যাপনরম্য-১

ধূমপান বিষপান নয়!

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৪৯ | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১০

রুহুল আমিন শিপার

সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙালি খানিকটা সেবনমুখী। নানাবিধ সেবা আদান-প্রদানে আমরা অতিশয় পারঙ্গম। ম্যালা সিদ্ধহস্ত বলেই যুগে যুগে অনেক বিদেশি মেহমান হ্যান্ডেল করতে পেরেছি। তবে অতীতে তামাক সেবন এখনকার মতো এত সহজলভ্য ছিল না। হাত বাড়ালেই বিড়ি-সিগ্রেট, দেয়াশলাই অত সুলভ ছিল না। সে কারণে কি না জানি না, আমাদের ছেলেবেলায় হুঁকার বেশ কদর ছিল। এর অবশ্য কারণও আছে। প্রায় বিনে পয়সায় ‘ইহার' এন্তেজাম করা যেত।

নারিকেলের আস্ত খোল, যাকে সোজা বাংলায় মালই বলে, সেটাতে গোটা দুয়েক ফুটো আর একখানা নলের মাথায় বাহারি কল্কি। ব্যস হয়ে গেল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ক্ষেতের তামাক শুকিয়ে তাতে চিটাগুড় মিশালেই অমৃত। এবার ইচ্ছামতো টানতে থাকো। কুড়ুৎ কুড়ুৎ। খোলের মধ্যে পানি দিয়ে ‘জলজ' ফিল্টারিংয়ের সুরক্ষাও ছিল বটে। তবে নিকোটিন বরাবরই এসব ফিল্টারকে আঙুল দেখিয়েছে। অতীতে অনেককে দেখেছি সিগারেটের গোড়ায় এক্সট্রা ফিল্টার লাগাতে। আদতেই হাস্যকর। পাগলের সুখ মনে। তামাক যদি থাকে তবে নিকোটিন বক্ষভেদ করবেই। যাদের ফুসফুস নিজেই হুঁকা, তাদের কথা অবশ্য আলাদা।

নিচের ল্যাটিন শব্দযুগল বেশ শ্রুতিমধুর-Nicotiana tabacum. অনেক কষ্ট করে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এ নাম দিয়েছেন। আপাতনিরীহ এ নাম দেখে হঠাৎ বোঝার উপায় নেই এটা কেমন ধারা জিনিস। আসলে এটি Tobacco বা তামাকের আকিকা করা ভালো নাম। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের এ ফসল মহাজনকে ‘অর্থ' এবং সরকারকে ‘কর' দেয়। সে কারণেই বোধহয় এটাকে অর্থকরী ফসল বলা হয়। এই শিল্পের বড় কারবারিরা ইউরোপীয়। অবশ্য চীন-জাপানও কম যায় না। টাকার অঙ্কে বৈশ্বিক বাজারমূল্য মাশাল্লাহ। সুতরাং উৎপাদক, কারবারি আর সেবনকারী মিলে দারুণ ত্রিপক্ষীয় নেক্সাস। চমৎকার আন্তঃমহাদেশীয় মেলবন্ধন। কী সুন্দর কায়দা করে ধনী-গরিব সবারটা লুটে নিচ্ছে! অথচ পাবলিকের পকেট কাটার জন্য কেউ এদের তেমন অর্থবহ, জুতসই নাম দেয় না। বিষয়টা দুঃখের তো বটেই।

জাপান সাড়ে ১২ হাজার কোটি মুদ্রা ব্যয় অন্তে বাংলাদেশি এক তামাক কোম্পানির ‘পাণি' গ্রহণ করেছে! কেন? এত তাড়া কিসের? তাদের ভাষায় বঙ্গীয় অঞ্চলে সিগারেটের প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ। প্রায় ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি। দারুণ এক অর্থনৈতিক পরিভাষা এই ‘প্রবৃদ্ধি'। এর মানে কী? মোটা, স্থূল, বহুল, বাড়ন্ত ইত্যাদি। সব জায়গাতেই ‘ফ্যাটেনিং'। সবাই একটু বাড়তি চায়। হররোজ মুনাফা বাড়াও, বছরান্তে বেতন বাড়াও। কোরবানির গরু যেন একটু মোটাতাজা হয়। খালি বিয়ের পাত্রী স্লিম চাওয়া বাদে বাঙালির আর সবকিছুতেই বাড়বাড়ন্ত, চরম ‘মেদাকাঙ্ক্ষা'। অথচ আট শতাংশ বাড়তি ব্যবসা আমার দেশের আট শতাংশ পোটেনশিয়াল শ্রমশক্তির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে কি না সে বিষয়ে আমাদের ভাবনা কম। কারণ কী? কারণ আমরা অনেক তামাশা মেনে নিই। খেয়াল করে থাকবেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো প্রায়ই বর্ষা মওসুমে ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ করে। গরু মেরে জুতা দান আর কি। বাংলায় এরা দারুণ সমাদৃত। সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা। আসল বিষয় হলো সরকারি খাজাঞ্চিখানায় সাংবৎসর ‘মাত্র' হাজার পনেরো কোটি দেয়। এ কারণে এই ‘শলাকা' কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো।

যা খেলে নেশার মিনিমাম সম্ভাবনা আছে বাঙালি তা ছাড়তে মোটেও রাজি নয়। সবকিছুই চেখে দেখতে চায়। জুতা থেকে জামবাক, টিটি থেকে টিকটিকি কাউকে কোনো ছাড় দেই না আমরা। এ ব্যাপারে সাম্যেবাদে বিশ্বাসী। এই কারণে বিড়ি অথবা জর্দা শিল্প ইদানীং ‘আসল শিল্পের' কাছে বেদম মার খেয়েছে। সেই অসাধারণ শিল্পের নাম মাদক শিল্প। এখন মাদক শিল্পের ব্যাপক বিস্তার, দারুণ ইকোনমিক গ্রোথ। বিরামহীন কর্মকাণ্ড চলছে চারদিকে। এ রকম ‘উৎকৃষ্ট' শিল্প থাকতে আমরা গার্মেন্টস, চা, চামড়া শিল্পের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকি কেন!

আসলে শিল্প চেনার মতো জহুরির চোখ আমাদের নেই; দক্ষতারও নিদারুণ খামতি। বিনিয়োগের আসল ‘ক্ষেত্র' না চেনায় বাঙালি ব্যবসায় এতটা পিছিয়ে! উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয়ে সাপ্লাই চেইনের সব ফরমুলা মাদক ব্যবসায় সুনিপুণভাবে অনুসৃত হয়। জাতিকে নিঃশেষ করে দেয়া এই শিল্পের ‘পতিদের' কত বড় স্পর্ধা! এগুলোকে মুগুরপেটা করলে পরে নির্ঘাত পাপ ক্ষয় হয়।

গঞ্জিকা হলো পাঁড় নেশাখোরদের এক নম্বর পছন্দ। এলেমদার সেবন বিশেষজ্ঞদের মতে, এর চেয়ে ‘ভালো আর হয় না'। প্রকৃত সেবনকারীই কেবল গাঁজার মহিমা বুঝতে পারে। ঠিকমতো দম নিতে পারলে নাকি সরাসরি স্বর্গোদ্যান। তবে হুরের কথা কোনো ‘গাঞ্জু' এ পর্যন্ত অবশ্য বলেনি।

বাংলা অর্থাৎ ইথাইল অ্যালকোহল, চরস, ভাং এগুলো স্বদেশি ‘ঐতিহ্য'। এ জন্যই বাঙালি এটাকে এত ‘প্রমোট' করে; নিজস্বতার তত্ত্ব-তালাশ করে। ভাং এক ধরনের পাতার রস। বিশেষ উৎসবে এক গ্লাস দুধে ভাং মিশিয়ে সেবনের গল্প অনেক পুরনো। বহু বছর আগে এক বন্ধুর বয়ান এ রকম–

এক গ্লাস দুধে চিনি আর ভাং মিশিয়ে খেতে হবে। পানে অপূর্ব স্বাদ। কিছুই টের পাওয়া যায় না। আর খাওয়ার পরে তো কথাই নাই। দিনরাত সমান হয়ে যায়। সময়ের অভাবে এখনো রসাস্বাদনের সুযোগ হয়নি। তবে খাওয়ার বৃত্তান্ত শোনাতেও অর্ধপানের আনন্দ পাওয়া গিয়েছিল বটে। তাতে নেশা হোক অথবা না-হোক।

এই দেশি ইয়ে নিয়ে আমার একটু ‘অভিযোগ' আছে। ডিআইজি অফিসে মামলা তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার, অস্ত্র- মাদক উদ্ধার করলে পয়েন্ট পাওয়া যায়। সারা মাসের টোটাল পয়েন্ট যোগ করে সেরা জেলা নির্ধারণ করা হয়। আমি এক জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালে অনেক চোলাই উদ্ধার হতো। সমস্যা হলো দেশি চোলাই মদে পয়েন্ট অনেক কম পাওয়া যেত। আমার প্রশ্ন হলো, এমনটা কেন? দেশিতে নেশা কম হয়? মোটেও না। তো পয়েন্ট কম কেন? দেশীয় ‘প্রযুক্তি ও পণ্যের' প্রতি এহেন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা অনুচিত! এটা দেশপ্রেমিক মাত্রই একবাক্যে স্বীকার করবেন। কিন্তু এ কথাটি সিনিয়রদের বলি কীভাবে? এভাবেই ইতোমধ্যে অনেক পয়েন্ট ‘লস’ করে ফেলেছি। সেই বকেয়া পয়েন্ট এখন আমায় কে ফিরিয়ে দেবে?

তো সিগারেটের কথায় ফিরে আসি। কদিন আগে অফিসের নিচে আমার এক সিনিয়র তাঁরও এক সিনিয়রকে এক প্যাকেট বেনসন দিতে দিতে বললেন, ‘স্যার, নরওয়ে থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসলাম। বিদেশি জিনিস।’ তো ওই স্যার দিনে একটার বেশি খান না বলে আকাশের দিকে বার দুয়েক তাকিয়ে বোধহয় ‘ক্ষণ' হয়েছে কি না তা একপলক দেখে নিলেন। এর পরপরই ধরালেন। ভাবলাম ক্ষণ যদি না হয়ে থাকে তাহলে স্যারকে কষ্ট করে আরেকবার ধরাতে হবে।

তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পও চলছে। বিদেশি বেনসনের প্যাকেটে নানারকম সাবধানবাণী থাকে। সেই সঙ্গে বীভৎস ছবিও দেয়া আছে। স্যার আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, এসব ছবি দেখলে ভয় লাগে, আর খেতে মন চায় না।’ অথচ আমি তাঁর মধ্যে কোনো ভয় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ধীরে-সুস্থে চমৎকারভাবে পুরোটা শেষ করেন। দয়া পরবশ হয়ে আমাকেও একটি শলাকা অফার করেছিলেন। আর তখনই আচমকা মনে পড়ল আমি কীভাবে, কবে থেকে ‘তামাকের'তাঁবেদার হয়েছিলাম? সেসব তো বহুকাল আগের কথা।(চলবে)

লেখক: অতিরিক্ত ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ।