জল ও জীবন: সমর্পিত অবগাহন

আতাউর রহমান মারুফ
| আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:১২ | প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:৩০
তৌহিদুল হক। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গাত্রের দাহন বা দহনের সন্তাপন, শেষমেশ জলে নেমেই ধরি বাহন। অর্থাৎ, বাহ্যিক দাহ্য যন্ত্রণা বা অন্তরের বিরহ-বেদনা, এই দুই অবস্থাকে আমরা জলের বন্দনা করেই প্রশমন করি। যেমন, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে যখন শুকিয়ে যায় পৃথিবীর প্রাণ; হারিয়ে যায় জীবনের রস-আঘ্রাণ; তখন আরাধ্য বর্ষা এসে মিটিয়ে দেয় সব তপ্ততা, সাজিয়ে দেয় পৃথিবীকে সৌন্দর্যে আর সজীবতায়, ফিরিয়ে দেয় তারআপন রুপ লাবণ্য, বাংলা হয়ে উঠে টয়টম্বুর আর যৌবনাদীপ্ত।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এই বর্ষা ঋতু নেই। সৌভাগ্যবান বাঙালি কবিরা বর্ষার রুপে মুগ্ধ আর গুণে শুদ্ধ হয়ে ভেসে বেড়ায়। বর্ষায় সে বিরহে কাতর হয়, বর্ষার আগমণেকবি প্রেমে উৎফুল্ল হয়ে উঠে, কামনার উন্মত্ততায় বিবশ হয়, বর্ষায় ভালবাসা পূর্ণ হয়ে উঠে। ফলে ‘মেঘদূত’ থেকে শুরু করে ‘বর্ষামঙ্গল’ হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা আর জলের স্রোত একটি বহমান ধারা। বর্ষা যেন কবিতার প্রাণ। আর কবিতাতো জীবনের গান।

২০১৮ সালে প্রকাশিত তৌহিদুল হকের ‘এস তব জলেতে নামি’ কাব্যগ্রন্থটি সমকালীন বাংলা কবিতায় বহমান বর্ষা বা জলের স্রোতে একটি বিশিষ্ট সংযোজন। কবি এখানে বিরহের উতলায় ব্যাকুল এবং তা অবসানেও আকুল। মিলিত হওয়ার এ কোন বাসনা, লোহ-চম্বুকের অনিবার্য পরিণতির মত যা টানতে থাকে, মাতাল করে তোলে, বুকে উঠে ঝড়।

তাই কবি বলেন— ‘তব এসো সখি জলেতে নামি/করি সেই গাহন/যেথা মাখনের পরশে জলতরঙ্গে অবিরাম/জলের মাখামাখি...।’ বইটিতে সর্বমোট পঞ্চাশটি কবিতা রয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার শব্দের সমাহারে কবিতাগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত, প্রেম-বিরহ, প্রকৃতি আর বৃষ্টির জলে অবগাহনের কবিতা। দ্বিতীয়ত, সামাজিক বাস্তবতা, জীবনের রুক্ষতা আর মানবিক মূল্যবোধধর্মী কবিতা। এবং সর্বশেষ, উপরোক্ত দুটোরেই সমন্বয়ে বর্ণিত উপমাধর্মী ব্যতিক্রমী কবিতা। ফলে একটি কাব্যগ্রন্থেই পাওয়া যাবে বিচিত্র রূপময় কবিতার স্বাদ।

কবি তৌহিদুল হক একইসঙ্গে একজন সমাজ গবেষকও। ফলে কাব্যগ্রন্থটি সমাজ বাস্তবতায় নারী-পুরুষের পরষ্পর আবেগ, দূরত্ব সামাজিক দৃষ্টিসহ পরষ্পরের ভালো লাগার সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় অঙ্কন করে, যা চিন্তার খোরাক যোগাবে। কাব্যগ্রন্থটি মানুষে-মানুষে দূরত্বের ব্যাপ্তিতে মানুষের মধ্যে যে হাহাকার তৈরি হয়, নতুন শব্দের দাপটে তা উপস্থাপিত হয়েছে এবং যা মানবিকবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

যেমন ‘হাসপাতাল থেকে ফিরে’ কবিতার শুরু হয়েছে এভাবে— ‘মাঝরাতে হঠাৎ ফোন/অপর প্রান্ত থেকে হঠাৎ বলছে-/ওমুক এগিয়েছে; বললাম, কোথায়?/বললো, পৃথিবীর অন্য পাড়ায়/।’ মৃত্যুকে বর্ণণায় এমন ব্যঞ্জনা এবং জীবনের বাস্তবতা পুরো কবিতায়- পুরো কাব্যগ্রন্থেও এমন ব্যঞ্জনা বিরাজমান— অন্য রকম এক আবেদন তৈরী করে।

ফলে পাঠকও বর্ণণায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে উঠে এবং জীবনের অন্তর্নিহিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে শুরু করে। জীবনের পাশে যে জীবন ছিল মিশে, সে জীবন আজ চলে গেছে বহু দূরে, হৃদয়ের গহীনে করেছে গভীর ক্ষত। এই একাকীত্বে, জীবন বিপর্যয়ে অসহায় মানুষ আশেপাশের মশা-মাছিকেও খুব আপন মনে করতে থাকে। কিন্তু এতো মিথ্যা আশ্রয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ নিজেই আসলে নিজের আপনজন। এজন্য আমাদের প্রত্যেককে নিজস্ব প্রস্তুতি নিতে হবে নিজের জন্য। আর আমাদের স্বতন্ত্র প্রচেষ্টার সমন্বয়েই মানবিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। মানুষের হাতে এভাবেইবেগবান হয়নতুন সমাজ বিনির্মাণ। তবেই জীবন সার্থক হয়ে উঠে। কবি তাই বাস্তবিকই বলেছেন ‘জীবনের হিসাব জীবনেই শেষ করতে হয়।’

মানুষ কেন লেখে? অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে কেন এই বিকল্প জীবনযাপন করতে চায়? কবি বলছেনÑ এক অজানা ব্যথা, যা শরীর, মন, চিন্তা-শক্তি, প্রেম, বিদ্রোহের প্রতি ব্যাকুল উত্তাপ জাগায়। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে শব্দের কাব্যিক আয়োজন।

এই বইটির প্রথম কবিতা ‘এক নারী রাত বারোটায়’ এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। ফুটে উঠেছে ব্যক্তিক অভিপ্রায়ের উর্ধ্বেও সামাজিক মুক্তির উৎকীর্তন। রাত বারোটায় শহরের শব্দরা যখন বিশ্রাম খুঁজে, মানুষেরা যখন ক্লান্তির অবসান চায়। তখন কবির ভাষায় ‘মনের ঈশারায় চোখের অস্থিরতা, নারী-সৌন্দর্য, রুপ লাবণ্য, সব-সবই মন চায়’।

কিন্তু রাতগুলো বড় স্বার্থপর, পুরুষতান্ত্রিক। ফলে রাতে পুরুষের হৈ হল্লা স্বীকৃতি পায়, কিন্তু নারীরা সে সুযোগ পায় না। এমনই এক রাত, রাত বারোটায়; এক নারী একাকী হেটে যায়। লজ্জাহীন বাতাসের কাঁপনে, চুলের এলোমেলো আয়োজনে হৃদয়ে তোলাপাড় শুরু হয়। এ দৃশ্য কবির মনেও কাঁপন ধরায়, বিহ্বল করে তোলে। তবে তা অন্য কারণে। এই রাতে কবির মনে হয়েছে ‘স্বাধীনতা স্বাধীন ভাবে হেটে যায়।’ স্বাধীনতা, সাম্য, মুক্তি আর কামজ অনুভূতির এমন অনন্য বর্ণিকা উত্তর আধুনিক সাহিত্য পাঠের স্বাদ এনে দেয়।

ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁক লাঁকা বলেছেন— ‘আল্লাহ আমাদের ভাষা দিয়েছেন মনের ভাব লুকিয়ে রাখার জন্য।’ কিন্তু মানুষ আসলে কখনোই তার অব্যক্ত কথাগুলো লুকিয়ে রাখতে পারে না। অধিকাংশ সময় মানুষ এই অব্যক্ত বেদনাগুলো বহি:প্রকাশের ছলেই লেখক হয়ে উঠে। এ কারণেই মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন— ‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে যে সব বিষয় প্রকাশ করা যায় না, সেগুলো জানানোর জন্যই লিখি।’

পাওয়া না পাওয়ার এসব বেদনাগুলো যখন ভারী মেঘ হয়ে গর্জন করতে থাকে, তখন মুষলধারে বৃষ্টি নামার মত কলমের ডগায় শব্দগুলো কলকল ধ্বনিতে মুখরিত হতে চায়। কবি তৌহিদুল হক এক অলীক বেদনার নিষ্পাপ অনুভূতি নিয়ে আজো তার প্রেমকে খুঁজছেন, বন্দী হয়েছেন এক প্রলুব্দ মায়ায়। তাই আশ্রয় নিয়েছেন কবিতার ছায়ায়। চোখের ইশারাকে মানুষ আহ্বানের ইশারা বলে ভুল করে।

আসলে, প্রেয়সীর কম্পমান ঠোঁটই হৃদয়ের দৃষ্টি খুলে দেয়। যে দৃষ্টি কবিকে বিভোর করেছিল আর পেয়েও হারিয়ে ফেলার বেদনায় কাতর করেছে। ফলে কবির উচ্চারণ— বিশ্বাস করো,/তোমার জলভরা ঠোঁটের কাঁপনে/এখনো, বারো মাইল হাঁটি..।’

‘একজন কবি হচ্ছেন একটি নাইটিঙ্গেল পাখির মত, যে অন্ধকারে একা একা মনের আনন্দে সুরেলা গান গেয়ে যায়’Ñ ইংরেজ কবি শেলীর এই মন্তব্য যথার্থই তাৎপর্যপূর্ণ। একজন কবির এই একাকীত্ব এবং গান গেয়ে যাওয়া আসলে বেদনা এবং দ্রোহের চিৎকার। না লিখলে কবি বা সাহিত্যিককে কেউ মৃত্যুদণ্ড দেবে না। তবুও একটি প্রসারিত জীবন আর অস্পর্শ্য স্বপ্নের দুর্বার আকর্ষণে সে লিখতে থাকে। সমাজের , রাজনীতি আর অমানবিকতার, নৈরাজ্য আর অন্যায্যের বিবেক হয়ে উঠে কবি।

ফলে রোহিঙ্গাসহ সব নির্যাতিত আর অবহেলিত মানুষের বেদনায় নীল হয়ে কবি হতাশ হয়ে বলে— আমি হতে পারিনি মানুষ, আমিতো/মানুষের কাছ থেকে অমানুষ হয়ে ফিরেছি..।’ ভাল সেজে থাকার কৃত্রিম মুখোশকে কবি প্রশ্ন করেছেনÑ ক্ষমতাবানদের ব্যর্থতায়রক্তাত্ত মানবতার রঙে লজ্জিত হয়েছেন, মাথা নত করেছেন। কথার মাতামাতি বাদ দিয়ে— রোহিঙ্গার পাশে/দাঁড়াতো। নামকাওয়াস্তে এগিয়ে আসা বা এড়িয়ে যাওয়া/ মানুষের কাজ নয়, আজ ক্ষমা চাই...।’ প্রতিটি নতুন সময় কবিদের হাতে তুলে দেয় নতুন বাঁশরি, জাতিকে দেয় নতুন দিশারী। এই গ্রন্থ এবং কবির সজাগ অভিলষণ তারই প্রতিচ্ছবি।

বাংলা সাহিত্যের প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসে গদ্যের বয়স মাত্র দুইশ বছর। সেসময় কবিতায় লেখা হতো বড় বড় কাহিনী। সব কিছুতে গেঁথে ছিল ছন্দ। কারণ মানুষ যাদুতে বিহ্বল হতে ভালবাসে। কবিতা একই সাথে গাওয়াও হত। মধুসূদন দত্ত প্রথম তার সনেটের আঘাতে আমাদের বুঝিয়ে দিলেনযে,কবিতা হচ্ছে আসলেপড়ার বস্তু। তারপর থেকে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা উতরিয়ে, দুর্বোধ্যতার কালিমাকে ধুয়ে আধুনিক বাংলা কবিতায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে ভাষা এবং বিষয়গত পরিবর্তন। ধর্মীয় আখ্যানের চেয়ে বিষয়বস্তু দখল করেছে জীবন আখ্যান, ছন্দের জায়গা দখল করেছে মুক্তছন্দ। মুক্তছন্দে লেখা ‘এস তব জলেতে নামি’ কাব্যগ্রন্থটিতে ফুটে উঠেছে যাপিত জীবনের ব্যথা, একান্ত চাওয়া পাওয়া আর না পাওয়ার হতাশা, প্রকৃতিতে আদিমতা খোঁজার উচ্ছলতা, অমানবিকতায় উৎকন্ঠা আর তার সাথে নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গতা।

বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রন্থটি কোনভাবেই এককেন্দ্রিক, গতানুগতিক আর নতুনত্বহীন শব্দভান্ডারের বাগাড়ম্বর নয়। এ গ্রন্থ যেন সঙ্গমরত নারী পুরুষের পবিত্র সুখের ঐশ্বর্যময় প্রতিচ্ছবি। এখানে সমাজ আর কাব্য একাকার হয়েছে, নারী আর স্বাধীনতা সমার্থক হয়েছে, তেমনি ভাষার জন্য বাঙালির আত্নত্যাগ আর প্রেয়সীর জন্য অনুভূতির মেলবন্ধন ভাগাভাগি করে বয়ে চলছে।

কবি বলছেন— ‘জীবন ত্যাগে যেভাবে চেয়েছি বাঙলাকে/সময়ের বেগে দাঁড়িয়ে আজ, বাঙলায় বলি-/তোমাকে চাই।’ কবিতা, সমাজ, ইতিহাস,,প্রকৃতি আর বিরহ-ভালবাসার বহুমুখী উচ্চারণ এই কাব্যপাঠকে প্রকৃত জীবনের অভিজ্ঞতার নিজস্ব বয়ান মনে হয়, চেনা বাক্যের সুরেলা গান বলে মনে হয়।

সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন— ‘লেখাটা কঠিন কাজ নয়, যে কেউ লিখতে পারেন, কঠিন হচ্ছে লেখাটিকে একটি পাঠের অধিক আয়ু দান করা।’ কবি তৌহিদুল হকের লেখা এই গ্রন্থটির আয়ু আর তার অবস্থান সময়ই বিচার করবে। তবে এই গ্রন্থের পাঠযাত্রা জীবনবোধের তীক্ষ হাহাকারের অনুভূতি আর বুকের ভেতরে বাজতে থাকা নিষ্পাপ প্রেমধ্বনিকে উসকে দেয়, সজীব করে তোলে আর চলতে থাকা সময়কে প্রশ্ন করতে শেখায়।

বর্ষায় প্লাবিত জল যেমন আমাদের ভালবাসাকে উতলে দেয় আর সুখকে উন্মত্ত করে তোলে, তেমনি কৃষ্ঞের বিরহে রাধার নোনা জল আর বন্যার জলে প্লাবিত অসহায় মানুষের আর্তনাদ আমাদের বেদনা দেয়।আমাদের পথচলা, সাহিত্য ও বেঁচে থাকা এবং তার সাথে এই জল আর বৃষ্টিকে এক সুতোয় গেথে পরিপূর্ণ জীবনের বর্ণণা দিয়েছে এই বইটি। এজন্যই জীবননান্দ বলেছেন, জীবন নিয়েই কবিতা।

সবশেষে তাই কবির সুরেই বলতে হয়, মানুষের হারিয়ে যাওয়া বোধ ফিরে পেতে নতুন চিন্তার স্বস্তি যোগাবে কাব্যগ্রন্থটি, একই সাথে প্রকৃতি, পরিবেশ, বৃষ্টির প্রতি মানুষের লুকানো প্রেম জাগ্রত হবে। মানুষ খুঁজে পাবে মানুষের ঠিকানা। ‘জীবন তো নয় হেরে যাবার,/জীবনে জীবন হাসে, বাড়িয়ে দেয় হাত/মানুষের মুখের ভয়হীন হাসি,/স্বর্গ-সুখের লুটোপুটি।’ এভাবেই কবিতা সমাজে আশার সঞ্চার করে যায়। কবিরা বিরহের ভার নিয়ে বেড়ায়।

কাব্যগ্রন্থ ‘এস তব জলেতে নামি’। কবি তৌহিদুল হক। প্রকাশক অরণ্য প্রকাশ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :