রোহিঙ্গা নিয়ে হতাশা

প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:০৭ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:০০

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যু কার্যত গতিহীন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার আলোচনার কথা বলা হলেও মিয়ানমারের গা-ছাড়া ভাব রোহিঙ্গা সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। এরইমধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে লাখখানেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসার আভাস দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সবমিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে অনেকটা হতাশা নেমেছে বাংলাদেশের।

সবমিলিয়ে এই ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে না পাঠিয়ে দেশের অসহায় মানুষের সেখানে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’

লাখখানেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা বলে আসছিল সরকাল। প্রায় ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরকে বসবাসের জন্য প্রস্তুতও করা হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভাসানচর নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছে।

সমালোচনায় ঘুরে ফিরে বার্তা ছিল, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠালে মিয়ানমার এমন বার্তা পেতে পারে যে বাংলাদেশই রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে, তাদের ফেরত না নিলেও চলবে। এরপরও সরকারের রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে অনড় ছিল। প্রচেষ্টাও চালিয়ে আসছিল।

সম্প্রতি ভাসানচর ঘুরে এসেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এতথ্যটি জানিয়ে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ভাসানচর অত্যন্ত সুন্দর জায়গা। খুব ভালো অ্যারেজ্ঞমেন্ট। ওখানে আমরা রোহিঙ্গাদের নেব কেন? আমরা বরং আমাদের দেশের অন্য লোকজন নিব।’

হঠাৎ কেন সিদ্ধান্তটির পরিবর্তন জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলব সেখানে তাদের (রোহিঙ্গারা) নেওয়ার দরকার নেই, ওরা ওদের দেশে যাক। ওরা যদি একবার ওখানে যায় একটা জট লেগে যাবে বা স্থায়ী হয়ে যাবে। আমরা সবসময় চাই তারা রাখাইনে ফেরত যাবে।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি তুলেছিল। পরবর্তীতে সংস্থাটি সরকারের ওই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও তারা বলেছেন, স্থানান্তরের বিষয়টি অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে।

রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য কতটা উপযোগী, সেটা দেখতে জাতিসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ দলের গেল নভেম্বরে ভাসানচর যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ওই সফরটি পিছিয়ে যায়। এরপর গত ডিসম্বরে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসার কথা জানিয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। তার স্থলে নতুন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন নতুন বছরে প্রথমে দায়িত্ব নিয়ে জানিয়েছিলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে শিগগিরই জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসবে। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থাানান্তর না করতে আন্তর্জাতিক কোনো চাপ রয়েছে কি-না প্রশ্নে মোমেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছিল। তারা সেখানে যেতে তালিকায় নামও নিবন্ধন করেন। রোহিঙ্গারা তো এক পায়ে রাজি।’

‘কিন্তু ইউএনএইচসিআরসহ বিদেশি সংস্থারা রাজি নয়। কারণ তারা কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকে। ভাসানচরে ফাইভ স্টার হোটেল হয়নি। এজন্য তারা সেখানে যেতে রাজি নয়।’

এদিকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার মামলা করা থেকে অন্তবর্তী রায় এসেছে। ওই মামলাটি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনা হয়নি বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

গাম্বিয়ার ওই মামলায় অন্তবর্তী আদেশে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার বিপদ থেকে সুরক্ষায় মিয়ানমারের প্রতি চার দফা নির্দেশ দিয়েছে। ওই রায় প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিজয় বলে মন্তব্য এসেছিল। প্রত্যাশা ছিল এই রায়ের পর হয়তো কিছুটা হলেও আলোর মুখ দেখবে থমকে পড়া প্রত্যাবাসন কর্মসূচি।

তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা থেমে যায়নি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করছি একদিন রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার।

এদিকে সম্প্রতি কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে মারা গেছে ১৭ রোহিঙ্গা। ১৩৮ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে নিয়ে ট্রলারটি মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এঘটনায় ৭৩ জনকে উদ্ধার করা গেলেও নিখোঁজ রয়েছে ৪৮ জন। এই ঘটনার পর ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

আশ্রয় শিবিরে নজরদারির বিষয়ে এক প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি দুর্বল হয়নি উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যা টেকনাফের জনগনের তিন গুণ। তাদের নজরদারিতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসারসহ সব বাহিনী কাজ করছে।’

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত হামলার ধুয়ো তুলে রোহিঙ্গাদের ওপর কাঠামোবদ্ধ নিপীড়ন শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন লাগানোর মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের দিকে ঢল নামে রোহিঙ্গাদের। এই যাত্রায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে অন্তত আট লাখ রোহিঙ্গা। আর আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই সংখ্যাটি ১১ লাখের বেশি বলে অনুমান করা হয়।

বিপুল পরিমান এই রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের নিজভূমে ফেরত পাঠাতে একের পর পর বাংলাদেশের উদ্যোগ মিয়ানমারের নানা তালবাহানার কারণে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই দফা চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের কাউকে রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায়নি। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও ব্যর্থ হয় প্রক্রিয়া।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিলেও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত চার দফায় বাংলাদেশের দেয়া ১ লাখ ৬ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র  ৮ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে রাখাইনের অধিবাসী বলে দাবি করেছে দেশটি।

(ঢাকাটাইমস/১৬ফেব্রুয়ারি/ডিএম)