লেখকের রকমফের: লেখক বনাম নকলনবিশ

প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:০৩

অরুণ কুমার বিশ্বাস

গোড়াতেই বলে রাখি, ইহা একটি রসরচনা। দয়া করে কেউ সিরিয়াসলি নেবেন না। নিলেন তো পস্তালেন।

বইমেলা চলমান। মতান্তরে বউমেলা। উঁহু, কথাটা বোধ হলো ঠিক হলো না। নিজের বউকে বগলদাবা করে কেউ বইমেলায় এসেছে, এমন কথা কস্মিনকালেও শোনা যায় না। এরা বরং রদ্দি মাল কিনতে বউকে নিয়ে বাণিজ্যমেলা সফর করে। অতি বিজ্ঞ নারীগণ ভাবেন, বাণিজ্যমেলায় সস্তা দরে খাস্তা লুচি পাওয়া যায়। অথচ বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। আমি বাণিজমেলা সফর করি না দশ বছর। কারণ আমি বিলক্ষণ জানি, সেখানে যা বিক্রি হয়, তার বেশির ভাগেরই ‘এক্সপায়ারি ডেট’ অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।

ঠিক সেইরকম, কিছু কিছু লেখকের সৃষ্টির কেরামতি শেষ, তবুও তারা বইমেলায় এসে মরুভূমির উটের মতোন নাক উঁচু করে বাতাস শোঁকেন। কোনোক্রমে যদি মিডিয়া কিংবা বিশিষ্ট কারো মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, এই ভরসায় তাদের এমন উমেদারসুলভ অনর্থক বিচরণ। বলে রাখা ভালো, এই শ্রেণির লেখক কোনোকালেই পাতে দেবার যোগ্য কিছু সৃষ্টি করেননি। বরং পদভারে বা পায়াভারিতে তেলাতেলি মুলামুলি করে কিছুদিন পত্রপত্রিকার কাগজ নষ্ট করেছেন। তারা আদতে লেখক নন, চালিয়াত প্রকৃতির মানুষ। এরা বরং পলিটিক্স করলে ব্যাপক সাফল্য পেতেন। ভুল করে সাহিত্যজগতে এসে ল্যান্ড করেছেন। 

মুরিদ-নির্ভর লেখক আছেন কিছু। ইহারা বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ। তাদের চোখেমুখে জিগীষা আছে ঠিক, তবে সেখানে জিজ্ঞাসা বা জানার চেষ্টা মোটেও নেই। তারা স্বঘোষিত লেখক, কলমের চেয়ে চোপার জোর বেশি, এবং এরা স্বভাবতই মুরিদনির্ভর। ব্যাপক স্টান্টবাজি করে কিছু মুরিদ জোগাড় করে তাদেরকেই বই গছিয়ে দেবার অপপ্রয়াসে লিপ্ত।

বলা বাহুল্য, এরা মশাজীবী, অর্থাৎ খুব বেশিদিন লেখকের আয়ু নিয়ে এরা আসেনি। ক্ষণজন্মা নয়, এরা বরং ক্ষণজীবী। এরা সাহিত্যের মূলে কুঠারাঘাত করছে।

জানেন তো, লেখক বস্তুত দুই প্রকার। বিবাহিত ও ব্যাচেলর। ব্যাচেলর টাইপ লেখকরা আবার ‘হবু-জামাই’ লেখক হিসেবেও বিশেষ পরিচিত। বুঝতেই পারছেন, এই শ্রেণির লেখকের মুরিদ বা খরিদ্দার মূলত অবিবাহিত নারী। যারা কিনা একটু বয়সী, অথচ এখনও বর বা ঘরের মুখ দেখতে পায়নি। ব্যাচেলর লেখকরা এদের বিয়ের লোভ দেখিয়ে একরকম বিদ্যুতায়িত অবস্থায় টেনে নিয়ে চলে। অর্থাৎ যেখানে ব্যাচেলর লেখক, সেখানেই বিগতযৌবনা অথচ অবিবাহিত নারীর যাতায়াত। সহজে বোঝাবার জন্য একে আমরা কাবিখা’র মতো ‘বিপ্রবিপুক্র’ বা বিবাহের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে পুস্তক ক্রয়’ কর্মসূচি বলা চলে।

ধরাবাঁধা শ্রেণির লেখকও কিন্তু ইদানিং বেশ দেখা যায়। কোমলমতি পাঠক পেলেই এরা খপ করে টাকি মাছের মতোন তাদের মণিবন্ধ ধরে, আর নিজের স্টলে টেনে নিয়ে যায়। এদেরকে চাইলে আপনি টানাপার্টিও বলতে পারেন। এদের লাজলজ্জার বালাই নাই। যেনতেন প্রকারেণ বই তাকে বেচতেই হবে। কারণ কাবুলিওয়ালা টাইপ প্রকাশক সাফ বলে দিয়েছেন যে, অন্তত তিনশ বই বেচতে না পারলে কিন্তু গাঁটের টাকা গুনে দিতে হবে। বাপের জমি বেচে তো আর আমি প্রকাশনা শিল্পে আসিনি। আপনি সৌখিন লেখক, বই বেচার দায়িত্বও আপনার। 

নাদান লেখক আছে কিছু। এদের বয়স একেবারেই কম। একসময় আমিও এদের দলে ছিলাম। কিছু না বুঝেই ছাপার অক্ষরে নিজের নামটি দেখার আশায় যা নয় তাই করেছি। নাদান লেখকরা মূলত চালিয়াত প্রকাশকের মূল টার্গেট। এদেরকে আপনি প্রচলিত ভাষায় মুরগি ধরাও বলতে পারেন। ছাপাশিল্পের কিছুই এরা জানে না, অথচ বই ছাপানো চাই। এরা বই প্রকাশ করা বলে না, বলে বই ছাপানো। যেন এরা ছাপাখানায় ক্যালেন্ডার বা ডায়েরি ছাপাতে এসেছে। দেখ কাণ্ড!  

চোরা লেখকের এখন বেশ জয়-জয়কার। এরা সব সাহিত্যচোর। প্লেজিয়ারিস্ট। নিজের ভাঁড়ারে কিছু নাই, তাই অন্যের লেখা টুকে বই বের করে ফেলেছে। বোঝা যায়, এরা চিরকালীন নকলনবিশ। জীবনেও টেক্সট বই পড়েনি। ঠেলে গুঁতিয়ে কোনো মতে হয়তো বিএ-টা পাস করেছে, অথচ গ্র্যাজুয়েশন বানান জিজ্ঞেস করলে অন্তত চারবার ঢোক গেলে। এরা অপ্রস্তুত লেখক, এবং বইমেলার কীট বা উপদ্রব। এদের কারণে সাধারণ পাঠক এখন বিভ্রান্ত হয়ে পছন্দের বইটি গরুখোঁজার মতোন খোঁজে। শেষে দিশে করতে না পেরে উল্টোপাল্টা বই কিনে প্রতারিত হয়।

উন্মার্গগামী লেখক আছে কিছু। এদেরকে আপনি মাটিতে নয়, ঘরের চালে ঝুলতে দেখবেন। এরাও টুকটাক টোকে। বিশিষ্ট কোনো লেখকের ডিকশন ও ধরন-বয়ন মেরে কেটে লেখক হতে চায়। ঠোঁটে সারাক্ষণ ‘অ্যাদারিত গোছের’ হাসি ঝোলে। যেন তিনি সদ্যোজাত শিশু, চুরিচামারির কিছুই বোঝেন না। তার মতোন ভালো মানুষ আর হয় না। তিনি দেবোপম ব্যক্তিত্ব। এদের কারণে বইমেলার ক্রান্তিভঙ্গ হয়। রুচিশীল পাঠক বিবমিষায় ভোগে।

নাছোড়বান্দা লেখক চেনেন তো! এরা কিছুতেই আপনাকে ছাড়বেন না। এদের খপ্পরে পড়লে আপনার খবর আছে। তার বস্তাপচা বই আপনাকে দিয়ে কিনিয়েই ছাড়বে। ইনিয়ে-বিনিয়ে আপনার সঙ্গে উটকো সম্পর্ক বানাবার তাল করবে। আপনি তখন নিজের ইজ্জত বাঁচাতে একখানা বই কিনে তবেই খালাস পাবেন।  

‘নাবুড়ে’ লেখক আছে একরকম। নাবড় শব্দের মানে জানেন তো! না জানলেও ক্ষতি নই, কষ্ট করে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অভিধানখানা খুলুন এবং দেখে নিন। নাবুড়ে পাঠকরা চরম ধূর্ত। ভাব ধরবে যেন তিনি জ্ঞানেগুণে অসাধারণ। তার মেলা ডিগ্রি আছে। পত্রিকায় উঁচুদরের চাকরি করেন, বা ব্যাংক চালান ইত্যাদি। অথচ বিদেশি গল্প মেরে মানে চুরি করে বিশাল বই বানানো এদের কাজ। তার না আছে মাথা না মুণ্ডু। এমন চোরাই লেখকদের কারণে পাঠক ক্রমশ মেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভিড় বাড়ছে, কিন্তু আশানুরূপ বই বিক্রি হচ্ছে না। কারণ দুধে পানি মেশালে তাতে দুধের পরিমাণ ও তারল্য বাড়ে, কিন্তু পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়।   

ব্যবসায়ী লেখকের কাজ হলো কিছুক্ষণ পরপর স্টলে গিয়ে তার বই কত কপি বিক্রি হলো তার খোঁজ নেয়া। অথচ সে বোঝে না, বই বিক্রি হলেও তার তেমন কোনো লাভ নেই। কারণ নব্বইভাগ প্রকাশক বই বিক্রির সঠিক হিসাব দেয় না। দিতে পারে না বা চায় না। পনেরো পারসেন্ট লাভ কমে যাবে যে! অমি অবশ্যতাতে খুব একটা কিছু মাইন্ড করি না, কারণ ওটা আমার রুটিরুজির উপায় নয়। বা গরু নিজেই যদি দুধে ঠকায়, তাহলে বাছুরের সাধ্যি কি দুধ বুঝে খায়। 

ফাঁকিবাজ লেখক আছে কিছু, যারা কি না চার পাঁচে কুড়ি শব্দে পৃষ্টা শেষ করে। এর দায় অবশ্য অতি লোভী প্রকাশকের উপরেও বর্তায়। পাঠকের টাকা খোলামকুচি নাকি যে তাদের ঠকিয়ে পয়সা কামানো যায়! এর ফল মারাত্মক হতে পারে। হয়তো এমন একদিন আসবে, পাঠক আর মেলামুখী হবে না। ধনেপ্রাণে মুনাফা মারা যাবে এসকল লেখক ও প্রকাশকের। 

বিপণনশিল্পী টাইপ লেখকরা লেখার চেয়ে তা ছড়ানোয় বেশি মনোযাগী। এদের পোস্টার ও পোস্টে পাঠকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বইয়ের ভেতরে পাঠযোগ্য কিছু নেই, কিন্তু চটকদার বিজ্ঞাপন আর ‘ভাইরে বোনরে’ বলে, লোকের হাতেপায়ে ধরে বেস্ট সেলার হবার তালে থাকে। এদের বালখিল্যপনা দেখে সত্যি সত্যি লেখা থেকে ইস্তফা দিতে মন চায়। কিন্তু তাহলে তো তাদের মস্ত সুবিধে। ইচ্ছেমতো মেলার মাঠে চরে খাবে, আর পাঠকের গাঁট কাটবে।

ফেবুনির্ভর লেখকদের প্রাদুর্ভাব এখন। একটা গ্রুপই আছে, যারা কিনা সারাবছর ফেসবুকে যেসকল ‘কেস’ খালাস করে তাই সংকলিত করে বই বানায়। এরা কিন্তু সমাজে অচ্ছুত। আমি খেয়াল করে দেখেছি, ওই গ্রুপের বাইরে কেউ খুব একটা তাদের ধারেকাছে ঘেঁষে না। যেনো তাদের করোনা ভাইরাসে ধরেছে, তাই ‘কোয়ারেনটাইন’ করে রাখতে হয়। ফলে তারা একে অপরকে বই উপহার দিয়ে টিকে আছে মাত্র।  

সবশেষে হতভাগ্য লেখকের কথা বলি। সত্যি বলতে, আমিও বোধ হয় সেই দলে পড়ি। বিগত কুড়ি বছর কলম পিষে মানইজ্জত খুইয়ে লাজলজ্জা ভুলে কখনও বলতে পারিনি, ভাই আমার বইখানা কিনুন, আমি একটি বিদ্যার জাহাজ। ফলে কী হয়েছে, প্রকাশকরাও খুব একটা গা করে না। আমরা কাঁদি না, তাই তারাও দুধ-জল কিছু দেয় না। তারপরেও যেহেতু সারাবছর কিছু না কিছু লিখি, ফলে কিছু ‘লয়াল পাঠক’ তৈরি হয়েছে বৈকি। তারা স্টলে যায়, কিন্তু বই পায় না। বলে স্টক শেষ। প্রকাশকের পায়াভারি, তারা ব্যাংকার আর মোটিভেশনালদের নিয়ে মেতে থাকে। আমার কথা কে শোনে! কিন্তু তারা জানে না, প্রকৃত সাহিত্যিক নিজের জন্যে লেখে, বগল বাজিয়ে নাম কামাবার জন্যে নয়। আমাদের প্রস্তুতি আছে, কিছু করে খাবার মুরোদও আছে, তাই বই বেচে সংসার চালাতে হয় না। আমরা যেদিন মুখ ফিরিয়ে নেবো, সেদিন সত্যি সত্যি বইমেলায় খরা নামবে। মুরিদসর্বস্ব চাপাবাজ, বিপণনশিল্পী আর সাহিত্যচোরের হাতে বাংলা সাহিত্যের বারোটা বাজবে।