মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ-সালাউদ্দিনদের স্মরণে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:২৬ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৩৮

নওয়াব উদ্দিন আহমেদ টোকন, ঢাকাটাইমস

‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান, ওরা আসবে চুপি চুপি, যারা এই দেশটাকে, ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’ করিমপুরের যুদ্ধের কথা লিখতে বসে আজ চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। নভেম্বরের শেষের দিকে আবু বকর নামে রাজেন্দ্র কলেজের এক ছাত্র আমাদের শ্রীনগর এর ক্যাম্পে এসে বললো, তারা একটি বাহিনী গঠন করেছে। এতোদিন তারা মমিনখারহাটে অবস্থান নিয়েছিলো এবং সেখান থেকে ছোটো ছোটো অপারেশন চালাচ্ছিলো ফরিদপুর শহরে। কিন্তু এখন মমিনখারহাটে অবস্থান সম্ভব হচ্ছে না। বিধায় আমরা নুতুবদিয়ায় অবস্থান নিয়েছি। আমাদের দলে রয়েছে সালাউদ্দিন, নওফেল, শামসুদ্দিন, রুনু, আতাহার, ফরিদ।  আরো অনেকের নাম বললো, যারা বেশীরভাগই ছিলো রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র, যাদেরকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আর নওফেল ছিলো ইমাম ভাই এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সালাউদ্দিনের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে বোয়ালমারীতে।

যাই হোক ৭ ই ডিসেম্বর আবু বকর আমাদের ক্যাম্পে আবার এলো। এখানে বলে রাখা দরকার যশোর ইতিমধ্যে যৌথ-বাহিনী দখল করে নিয়েছে। সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটা শুরু করেছে। আবু বকর জানালো তারা পিছু হটা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করতে চায়। আলফাডাঙ্গার হেমায়েত তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা ৩০-৪০ জন রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য তেমন ভারী অস্ত্র তাদের ছিল না। ৯ ই ডিসেম্বর সকাল আটটার দিকে করিমপুর ব্রিজের ঢালে অবস্থান নেয়। এই বাহিনী এবং যশোর রোডে অবস্থান নিয়ে থাকা পাকিস্তান বাহিনীর ওপর গুলি চালায় তারা। পাকিস্তান বাহিনী তখন পিছু হটা পাগলা কুকুরের মতো। তারা সালাঊদ্দিনদের অবস্থান বুঝে ফেলে এবং এল এমজির ব্রাশ ফায়ার করে ও এনেগ্রা নিক্ষেপ করে এলাকায় ভিতীর সঞ্চার করে ফেলে। আমাদের শ্রীনগর এর ক্যাম্পে খবর আসতে বেলা বারোটা বেজে যায়।

খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফরিদপুর জেলা মুজিব বাহিনীর ডেপুটি লিডার আমাকে নির্দেশ দেয় প্রয়োজনীয় গোলা বারুদ ও ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে করিমপুরের দিকে মার্চ করতে। যথাসম্ভব দ্রুত আমি আমার বাহিনী নিয়ে সাতৈর, কাদিরদী, জাহাপুর হয়ে চানপুর ঘাট পার হয়ে করিমপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। কিন্তু করিমপুরের কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রায় ৫ টা বেজে যায়।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা নওয়াব উদ্দিন আহমেদ টোকন।

ততক্ষণে গোলা গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে খবর এলো আমাদের হেমায়েত গুলিবিদ্ধ হয়ে পিছু হটেছে। আতাহার গুলির সামনে টিকতে না পারে তার সঙ্গীদের নিয়ে কুমার নদীতে ঝাপ দিয়ে পশ্চিম পাড়ে গিয়ে উঠেছে। আর সালাউদ্দিন, নওফেলসহ কয়েকজনকে আখ খেতের মধ্যে ঘেরাও করে ফেলে পাকিস্তান বাহিনী। আমি কিয়াম, ময়েন, রউফ সিদ্দিকি, শফি, সাত্তার, সিরাজ, আনোয়ারসহ প্রায় ১০০ জন যখন করিমপুর ব্রিজের খুব কাছে অবস্থান নেই তখন দেখতে পাই শত শত পাকিস্তানি সেনা পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলেছে।

আমাদের মধ্যে সাত্তার, সিরাজ, কিয়াম উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা না করে ফিরবে না। কিন্তু সিনিয়র যোদ্ধারা মত দিলো মাথা গরম করা ঠিক হবে না। যৌথ বাহিনী খুব কাছে এসে পড়েছে, অবশ্যই তারা হানাদার বাহিনীকে খুব শিগগির সমুচিত জবাব দেবে। বরং যৌথ বাহিনীর কমান্ডারের নির্দেশ অপেক্ষা করব। আমাদের হঠকারী সিদ্ধান্তে আশে পাশের নিরীহ মানুষের জান মালের ক্ষতি হবে। আসলে হালকা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সালাউদ্দীনদের এই আক্রমণে আমাদের সায় ছিলো না।

কিন্তু বাংলা মায়ের এই নির্ভিক দামালেরা কোনো বাধা মানেনি সেদিন। এই যুদ্ধের পর সবাইকে পাওয়া গেল। পাওয়া গেলো না শুধু কাজী সালাউদ্দিন, মেজবাহ ঊদ্দিন নওফেল, ওহাব, সামসুদ্দিন মোল্লা, মঈনুদ্দিন, হামিদ ও মুজিবর রহমানকে। ১৬ ই ডিসেম্বর এর পরে তাদের কঙ্কাল গুলো পাওয়া গিয়েছিল সেই আখের ক্ষেতের ভেতরে, যা স-সম্মানে আলীপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

লেখক: যুদ্ধকালীন কমান্ডার, মুজিব বাহিনী (বিএলএফ)

সাবেক কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বোয়ালমারী উপজেলা, ফরিদপুর।