যাপনরম্য-২

ধূমপান বিষপান নয়!

রুহুল আমিন শিপার
| আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১৬ | প্রকাশিত : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:৫৪
রুহুল আমিন শিপার

আমার এক ব্যাচমেট কাম ঘনিষ্ট বন্ধু ক্লাস ফোর এ পড়ার সময় সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। বছর দশেক আগে লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়ায় বসে সে যখন এটা আমাকে বলল, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম– তা তুই ধরলি কবে? সাথে সাথে উত্তর– ওই ক্লাস ফোর এ থাকতেই।

আমার বন্ধু বেশ অল্প বয়সেই কামেলিয়াত অর্জন করেছে। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতেই বুঝেছিল বিড়ি টানা 'চতুর্দশ নম্বরীয় কম্মো' এবং বোঝা মাত্রই 'কুইট' করেছিল। ক্লাস ফোর এ যার মস্তিষ্ক এত শার্প, চতুর্থ শ্রেণিতেই যে এত চতুর, সে এ মড়ার দেশে নদীতে চৌকিদারি করছে কেন? নাসা না হোক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজ কী? এ সমস্ত প্রতিভার অবমূল্যায়নই পৃথিবী জুড়ে 'করোনা' সহ যত সব মানবীয় দুর্ভোগ ডেকে আনছে!

আমি অতটা ইঁচড়ে পাকা ছিলাম না। তাই ধীরে সুস্থে সেভেন-এইটে টুকটাক ধরেছি। কিন্তু আমি কার সাগরেদ? কে ছিল আমার 'ধোঁয়া গুরু'? এতদিন পরে আজ আর মনে পড়ে না।

সিগারেট নিয়ে দারুণ স্মৃতি আছে আমার। অনুমান করি সত্তর দশকের শেষ হবে। বাবার কর্মস্হল তৎকালীন বরগুনা মহাকুমার বেতাগী। মা-সহ আমরা আগেই বাড়িতে চলে এসেছি। বাবার কলেজ ছুটি না হওয়ায় তিনি আসতে পারেননি। তিনি পরে এসেছিলেন। তো গ্রামের বাড়িতে আসার সময় এক জোড়া ইলিশ নিয়ে এসেছেন। তাজা ইলিশ। মা মাছ কুটছেন। আমি বসে বসে দেখছি। বেলা বারোটা হবে। গ্রে কালারের স্যুট পরা বাবা সামনের বারান্দায় বসে সিগারেট ধরিয়েছেন। আর গন্ধে গোটা বাড়ি মৌ মৌ। সিগারেটের মৌতাত অমন মধুর হয়? নাকি আমি অতিমাত্রায় নষ্টালজিক? যতদূর মনে পড়ে বাবা তখন সিজার বা স্টার সিগারেট খেতেন। এগুলো মোটেও দামি ব্র্যান্ড নয়। কিন্তু আজ এতোগুলো বছর পর সেই মৌতাত আর বাবার চেয়ারে বসে থাকার ভঙ্গিটা বড়ই দামি আমার কাছে। আজ বাবা বেঁচে নেই। থাকলে পায়রা নদীর ইলিশ দিয়ে সিগারেটের দৃশ্যায়নটা আবার করা যেত। সে আর এ জনমে হবার নয়।

আশির দশকে মোটামুটি গোটা দুয়েক বিদেশি ব্রান্ড এদেশে পপুলার ছিল। গোল্ডলিফ এবং 555 জীবনে যত প্রকার সিগারেট খেয়েছি তার মধ্যে গোল্ডলিফ মারাত্মক কিসিমের। সুন্দরী হেডমিস্ট্রেসদের মতো। খুউব কড়া। পুরোটা একবারে টানলে মাথা ধরে যেত। উল্টো 555 বেশ দামি এবং সবার পছন্দের ছিল। একটি শলাকা মোটামুটি দেড় টাকা। নেহায়েত ফুটানি ছাড়া এটা খাওয়া হতো না। কারণ পয়সা পাবো কোথায়? অতএব মাঝে মধ্যে এক-আধটা বিড়ি চলত বেশ। 'তারা' বিড়ি ছিল পটুয়াখালী অঞ্চলের গোল্ডলিফ। সাইজে ছোট এবং গোড়াটা কিঞ্চিৎ চ্যাপ্টা। সেই সাথে কড়া তামাক। পুরা বোম্বাই মরিচ। এটা ভালো যে, আমার গুরু যেই হোক না কেন বিড়ি-সিগারেটে কেউ আমাকে রেগুলার করাতে পারেনি। অকেশনাল স্পিন বোলার ছিলাম। অমন অকেশনাল হয়েও একবার বাবার হাতে ধরা খেয়েছিলাম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ঐতিহাসিকভাবেই লেখাপড়ার প্রতি আমার অনীহা ছিল। নানা অজুহাতে স্কুলে না যাওয়া অথবা পালানো ছিল আমার রুটিন কাজ। তো একদিন স্কুল পালিয়ে একটা তারা বিড়ি ধরিয়ে প্রায় শেষ করে এনেছি, এরকম সময় বাঘের সামনে পড়লাম। প্রথমটায় একেবারে ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরতেই বিড়ি ফেলে দ্রুত কেটে পড়লাম। একাধারে স্কুল কামাই, অন্যদিকে 'তারা' সেবন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম রাত হবে ভয়াবহ। মারধরে বাবার দক্ষতাকে শ্রদ্ধাভরে সমীহ করতাম, এখনো করি! পাকা হাত ছিল তাঁর! ভরসা ছিল শুধু আমার মা। তিনি আবার সর্বংসহা। তুমুল উৎকন্ঠায় রাতটা কেটে গেল। কিন্তু নির্বিঘ্ন, প্রহারবিহীন নিরুত্তাপ রজনী। কিছুই ঘটল না। ভাবলাম ভুলে গেছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গলো পরের রাতে। মা বলছিল, দুপুরে তোর আব্বা বলল, তোমার ছেলে বিড়ি খায়। আমি ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে গেলাম, পুরা প্রকৃতির লাঙল। একটু নরম মাটি পেলে সেঁধিয়ে যেতাম। এর থেকে মারপিট অনেক ভাল ছিল। পরক্ষণেই অবশ্য মনে হল, মাত্র এই টুকু? এত অল্পে 'কার্তিক মাস' পার, গুরু?

যাহোক এরকম আরও একবার বেঁচে গিয়েছিলাম। ১৯৮৬ সাল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার বাবা প্রার্থী। দক্ষিণবঙ্গের রাস্তাঘাটের কথা আর নাই বা বলি। সুতরাং এত বড় সংসদীয় আসনে ক্যাম্পেইনের একমাত্র অবলম্বন ছিল নৌপথ। সোজা কথায় ট্রলারই ভরসা। তো ট্রলার ভাড়া করতে জনৈক'র সাথে আমি বরগুনা গেলাম। ওই প্রথম এবং শেষবারের মতো বরগুনা গিয়েছি। দেখা টেখার পর ট্রলার পছন্দ হয়নি। বড় নৌকায় একখানা ইঞ্জিন লাগানো। অতএব ভাড়া করা হলো না। হুদাই ম্যালা খাটুনি। রাতটি কোনমতে কাটালাম। সকালে বাসে করে পুরাঘাটা গিয়ে পটুয়াখালীর লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চের নাম যতদূর মনে পড়ে এমভি শিপলু অথবা শিথিল হবে। আমতলী-পটুয়াখালী রুটে চলত। ছোট্ট দোতলা লঞ্চ। নিচে পেছনের দিকে ইঞ্জিন রুম। এর চারিদিকে রডের খাঁচা। ছোট্ট লোহার সিঁড়ি বেয়ে খোলের মধ্যে নামলে পরে ইঞ্জিন রুম। বাকি অংশে কাঠের বেঞ্চি দেয়া। দোতলায় সামনের দিকে সুকানির কেবিন যেখান থেকে লঞ্চ চালানো হয়। এরপর যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের কেবিন।

লঞ্চ গন্তব্যে রওয়ানা করেছে। সেদিন পায়রা নদী কোন কারণে বেশ উত্তাল। এই নদী পিলে চমকে দেবার মতো চওড়া। পুব۔পশ্চিমে মোটামুটি কিলো দু' আড়াই তো হবেই। বরিশালের লোক পানি ডরায় বলে শুনিনি । আমিও না। কিন্তু মরনে তো ঢাকা-বরিশাল নেই। ওটাকে সবারই ভয়। তাই লঞ্চে উঠলেই চোখে পড়ত দোয়া ইউনুস। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন। এই দোয়া পড়ে নবী ইউনুস মাছের পেট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমার মতো আধা পাপী 'কারো' পেটে ঢোকার পর আস্ত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। আর তিন টুকরো হওয়ার পর পেটের ভেতরে আর বাইরে তফাৎ কী?

আগেই বলেছি, লঞ্চের দোতলায় কেবিন আছে। বাবা সাথে না থাকলে সাধারণত কেবিনে ঢুকতাম না। ওই যুগেও এখনকার মতো সবাই রাজা-উজির মারত। ওই বয়সে যা খুবই বোরিং। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেকে ঘুরে বেড়াতাম। কিংবা রেলিঙ এ বসতাম। আমাদের থেকে বেশি বয়সীরা মহিলা কেবিনের আশেপাশে নিজ গুণে স্হান করে নিত। আমার তখনও সেই 'এলেম' হয়নি। যাহোক কেবিন ঘেঁষে দাড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। বাতাসের কারণে সেদিন কেবিনের জানালা সব বন্ধ। একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে আমায়। পরিচিত কাউকে চোখে পড়ছে না। আর এই অঞ্চলে কেউ আমাকে চেনার কথাও না। সুতরাং এখানে আমি নিরাপদ- এমন ভাবনা থেকে একটু ধূমপানের ইচ্ছা জাগ্রত হল। এরকম 'অনুকূল' পরিবেশে তা হতেই পারে। তারপরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। অতএব টেস্ট ম্যাচের ওপেনারদের মত ধৈর্য ধরে বার দুয়েক নাকের সামনে দিয়ে 'এই পান-সিগ্রেট' কে যেতে দিলাম। তবে দেখে শুনে তৃতীয়বার খপ করে ধরে ফেললাম।

একটা 555 আর পান দে।দারুণ লাগছে আমার। চৌদ্দ বছরের নিজেকে বেশ বড় মনে হচ্ছে আজ। আমার সাথে যে আছে সে কোথায় আল্লাহই জানে ! মোটামুটি আধাআধি টানা হয়েছে এমন সময় পাশের জানালাটা খট করে খুলে গেলো। প্রথমবার কেয়ার করিনি। দ্বিতীয়বার তাকিয়ে কলিজা শুকিয়ে আখরোট হয়ে গেলো। বাইরে যিনি মাথা বের করেছেন তাঁকে দেখে ভয় পাবার একশ একটা কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো তিনি আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার স্যার। দ্বিতীয় কারণ হলো স্যার আমাকে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছেন। আগের বছরের মতো আবার দৌড় দিলাম। তবে পার্থক্য, এবার সিগারেট ফেলিনি। দেখলাম হাতেই আছে। ফেলি কী করে? দেড় টাকা। দামি মাল। এক দৌড়ে পেছনে গিয়ে ধীরে সুস্থে ফিনিস করার পর মনে রাজ্যের ভয় ঢুকে গেলো। এবার তো আস্ত রাখবে না। পরে যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম একটা 'কল' এর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু স্যার আমায় অপেক্ষায় রাখলেন শুধু। কিন্তু কেন? আমি বেজায় স্নেহধন্য ছিলাম? কিন্তু 'পান' ও 'সেবন' তো অমার্জনীয় অবিমৃষ্যকারিতা। আমি সম্ভাব্য এমপি পুত্র? নাহ্, তাও না। ওই নির্বাচনে বাবার জেতার কোন সম্ভাবনাই ছিলনা। তা সত্ত্বেও মারধোরের এমন মওকা স্যার কেন শুধু শুধু ছেড়ে দেবেন? এটা আজও মাথায় আসে না। এটা তাঁর 'বাজে' সিদ্ধান্ত। সিনিয়ররা হয়তো মাঝে মাঝে এমন করেন। বাচ্চাদের মতো কাজকাম করেন। তাতে আমাদের অবশ্য মান বাঁচে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি তাবলিগের ছেলেরা সিগারেট খায় না। তাতে যোগদানের দাওয়াত যে পাইনি তা নয়, পেয়েছি বেশুমার। কিন্তু দাওয়াতি ভাইদের দেখলেই রুমের সবাই মটকা মেরে পরে থাকতাম। ঘুমন্ত লোক জাগিয়ে তো আর দাওয়াত দেয়া যায় না। চলে যেত। ক্লাসমেট রবিউল তাবলিগ করত। মাঝে মাঝেই তার দ্বীনি দাওয়াত পেতাম। একদিন বললাম, বন্ধু আমার খ্রিস্টান নাম তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি। জন উইলিয়াম শিপlর। ও বলল, সরি দোস্তো আমি আসলেই খেয়াল করিনি। পুরো ফার্স্ট ইয়ার রবিউল 'বহুত ফায়দা' র কথা আর বলেনি। তবে পরে ওর কাছে ধরা খেয়েছিলাম। তখন মারতে এসেছিলো।

সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সিগারেট ম্যানিয়াকদের সাথে দোস্তি ছিল। কিন্তু আমি ছিলাম পার্শ্বচরিত্রে। হিন্দি সিনেমায় যেভাবে নায়িকার সখিরা থাকে অনেকটা সেরকম। নায়িকা গান গায় আর সখিরা ও ও করে। আমি ও ও পার্টি। তখন ভালমন্দ খাইলে একটা পান আর বেনসন চলত। নট রেগুলার।আর ওই যুগে একেবারে সিগারেটবিহীন থাকাও ছিল দারুণ অসম্মানজনক। কেননা সিগারেট খাইলে ম্যানলি লাগে; মেয়েরা ধূমপায়ীদের পছন্দ করে, এরকম মিথ চালু ছিল।

অতএব ধূমপান নিয়ে বৈরাগ্যও ছিল না আবার অতটা 'আশেক'ও ছিলাম না। আশেক হয়েছি পরে।(চলবে)

লেখক: অতিরিক্ত ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :