্দর তো শিশুরাই। কেনো তুলোর মতো মনে এত কষ্ট দেন সৃষ্টিকর্তা? তিনি তো চাইলে সব শিশুর জন্যই সুন্দর একটা শৈশব দিতে পারেন! পারেন না?’