বইমেলা জার্নাল-০৩

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:৫২

‘মা এই বইটা নিই?’

ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। বইমেলার দিকে। টিএসসির ওপাশে, রাজু ভাস্কর্যের সামনের পথ। দেশি-বিদেশি হরেক বইয়ের পসরা সাজানো। নীলক্ষেত-বাংলাবাজার প্রিন্ট। কথাটি শুনে তাকালাম। দেখলাম, বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। হাতে তার বই। শার্লক হোমসের। অনুবাদ বই। ফিনফিনে সাদা কাগজে ছাপা। পাশে দাঁড়িয়ে তার মা। বেশভূষায় বোঝা যাচ্ছে, জীবন ঘষে আগুন জ্বালানো মধ্যবিত্ত। মায়ের হাতে একটা ব্যাগ। খেয়াল করলাম, তাতেও সম্ভবত বই।

ছেলের আরজির জবাবে বললেন, ‘আজ আর না বাবু। পরেরবার নিও। মেলা থেকে তিনটে তো কিনলেই।’

ছেলেটি নাছোড়। ‘এই একটাই তো। নিই মা?’

মা এবার খানিক গলা শক্ত করলেন। ‘বললাম না পরে নিও।’

ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে হাত ধরে টেনে নিতে চাইছেন। কাজ হচ্ছে না। একচুলও নড়ছে না।

শুক্রবার মেলা খুলেছিল ১১টায়। সকালে শিশু প্রহর। ছুটির দিন লোকে লোকে একাকার। বেলা গড়াচ্ছে পশ্চিমে। তখনো অনেকে ঢুকছেন। কেউ ঘুরেফিরে বেরিয়ে আসছেন। মেট্রোরেলের কাজের কারণে পথ এমনিতেই সরু হয়ে এসেছে। ফুটপাত ছাড়া গতি নেই। মা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বারবার মানুষকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে হচ্ছে। যাওয়ার জন্য। ওদিকে ছেলে গোঁ ধরে আছে। সে বই না নিয়ে সরবে না।

নিরুপায় মা, চাপা গলায় ছেলেকে বললেন, ‘এই বই যদি নাও, গাড়ি ভাড়া হবে না। বাসায় হেঁটে যেতে হবে। পারবে?’

ছেলেটি মাথা না তুলেই ডানে কাত করলো। পারবে সে। তবু তার বইটি চা-ই।

ফুটপাতের সব বই হাঁকা হচ্ছে অভিন্ন দামে। একশ টাকা। দাম মিটিয়ে ছেলের হাত ধরে মা চললেন বাসার পথে। ছেলেটির শুভ্র মুখের মেঘ কেটে গেছে। বিমলানন্দে মায়ের সাথে যাচ্ছে। শেষ বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় মায়ের মুখটিও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সন্তানের খুশিতেই তার সুখ। শূন্য থাকুক হাত। তাতে কী? আজ না হয় তারা পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। ছেলের মুখের হাসির বিকল্প তো কিছু হতে পারে না! দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, খানিক পথ গিয়ে মায়ের হাত থেকে বইয়ের ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো ছেলেটি। একব্যাগ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন নেই।

একটা সময় মেলার বাইরে বইয়ের পসরা চোখে পড়তো। ফুটপাতে। এখন নেই। মেলা আগের চেয়ে এখন অনেক গোছানো। ফুটপাতে বইয়ের পসরার অনুমতি নেই। যারাই বসছে, নিয়ম ভেঙে। পুলিশ এলে পাততাড়ি গুটিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন যেন তখন মনে হলো, নিয়ম ভাঙার এই খেলা না গড়ালে মনে রাখার মতো মুহূর্তটি দেখা হতো না।

২০১৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে মেলা। পথ পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে বসেছে। বছর বছর আয়তন বাড়ছে। এবার গ্লাস টাওয়ার (স্বাধীনতা স্তম্ভ) আর সামনের সরোবরও মেলার অংশ। সরোবরের স্বচ্ছজলে চঞ্চল মাছ। খাবি খাচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে। পাথুরে শ্যাওলার আড়ালে লুকোচ্ছে। দারুণ খেলায় মেতে থাকে ওরা। যেন মেলায় আসা ছোটো ছোটো শিশুদের মতো তারাও খুশি। পাশেই ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ। সূর্য মাথার ওপর থেকে সরে গেলে সেখানে ভিড় করেন সাহিত্যপিপাসুরা। সাহিত্য-সন্ধ্যা। লেখকরা কথা বলছেন। বিমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে আছেন দর্শকরা। তরুণ-তরুণীরা কেউ কেউ রঙিন দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। বসার জায়গা হয়েছে অনেক। পথগুলো চওড়া। মেলা ঘুরে ক্লান্তি লাগছে না। লাগলেও একদণ্ড জিরোনোর ব্যবস্থা তো আছেই।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :