ইভনিং কোর্স নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উভয় সংকট

ড. মো. সাজজাদ হোসেন
| আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৫২ | প্রকাশিত : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৪১

বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য আবদুল হামিদ গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে বক্তব্য দেন। তিনি অনেক বিষয় নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন। এক পর্যায়ে, তার বক্তব্যে উঠে আসে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইভনিং (সান্ধ্য) কোর্সের ছড়াছড়ির বিষয়টি। ওইসব ইভনিং কোর্সের জন্য বিদ্যার্থীদেরকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ইভনিং কোর্সগুলোর কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা ক্রমেই বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যম হয়ে উঠছে। (‘আমলে নিন রাষ্ট্রপতির আহবান’, দৈনিক সমকাল, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, বুধবার, পৃ.৪: কলাম ১)।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির ওই বক্তব্যের পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৩ দফা দিক-নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে ইভনিং কোর্সগুলো বন্ধ করার কথাও বলা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ওই চিঠিতে ইভিনিং কোর্সগুলো বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে নাকি নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট নয়। তথাপি, ইতোমধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইভনিং কোর্সে নতুন করে ভর্তি বন্ধ ঘোষণা করেছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইভনিং কোর্স অব্যাহত রাখা অথবা বন্ধ করে দেয়া নিয়ে এখনো মুখ খোলেনি। খুব সম্ভবত ইভনিং কোর্স নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন উভয় সংকট।

কোন প্রেক্ষাপটে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইভনিং কোর্সের সূচনা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। ইভনিং কোর্সের ইতিবাচক দিকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ইভনিং কোর্সের নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক। ধরা যাক, ঢাকায় অবস্থিত অত্যন্ত নামকরা একটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের নাম হচ্ছে ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়’। তো, ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়ের’ অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা এবং কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান নীতি নির্ধারক শিক্ষকনেতার সাথে কথা বলে কিছু ধারণা পাওয়া গেল কোন প্রেক্ষাপটে ইভনিং কোর্স রমরমা হয়ে উঠল।

প্রথমত, প্রায় ২০-২৫ বছর আগে দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নানাদিক থেকে বলা হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, দেশের অসংখ্য বিদ্যার্থী ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ লাভে দারুণ আগ্রহী। অর্থাৎ, বাজারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সনদের অসীম চাহিদা ছিল। কিন্তু যেনতেনভাবে একটি সনদ লাভের উপায় হতে পারে কেবল কোন ইভনিং কোর্স থাকলে।

তৃতীয়ত, ২০-২৫ বছর আগে ডাকসু অস্তিত্বহীন, নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব ছিল্। ফলে ওই সময়ে যখন ইভনিং কোর্সের পত্তনি শুরু হয় তখন কোন প্রতিবাদ-বাধা আসেনি। চতুর্থত, তথাকথিত বাম ঘরানার কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে ঠিক অথবা বেঠিক বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচী করতে দেখা যায়। কিন্তু, ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অনেক বিভাগে যখন ব্যাঙের ছাতার মত ইভনিং কোর্সের বাড়াবাড়ি রকম বিস্তার শুরু হল, তখন রহস্যজনকভাবে তখাকথিত বামপন্থী অনেক শিক্ষাগুরুকে সেসব ব্যাঙের ছাতার তলায় সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা খুঁজতে দেখা গেল। বলতে গেলে, বিনা বাধায়, বিনা প্রতিবাদে, ইভনিং কোর্সগুলোর ব্যাপক বিস্তার ও ছড়াছড়ি সম্পন্ন হয়। সঙ্গতকারণে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়, বাজারে চাহিদা থাকলে ওই চাহিদাকে কেন্দ্র করে আর্থিক লাভের চিন্তা আসবেই। তবে, ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়’ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং কোর্সের জন্য সাবেক অথবা বর্তমান কোন একক ব্যক্তি, কর্তৃপক্ষ বা গোষ্ঠীকে দায় দেয়া সম্ভব নয়।

ইভনিং কোর্সের কিছু সমালোচনা আছে। প্রথমত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইভনিং কোর্সের অতিরিক্ত ছড়াছড়ি। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতিবছর অনেক গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে। তৃতীয়ত, ইভনিং কোর্সের ব্যাপারে অনেক সময় ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। চতুর্থত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার পরিবেশের উপর চাপ পড়ছে। এমনকি, অনেক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে (‘ঢাবির সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি’, দৈনিক সমকাল, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, পৃ.১৩:কলাম ৬)।

কিন্তু ইভনিং কোর্সের অনেকগুলো ইতিবাচক দিক যথেষ্ট গুরুত্ববহ। প্রথমত, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মেধাবী শিক্ষকরা নিয়োজিত আছেন। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাইরে অনেক বিদ্যার্থী ইভিনিং কোর্সে সেসব মেধাবী শিক্ষকদের লেকচার থেকে সমৃদ্ধ হতে পারেন। যা আসলে মানব উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখতে পারে। দেশে অধিকতর দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত মানব সম্পদ সৃষ্টিতে সম্পূরক দায়িত্ব পালন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলো ইভনিং কোর্স সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে ইভনিং কোর্সে আগ্রহী বিদ্যার্থীরা সবাই যাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যেহেতু বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঐসব কোর্সের খরচ নেয়া হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেয়া খরচের তুলানয় কয়েকগুণ বেশি।

মনে করা যাক, কোনো একটি নির্দিষ্ট ইভনিং কোর্সের জন্য ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়’ খরচ হিসেবে নেয় ২ লাখ টাকা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইভনিং কোর্স বন্ধ করে দিলে কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ঐ কোর্সের জন্য ৪ লাখ টাকা নিতে পারে। ইভনিং বিদ্যার্থীদের বেশি টাকা খরচ করতে হবে, তাদের উপর আর্থিক চাপ বাড়বে। এছাড়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (পার্টটাইম অথবা ফুল টাইম হিসেবে) টানবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অকল্পনীয় রমরমা ইভনিং কোর্স চালানোর জন্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ইভনিং কোর্সের জন্য বিদ্যার্থীরা যেখানে অন্তত ১০ জন মেধাবী শিক্ষক পেতেন, সেখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ একই কোর্সের জন্য ইভনিং বিদ্যার্থীরা নিঃসন্দেহে ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। কারণ প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেবা দেন। তৃতীয়ত, ইভনিং কোর্সের বিদ্যার্থীদের মধ্যে অসাধারণ চৌকস ও সফল পেশাজীবীরা রয়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদেশের বিখ্যাত বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় থেকে গবেষণা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন। ইভনিং কোর্স একটি যথার্থ প্লাটফর্ম হতে পারে যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের অর্জিত দক্ষতা ও বিশেষ জ্ঞান রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরের অনেক পেশাজীবীর সাথে শেয়ার করতে পারেন। এতে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী লাভবান হয়।

চতুর্থত, ইভনিং কোর্সের বিদ্যার্থীরা বেশিরভাগ কর্মজীবী, পেশাজীবী এবং আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের অধিকাংশের বয়স সম্ভবত দেশে প্রচলিত সরকারি চাকরির আবেদনসীমার বয়সের চেয়ে বেশি। এমতাবস্থায়, ঐসব কর্মজীবী ও পেশাজীবী ইভনিং গ্রাজুয়েটরা নিয়মিত কোর্সের গ্রাজুয়েটদের জন্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোন চাপ তৈরী করে থাকলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নানারকম ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

মনে করা যাক, ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ মোট প্রায় ২০০০ শিক্ষক কর্মরত আছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিভাগে বা ইনস্টিটিউটে ইভনিং কোর্স আছে, সেসব বিভাগে কর্মরত প্রায় ৭০০ শিক্ষক। অর্থাৎ ২০০০ শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৭০০ শিক্ষক ইভনিং কোর্স থেকে কোন না কোনোভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। অন্য ১৩০০ শিক্ষকের বিভাগ বা ইনস্টিটিউটগুলোতে ইভনিং কোর্স সুবিধাদি নেই। তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতা করেন। তবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পার্টটাইম শিক্ষকতা করতে আগ্রহী নন। বস্তুত, মোট ২০০০ শিক্ষকের মধ্যে অল্পসংখ্যক শিক্ষকই বাইরে পার্টটাইম শিক্ষকতা করেন। যারা পার্টটাইম শিক্ষকতায় অতি উৎসাহী, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভনিং কোর্স চালু থাকলেও বাইরে পার্টটাইম করতে যাবেন, ইভনিং কোর্স বন্ধ হলেও বাইরে পার্টটাইমের সুযোগ নেবেন। সম্ভবত, যেহেতু প্রায় ২০০০ শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ১৩০০ শিক্ষক ইভনিং কোর্স সুবিধার বাইরে, তাদের অধিকাংশ ইভনিং কোর্স বন্ধ করে দেয়া সমর্থন করতে পারেন। অন্যদিকে, প্রায় ৭০০ শিক্ষক ইভনিং কোর্স সুযোগ-সুবিধা ভোগ করায় সম্ভবত তাদের অধিকাংশ ইভনিং কোর্স চালু রাখার পক্ষে থাকবেন। ‘প্রাচ্যের মেধা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ শিক্ষক নেতাদের সারা বছর ধরে অনেক নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়। সেক্ষেত্রে, শিক্ষক রাজনীতিতে প্রায় ৭০০ ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হতে পারে। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলকাজ জ্ঞান চর্চা। সম্ভবত, ইভনিং কোর্স নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের জন্য সুষম ও সমন্বিত পদক্ষেপ সুফল দিতে পারে। বিশেষ করে, যখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের ও জনগণের টাকায় পরিচালিত হচ্ছে, তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকার গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি। ই-মেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :